‘এ ব্যবসায় সাহস থাকলেই টাকা আয় হয়। একটু কৌশল জানলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়া যায়। জায়গা মতো মালও পৌঁছে দেওয়া যায়। ফোনেই সব হয়। চেকপোস্ট থাকলেও সমস্যা হয় না। পুলিশের সামনে আত্মবিশ্বাসী থাকি, তারাও ধরতে পারে না।’

কথাগুলো বলছিলেন টেকনাফের ইয়াবার বাহক ও ব্যবসায়ী আতিকুর রহমান ওরফে আনিস  (ছদ্মনাম)। অবৈধ এ ব্যবসায় তার মাসে আয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। ঝুপড়ির মতো নিজের একচালা টিনের ঘরে বসে তার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। বয়স ২৭। ২০১০ সাল থেকে ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত তিনি।

লাখ লাখ টাকার মালিক আনিস কেন ঝুপড়ি ঘরে থাকেন— জানতে চাইলে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘সবাই জানে আমি বেকার, পরিবারের কারও আয়-রোজগার নেই। একমাত্র আমি কামাই করি। এখন যদি বড় ঘর বানাই তাহলে লোকে সন্দেহ করবে। এদিক-ওদিক আমাকে নিয়ে কথা হবে। তাই ঝুপড়ি ঘরে থাকি।’

ইয়াবা ব্যবসায় যেভাবে জড়ালেন আনিস

পরিবার বলতে বাবা-মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান। অভাব-অনটনের সংসার। এ কারণে ইয়াবা চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন তিনি।

টেকনাফের ইয়াবাবাহক আতিকুর রহমান ওরফে আনিস (ছদ্মনাম)

আনিসের দাবি, এলাকার এক বড় ভাইকে আমার অবস্থা সম্পর্কে জানাই। ওই ভাই-ই আমাকে প্রস্তাব দেয়, ‘তোমার যেহেতু এ অবস্থা (অভাবগ্রস্ত), তুমি আমার কিছু মাল (ইয়াবা) পার করিয়ে (করে) দাও। টাকা পাবা।’ বাধ্য হয়েই ২০১০ সালে এ ব্যবসায় আসি।

‘আমি পরিস্থিতির শিকার। এছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না’— বলেন তিনি।

কোথা থেকে কীভাবে ইয়াবা আসে, পৌঁছায় কোথায়

ঢাকা পোস্টকে আনিস বলেন, ইয়াবা ট্যাবলেট মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসে। আমি যাদের আন্ডারে (অধীন) কাজ করি তারা এখান থেকে (বাংলাদেশ) মিয়ানমারে তাদের নিজস্ব লোকদের কাছে অর্ডার দেয়। সেখানে তাদের অনেক আত্মীয়ও আছে। অর্ডারের পর মিয়ানমার থেকে মাল পাঠানো হয়।

টেকনাফের নাফ নদী, কখনও সমুদ্র দিয়েও মাল আসে। কক্সবাজারের বেশ কয়েকটা ঘাট ধরে বাংলাদেশে পৌঁছায় ইয়াবা। তবে, নাফ নদী দিয়ে বেশি আসে। নদীতে বিজিবির (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) টহল কড়াকড়ি থাকলে সমুদ্র দিয়ে আসে। বর্তমানে নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছে প্রশাসন। এ কারণে এ পথে আসা বন্ধ আছে।

‘ওপার (মিয়ানমার) থেকে নৌকায় প্যাকেটে ভর্তি ইয়াবা আসে। কখনও মাছের ট্রলিতে, কখনও মাছের বাস্কেটে (ঝুড়ি) করে আসে। স্থানীয় জেলেরা এগুলো এনে দেয়। অনেক সময় তারা ছোট ছোট ব্যাগে ইয়াবার প্যাকেটগুলো ভরে নাফ নদীর নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে যায়। পরে এ প্রান্তের ব্যবসায়ীদের ঠিক করা জেলেরা জাল ফেলে সেই ইয়াবা উদ্ধার করে স্থলে নিয়ে আসে। দিনে নয়, এসব কারবার হয় রাতে।’

কক্সবাজারে আটক দুই ইয়াবা কারবারি। এ সময় নগদ অর্থসহ উদ্ধার হয় প্রায় ১৪ লাখ ইয়াবা 

কীভাবে, কার থেকে সংগ্রহ হয় ট্যাবলেট

আনিস বলেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একটা সিন্ডিকেট আছে। কেউ চাইলেই এ ব্যবসা করতে পারেন না। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ইয়াবার অর্ডার দিতে হয়। মিয়ানমারেও সিন্ডিকেট আছে। টাকা পাওয়ার পর মিয়ানমারের সিন্ডিকেট মালের অর্ডার দেয়। মাল রেডি হলে সুযোগ বুঝে মিয়ানমার থেকে টেকনাফের উদ্দেশে বোট ছাড়ে। বেশির ভাগ ইয়াবা আসে মিয়ানমারের মংডু সীমান্ত এলাকা থেকে। একসঙ্গে ১০-১৫ কাট মাল আসে। এক কাটে (কার্টন) ১০ হাজার ইয়াবা থাকে।

আনিসের দায়িত্ব কী

আনিসের ভাষ্য, স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার চুক্তি আছে। মুখে মুখে চুক্তি। তারা মাল (ইয়াবা) এনে তাকে ফোন দেন। নির্দিষ্ট স্থানে তা পৌঁছে দিতে বলেন। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী ইয়াবা সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেন তিনি।

‘অনেকে ভাবেন, ইয়াবা নির্জন স্থানে হাতবদল হয়। এটা ঠিক নয়। আমরা সাধারণত জনসমাগম আছে এমন এলাকা থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করি। যাতে ইয়াবা হাতে পাওয়ার পর স্বাভাবিক থাকতে পারি। এখানে স্বাভাবিক থাকাটাই মূল বিষয়, কেউ সন্দেহ করে না’— বলেন আনিস।

নাফ নদী দিয়ে বেশি আসে ইয়াবার চালান

তিনি আরও বলেন, ‘মূলত টেকনাফ থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে কক্সবাজারের কলাতলী ও সুগন্ধা বিচ এলাকায় পৌঁছে দিই। কখনও ব্যাগে, আবার কখনও কোমরে বাঁধা গামছায় ইয়াবা নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হই। বাহন হিসেবে সিএনজি ব্যবহার করি।’

চেকপোস্ট এড়ানোর কৌশল

আনিস বলেন, আগে থেকেই আমাদের শেখানো হয়, চেকপোস্টে ধরলে কী করতে হবে, কী বলতে হবে। ‘এ ব্যবসায় সাহসটাই বড় জিনিস। টেকনাফ থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পথে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের চার থেকে পাঁচটি চেকপোস্ট পড়ে। যেদিন আমার সঙ্গে প্যাকেট থাকে, সেদিন সাদামাটা কাপড় পরে সিএনজিতে চড়ি। অধিকাংশ সময় পরনে থাকে লুঙ্গি আর শার্ট। মাঝেমধ্যে পাঞ্জাবি-পায়জামাও পরি। শার্ট-প্যান্ট পরলে পুলিশ বেশি সন্দেহ করে, তাই সাধারণ পোশাক ব্যবহার করতাম।’

যেমন চলে তল্লাশি

চেকপোস্টে কোন বাহিনীর কেমন তল্লাশি, সে বিষয়েও বিস্তর বর্ণনা দেন আনিস। বলেন, ‘বিজিবির চেকপোস্টে শরীর ও ব্যাগ বেশি তল্লাশি করা হয়। সেনাবাহিনী জিজ্ঞাসাবাদ বেশি করে, তল্লাশি করে কম। তারা আইডি দেখতে চায়। আইডিতে থাকা নাম, বাবার নাম, জন্ম তারিখ ইত্যাদি জানতে চায়। আর পুলিশের চেকপোস্টে তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তারা গাড়িও থামায় না।’

টেকনাফ সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেকপোস্ট

তিনি বলেন, পুলিশ যখন ধরে তখন সাধারণ মানুষের মতো কথা বলি। তখন ইয়াবা কিন্তু আমার ব্যাগে! ইয়াবার সঙ্গে ডাক্তারি কাগজপত্র, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের এক্সরে রিপোর্ট, গামছা, পানির বোতল, জামা-কাপড় ইত্যাদি থাকে। অনেক সময় ব্যাগের চেন ছেঁড়া থাকে। এটা কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে করা! সেই ছেঁড়া দিয়ে কাপড়ের একটু অংশ বেরিয়ে থাকে। এসব দেখে পুলিশ আর ব্যাগ চেক করে না!

বিজিবির তল্লাশির ধরন একটু আলাদা— উল্লেখ আনিস বলেন, ‘খুব বেশি সন্দেহ হলে শরীর তল্লাশি করতে চায় তারা। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে এমন ভাব দেখাই যে, আমার খু্ব তাড়া আছে। তাদের তল্লাশির কারণে আমার অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। তবে, চেক করতে দিতাম। বিজিবি প্রায়ই নাম-বাবার নাম জিজ্ঞাসা করে, আর বুকে হাত দেয়। তারা আমার হার্টবিট (হৃদস্পন্দন) চেক করে, আমি মিথ্যা নাকি সত্য বলি! কিন্তু আমি সবসময় স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করি। এ কারণে তারাও আমার হার্টবিট স্বাভাবিক পায়।’

চেকপোস্টে কী জিজ্ঞাসা করে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে পরিচয় জানতে চায়। আইডি কার্ড দেখে তারা তা মিলিয়ে নেয়। এরপর জিজ্ঞাসা করে, কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। আমি বলি, আমার খালু বা চাচা কক্সবাজার মেডিকেলে ভর্তি। তার সঙ্গে দেখা করতে যাব। সেখানে থাকার জন্য কাপড়-চোপড় নিয়ে যাচ্ছি। না থাকতে হলে রাতেই টেকনাফে ফিরে আসব।

মাছ ধরার এসব নৌকায় করে মিয়ানমার থেকে আনা হয় ইয়াবা

একটু ভাব নিয়ে আনিস বলেন, ‘গত ১১ বছরে কখনওই চেকপোস্টে ধরা খাইনি। এখন পর্যন্ত আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলাও হয়নি।’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো তথ্য না এলে তারা চেকপোস্টে ইয়াবা ধরতে তৎপরতা দেখায় না। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা আসার পর তাদের চলাচল আটকাতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন চেকপোস্টের সদস্যরা— জানান তিনি।

যেভাবে ইয়াবার চালান হস্তান্তর, কত টাকা আয়

আনিস বলেন, আমি একসঙ্গে দুই থেকে তিন হাজার পিস ইয়াবা ব্যাগে নিয়ে কলাতলী যাই। ইয়াবার প্যাকেট হস্তান্তরের আগে অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়। প্রতি চালানে আমার আয় হয় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা।

‘আমাকে বলা হয়, কলাতলী বিচের অমুক হোটেলের পাশের ইলেকট্রিক খাম্বার সামনে অমুক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকবেন। তার পোশাকের রঙ বলা হয়। নির্দিষ্ট স্থানে গেলে তাকে পাওয়া যায়। প্যাকেট দিয়ে আসি। কাজ শেষ।’

তিনি বলেন, প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা জোন ভাগ করা থাকে। এ কারণে কোনো সমস্যা হয় না।

ইয়াবা ও মানবপাচার রেধে টেকনাফ সীমান্তে বিজিবির টহল

সর্বশেষ কবে ইয়াবার চালান হস্তান্তর করেছেন— এমন প্রশ্নের জবাবে আনিস বলেন, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তিন হাজার ইয়াবার একটি প্যাকেট নিয়ে কলাতলী বিচে যাই। সেখানে ওশান প্যারাডাইস হোটেলের সামনের বিচে আমাকে দাঁড়াতে বলা হয়। দুজন ব্যক্তি মোটরসাইকেলে এসে প্যাকেটটি নিয়ে যায়।

তিনি ঢাকা পোস্টের কাছে দাবি করেন, ধরা না খেলেও রিক্স থেকে যায়। একবার ধরা খেলে আর রক্ষা নেই। তাই বাবা-মা, স্ত্রী আর সন্তানদের কথা চিন্তা করে এ পেশা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছি। তবে ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা যায়, আনিস এখনও ইয়াবার বাহক হিসেবে কাজ করছেন।

এআর/জেইউ/এমএআর/