করোনার কারণে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছেন দেশের যৌনকর্মীরা / ছবি- সংগৃহীত

একটা সময় ছিল যখন যৌনপল্লির আশপাশে খদ্দেরদের আনাগোনা থাকত। যৌনকর্মীদের আয়-রোজগারও হতো বেশ। নিজের ও পরিবারের খরচ চালিয়ে কিছু অর্থ জমাতেও পারতেন তারা। কিন্তু সবকিছু বদলে দিয়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। সরকারি নিষেধাজ্ঞা, খদ্দেরদের কম আনাগোনা— সব মিলিয়ে খারাপ সময় যাচ্ছে তাদের। অর্থকষ্ট তো আছেই, সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনার টিকা না পাওয়ার দুশ্চিন্তা।

২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্তের পর ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে লকডাউন শুরু হয়। ওই সময় থেকে এ পেশার কর্মীদের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। দুর্ভোগ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি তারা। লকডাউনের শুরুর দিকে কঠোর নিষেধাজ্ঞায় কয়েক মাস কোনো খদ্দের জোটেনি তাদের।

ঢাকা শহরে ওই সময় ১২টি ড্রপিং সেন্টারে প্রায় আট হাজার যৌনকর্মী ছিলেন। অনেকেরই থাকার জায়গা পর্যন্ত নেই। বিভিন্ন সেক্স ওয়ার্কার সংগঠনের সহযোগিতায় তারা কোনোভাবে বেঁচে আছেন। সংগঠনগুলো থেকে বলা হচ্ছে, তাদের দেখভালের দায়িত্ব সমাজসেবা অধিদফতরের। কিন্তু করোনাকালে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করাই সম্ভব হয়নি।

যৌনকর্মীদের সংগঠন সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক অব বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সারাদেশে ২৫ হাজার ভাসমান এবং যৌনপল্লিতে ৭০ হাজার বৈধ কর্মী ছিলেন। ২০২০ সালে তাদের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৬৫ হাজারে। তবে ২০১৫-১৬ সালের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে যৌনকর্মীর সংখ্যা এক লাখ দুই হাজার। বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে এ সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ বলে ধারণা করা হয়। সেভ দ্য চিলড্রেন’র হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে যৌনকর্মীদের ৫ শতাংশ হোটেলে, ৪১ শতাংশ ভাসমান ও ৫৪ শতাংশ যৌনপল্লিতে অবস্থান করছিলেন।

রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া যৌনপল্লির অসহায় নারী ঐক্য সংঘের সভানেত্রী ঝুমুর বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছর সরকারের পক্ষ থেকে কিছু সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়া হয়েছিল। এবারও পেয়েছি। কিন্তু তা দিয়ে তো আর চলে না। বর্তমানে কোনো খদ্দের নেই। করোনার জন্য কেউ আসেও না। পুলিশের পক্ষ থেকে তেমন বাধা নেই। এখানে আমরা প্রায় দেড় হাজার মানুষ বসবাস করি। সবাই আর্থিক সংকটে আছেন। পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে পড়েছে।

বৈধ-অবৈধ মিলে দেশে যৌনকর্মীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ বলে ধারণা করা হয় / ছবি- সংগৃহীত

টাঙ্গাইলের নারীমুক্তির সংগঠনের সভাপতি আকলিমা বেগম বলেন, ‘আমাদের এখানে ৫৫০ জনের বেশি নারীকর্মী আছেন। এখন কোনো লোক (খদ্দের) আসে না। খুব কষ্টে চলছে। মাঝে মধ্যে দু-একজন আসেন। রোজার অনেক আগে সরকারি কিছু সহায়তা পেয়েছিলাম। এখন তেমন কিছু আসে না। যা আসে, নামমাত্র! তা দিয়ে কিছুই হয় না। পুলিশ বাধা না দিলেও করোনার কারণে লোকজনের আনাগোনা নেই।’

নারায়ণগঞ্জ শহরের যৌনকর্মী সাজেদা বলেন, শহরের কাঠপট্টি এলাকায় একটি ঝুপড়ি ঘর ছিল আমার। চার বছর আগে সরকার সেখান থেকে উচ্ছেদ করে। এরপর জায়গা হয় শহরের লঞ্চঘাট এলাকায়। বর্তমানে কোনো খদ্দের নেই, আয় একেবারেই বন্ধ। হঠাৎ কোনো খদ্দের এলে পুলিশ লাঠিপেটা করে, মাস্তানরা হয়রানি করে। পরিস্থিতি দিনদিন জটিল হচ্ছে। প্রতিদিন খাবারের জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। 

‘গত বছর প্রথম যখন লকডাউন দেয়, তখন সরকারি-বেসরকারিভাবে বেশ সহায়তা পাওয়া যায়। এবারের চিত্র ভিন্ন। এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা আসেনি। ঘরভাড়া ও পরিবারের নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ জোগানো কঠিন হয়ে পড়ছে।’

প্রতিবারের মতো এবারও ঈদুল আজহার আগে দৌলতদিয়া ও টাঙ্গাইলের যৌনকর্মীরা কিছু সহায়তা পেয়েছেন। চাল-ডাল, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ এক কেজি মাংস দেওয়া হয় তাদের। ঈদের আগে এমন সহায়তা পেয়ে খুশি হলেও নগদ অর্থ পেলে আরও বেশি খুশি হতেন তারা।

যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, দেশের তালিকাভুক্ত এক লাখ দুই হাজার যৌনকর্মীসহ ভাসমান কর্মীদের প্রত্যেককে সাহায্য করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের সহায়তার জন্য অভিভাবক প্রতিষ্ঠান সমাজসেবা অধিদফতরেও যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। সংগঠনগুলোর দাবি, সরকারিভাবে সেভাবে সাহায্য-সহযোগিতা না পেলেও জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া যৌনকর্মীদের যেন ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

যৌনকর্মীদের কষ্টের কথা শোনার যেন কেউ নেই, নীরব অভিভাবক প্রতিষ্ঠান সমাজসেবা অধিদফতর / ছবি- সংগৃহীত

সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক অফ বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক আলেয়া আক্তার লিলি বলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ডোনারের কাছ থেকে কিছু সাহায্য নিয়ে যৌনকর্মীদের দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু সবাইকে দিতে পারছি না। আমাদের তালিকায় এক লাখ দুই হাজারের মতো কর্মী আছেন। ধরেন, ঢাকাতে দুর্জয় নারী সংঘের সদস্য আছেন পাঁচ হাজার। আমি হয়তো ১০০ জনকে সাহায্য করতে পারি। সবাইকে তো সহায়তার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য সরকারকে এগিয়ে আসা উচিত।  

তিনি আরও বলেন, আমরা নিজেরাও ছোট ছোট কমিটি করে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। এক্ষেত্রেও সরকারের এগিয়ে আসা উচিত। কিন্তু সেটি আমরা দেখছি না। শুধুমাত্র পতিতালয়ে যারা আছেন, তাদের সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ভাসমানরা কোনো সহায়তা বা প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন না। আমরা সমাজসেবা অধিদফতরেও বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করছি। কিন্তু তাদের দেখাই মিলছে না।

যৌনকর্মীদের করোনার টিকা দেওয়া প্রসঙ্গে আলেয়া আক্তার লিলি বলেন, তাদের অনেকেরই জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। ফলে তারা টিকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। লকডাউন শিথিল করায় এখন তারা খদ্দেরদের সংস্পর্শে যাচ্ছেন। এখন যদি তাদের টিকা দেওয়া না যায় তাহলে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। এ কারণে আমাদের দাবি, জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া যৌনকর্মীদের দ্রুত টিকার আওতায় আনা হোক। প্রয়োজনে আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রকৃত যৌনকর্মীদের তালিকা সরকারের কাছে হস্তান্তর করব।

জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া যৌনকর্মীদের টিকা পাওয়া নিয়েও তৈরি হয়েছে সংশয় / ছবি- সংগৃহীত

অক্ষয় নারী সংঘের সভাপতি কাজল আখতার এ প্রসঙ্গে বলেন, আমার হিসাবে শুধু নারায়ণগঞ্জ শহরেই ৭০০ যৌনকর্মী আছেন। তাদের মধ্যে ভাসমান প্রায় ৩০০ জন। এসব নারীর কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। প্রায় সবারই স্বামী আছে, তবে আইনি কোনো বৈধতা নেই। রয়েছে তিন-চারটি সন্তান। প্রায় ক্ষেত্রেই স্বামী-সন্তানদের ভরণপোষণ তাদেরই বহন করতে হয়। আয় না থাকলে উল্টো স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে হয়। করোনার কারণে সব বন্ধ থাকায় তারা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন।

২০১৭ সালে সারাদেশে ২৫ হাজার ভাসমান এবং যৌনপল্লিতে ৭০ হাজার বৈধ কর্মী ছিলেন। ২০২০ সালে তাদের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৬৫ হাজারে। তবে ২০১৫-১৬ সালের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে যৌনকর্মীর সংখ্যা এক লাখ দুই হাজার। বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে এ সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ বলে ধারণা করা হয়

‘এখন পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হয়েছে। অনেকেই রাস্তায় নামছেন। এখন জরুরিভিত্তিতে তাদের টিকার আওতায় আনা উচিত। পাশাপাশি তাদের সহায়তার বিষয়েও সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।’

করোনার মধ্যে যৌনকর্মীদের সহায়তার বিষয়ে সমাজসেবা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) সৈয়দ মো. নূরুল বাসির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সামাজিকভাবে যাদের গ্রহণযোগ্যতা কম তাদের জন্য দুটি সেন্টার আছে। কিন্তু সেখানে তারা যেতে চান না। আমরা তো তাদের নিতে চাই। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভালো কাজে যুক্ত করতে চাই। তারা সেখানে (সেন্টার) এলে এতটুকুই সহযোগিতা করতে পারি আমরা। এর বাইরে আর কিছুই করার থাকে না।’

এমএইচএন/এইচকে/এমএআর/