বিদ্যমান আইনে বাল্যবিয়ে একটি অপরাধ। অপ্রাপ্তবয়স্ক বা শিশুর বিয়ের পর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্কও মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। শিশুবিবাহ যে একধরনের যৌন নির্যাতন, তা এখনও বিশ্বাস করেন না বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ। যদিও বাল্যবিয়ে রোধে কঠোর আইন করেছে সরকার। কিন্তু এ আইনেও কি নারী নির্যাতন, বাল্যবিয়ে কমছে?

উত্তরে কন্যাশিশু-নারী অধিকার ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মোটেও কমানো যায়নি বাল্যবিয়ে। বরং জেঁকে বসা বৈশ্বিক মহামারি করোনায় আর্থিক-সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা এবং কন্যাশিশুর দায়হীনতা হুমকির মুখে ফেলেছে তাদের ভবিষ্যৎ। এতে অনিরাপদ সামাজিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের একটি বিশেষ বিধানও পক্ষান্তরে সহায়ক হয়ে উঠেছে।

বগুড়া জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত ৭ জুন দুপুরে সান্তাহার পৌরশহরের পোস্ট অফিস পাড়ার জাহাঙ্গীর হোসেনের স্কুলপড়ুয়া নাবালিকা মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার (ছদ্মনাম) বিয়ের প্রস্তুতি চলছিল। খবর পেয়ে আদমদীঘি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সীমা শারমীন সেখানে যান। তখনও বিয়ের প্রক্রিয়া চলছিল। ইউএনও ও পুলিশের উপস্থিতির খবরে বরপক্ষ আর সেখানে উপস্থিত হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। কিন্তু গ্রামের মাতব্বর আর স্বজনদের চাপে বাধ্য হয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে! তার পথেই হাঁটতে হয় ফুটবল দলটির আরও ছয় কিশোরীকে। হয়তো ওরাও হতে পারতেন বড় ফুটবলার

আদমদীঘি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সীমা শারমীন বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এসে আমরা ওই বাল্যবিয়ে বন্ধ করি এবং মেয়ের প্রাপ্ত বয়স না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে দিতে পারবে না মর্মে মুচলেকা গ্রহণ করি।

করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে দেশব্যাপী চলা কঠোর লকডাউনের মধ্যেই গত ২ জুলাই জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার মেরুরচর ইউনিয়নের একটি গ্রামে চলছিল অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া এক ছাত্রীর বিয়ের আয়োজন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বিয়ে ঠেকিয়ে দেন বকশীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনমুন জাহান লিজা।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনমুন জাহান লিজা জানান, খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়। পরে উভয় পরিবার ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে ১৮ বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দেবেন না— এমন মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

তবে বাল্যবিয়ের অভিশাপে শেষ হয়ে গেছে দেশসেরা ফুটবলার স্বরলিকার স্বপ্ন। তিনি এখন পুরোদস্তুর গৃহিণী। যে কিনা ২০১৭ সালে বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপ ফুটবলের ফাইনালে হ্যাট্রিক করে ‘স্বরলিকা’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।

বলছি কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর পাথরডুবি ইউনিয়নের বাঁশজানি গ্রামের শহিদুল ইসলামের মেয়ে স্বরলিকা পারভীনের কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। কিন্তু গ্রামের মাতব্বর আর স্বজনদের চাপে বাধ্য হয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে!

১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়েছে দেশে এমন নারীর সংখ্যা তিন কোটি ৮০ লাখ। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হচ্ছে বাংলাদেশে, যা সারাবিশ্বে অষ্টম

তার পথেই হাঁটতে হয় ফুটবল দলটির আরও ছয় কিশোরীকে। হয়তো ওরাও হতে পারতেন বড় ফুটবলার। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। ওই ছয় কিশোরী হলেন- বাঁশজানি হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী জয়নব (১৫), নবম শ্রেণির শাবানা (১৬), অষ্টম শ্রেণির রত্না (১৫), আঁখি (১৫), শারমিন (১৬) ও আতিকা (১৬)। তাদের স্বামীদের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।

ভূরুঙ্গামারী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মা জানিয়েছেন, কিশোরী ফুটবলারদের বাল্যবিয়ের বিষয়ে কেউ কিছু জানায়নি। জানলে অবশ্যই আইনি পদক্ষেপ নিতেন।

বাল্যবিয়ে রোধে ২০১৮ সালে সরকার জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেখানে ২০২১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক হলেও এর বিশেষ অগ্রগতি হয়নি। তবে, বাল্যবিয়ে ভাঙার ক্ষেত্রে সফল ভূমিকা পালন করছে সরকারের জরুরি জাতীয় সেবা ‘৯৯৯’।

‘৯৯৯’ এর ইন্সপেক্টর (মিডিয়া) আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সারাদেশ থেকে ‘৯৯৯’ এ বাল্যবিয়ে হচ্ছে বা বাল্যবিয়ে ভেঙে দিতে আইনি সহায়তা চেয়ে কল এসেছে ১৫৬১টি। ১৫৬১টি বিয়েই পুলিশ কোনো না কোনোভাবে স্থানীয় প্রশাসন, থানা পুলিশের সহায়তায় ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে।

তিনি বলেন, করোনার এ সময় প্রায়দিনই বাল্যবিয়ে ভাঙার কল আসছে। গত জুলাই মাসে ময়মনসিংহ থেকে সর্বোচ্চ ৩৮টি কল আসে। কুমিল্লা ও বগুড়া থেকে ১৮টিসহ মোট ৪৪৪টি কল আসে অন্যান্য জেলা থেকে। কখনও পুলিশ বা মোবাইল কোর্ট আসার খবরে বরপক্ষ বিয়ে ভেঙে চলে যাচ্ছেন। কখনও-বা স্থানীয় চেয়ারম্যান-ওয়ার্ড মেম্বারদের সহযোগিতায় বাল্যবিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে।

অন্যদিকে, সংসদীয় কমিটিতে উত্থাপিত মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনাকালে ২০২০ সালের মার্চ-জুন পর্যন্ত সারাদেশে ২৬৬টি বাল্যবিয়ে ঠেকানো সম্ভব হলেও ঠেকানো যায়নি ২৩১টি বিয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ৭১টি বাল্যবিয়ে হয়েছে উত্তর জনপদের জেলা কুড়িগ্রামে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নাটোর জেলায়, ২৩টি। ১৫টি করে বাল্যবিয়ে হয়েছে যশোর ও কুষ্টিয়ায়।

করোনাকালে ২০২০ সালের মার্চ-জুন পর্যন্ত সারাদেশে ২৬৬টি বাল্যবিয়ে ঠেকানো সম্ভব হলেও ঠেকানো যায়নি ২৩১টি বিয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ৭১টি বাল্যবিয়ে হয়েছে উত্তর জনপদের জেলা কুড়িগ্রামে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নাটোর জেলায়, ২৩টি। ১৫টি করে বাল্যবিয়ে হয়েছে যশোর ও কুষ্টিয়ায়

ইউনিসেফের সহযোগিতায় পরিচালিত চাইল্ড হেল্পলাইন ‘১০৯৮’ সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের এপ্রিলে চাইল্ড হেল্পলাইনে বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত ৪৫০টি ফোনকল আসে। যা মার্চে ছিল ৩২২টি।

তবে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে ১৩৪৬ কন্যাশিশু ও নারী ধর্ষণের ঘটনাসহ মোট ৩৪৪০ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ১১৭টি। এর মধ্যে বাল্যবিয়ের চেষ্টা হয়েছে ৩৩টি।

করোনাকালে বাল্যবিয়ে বেড়েছে বলে বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জরিপেও উঠে এসেছে। ইউনিসেফ, ইউএনএফপি ও প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সহায়তায় ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাত মাসে দেশের মোট ৬৪টি জেলার মধ্যে ২১টির ৮৪টি উপজেলায় বাল্যবিয়ের মাত্রা নিয়ে পরিচালিত জরিপের ফলাফল সংস্থাটি প্রকাশ করেছে।

এতে দেখা যায়, অন্তত ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। ১৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন ৫০.৬ শতাংশ, ৪৭.৭ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছর এবং ১.৭ শতাংশের বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে।

অন্যদিকে, জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ২০২০ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে অনুযায়ী, দেশে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের ৫৯ শতাংশেরই ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে হয়। একই তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১২-১৩ সালের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার জরিপে। তাতে বলা হয়েছে, দেশে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৫২.৩ শতাংশই বাল্যবিয়ের শিকার। অর্ধযুগ পর ২০১৯ সালে সেই জরিপে বাল্যবিয়ের হার কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৫১.৪ শতাংশে।

সরকারি তথ্যের ভিত্তিতে ইউনিসেফ ২০২০ সালে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়েছে দেশে এমন নারীর সংখ্যা তিন কোটি ৮০ লাখ। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হচ্ছে বাংলাদেশে, যা সারাবিশ্বে অষ্টম।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে বন্ধ এবং সরকারের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে নির্মূলে গত দশকের তুলনায় যথাক্রমে কমপক্ষে ১৭ গুণ ও আটগুণ বেশি কাজ করতে হবে বলে মনে করে ইউনিসেফ।

শিশুদের বিয়ে দেওয়া একধরনের যৌন নির্যাতনের মধ্যে পড়ে— এটি বিশ্বাস করেন না বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ। এ কারণে যেসব মেয়েদের বিয়ে হয়, তারা আগাম গর্ভবতী হওয়া এবং নেতিবাচক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন

কেন বাড়ছে বাল্যবিয়ে

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গত বছরের জুনে ৪৬২টি শিশুকন্যা বাল্যবিয়ের শিকার হন। এর মধ্যে ২০৭টি বাল্যবিয়ে রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। মে মাসেও ১৭০টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। যদিও প্রশাসন ও স্থানীয় সচেতন মহলের উদ্যোগে ২৩৩টি বিয়ে ঠেকানো সম্ভব হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বহুদিন ধরে বন্ধ। বহু মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার। কাজ না থাকায় অনেকের ঘরেই অভাব। সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তাভাবনা করে অনেক বাবা-মা শিশুকন্যাকে নিজের কাছে রাখতে সাহস পাচ্ছেন না। তারা অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। তাই তড়িঘড়ি বিয়ে দিচ্ছেন।

মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সেন্ট্রাল উইমেন ইউনিভার্সিটির সোশিয়লজি অ্যান্ড উইমেন স্টাডিজ বিভাগের প্রধান মালেকা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কে পালিয়ে বিয়ে করল তা মন্ত্রণালয় কেন বলবে? সেটা পরিবার বলবে। বিয়ের বয়সই যদি না হয় তাহলে পালিয়েও তো বিয়ে বৈধতা পায় না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তাহলে কী করে? তাদের কাজটা কী? সরকারের অন্যান্য বিভাগের সহযোগিতা নিয়ে তো সহজেই বাল্যবিয়ে বন্ধ করা যায়। করোনাকালে বাল্যবিয়ে বাড়লেও মন্ত্রণালয়ের কোনো কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়।

পালিয়ে বিয়ে বাড়াচ্ছে বাল্যবিয়ের সংখ্যা

অল্প বয়সের মেয়েরা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করায় বাল্যবিয়ে বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটির এমন তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এর কারণ খুঁজে বের করার পাশাপাশি এ বিষয়ে একটি জরিপও পরিচালনা করছে।
 
গত ২৫ আগস্ট (বুধবার) সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভার কার্যপত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। কমিটি আগের বৈঠকে এ সংক্রান্ত একটি সুপারিশ করে।

কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ বলেন, ‘করোনাকালে অবাধ ইন্টারনেট ব্যবহারে কম বয়সী মেয়েদের প্রেমের সম্পর্ক বাড়ছে। এমন অনেক তথ্য আমাদের কাছে আসছে। প্রেম করে পালিয়ে বিয়ের কারণে যে বাল্যবিয়ে বাড়ছে, সেটা নিয়ে কেউ কথা বলে না। আমরা এজন্য জরিপ করতে বলেছি।
 
বাল্যবিয়ে ঠেকাতে প্রতিবন্ধকতা কোথায়

১৯২৯ সালের ‘চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেইন্ট অ্যাক্ট’ বাতিল করে ২০১৭ সালে সরকার শাস্তি বাড়িয়ে প্রণয়ন করে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’। কিন্তু তাতে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে’ বিয়ের সুযোগ রাখা হয়। এ বিশেষ বিধানই বাল্যবিয়ে রোধে প্রতিবন্ধক বলে শুরু থেকে আপত্তি জানিয়েছেন নারী অধিকার কর্মীরা।
 
নতুন আইনের ‘বিশেষ ধারা’ বাল্যবিয়ের সহায়ক

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী আইনজীবী এলিনা খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন আইনের বিশেষ বিধানটি বাল্যবিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে। ১৬ বছরের ওপরে কেউ বিশেষ কারণে কোর্টের (আদালত) কাছ থেকে পারমিশন (অনুমতি) নিয়ে বিয়ে করতে পারবেন। বিশেষ কী কারণে, সেটা কিন্তু স্পষ্ট নয়! যা আগের আইনে ছিল না। এটাই যদি হয় তবে এ আইনের যথার্থতা থাকে না। এটার সুযোগ নিয়ে অনেক অভিভাবক অপ্রাপ্ত মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন।

করোনাকালে আর্থিক-সামাজিক ঝুঁকি বাড়িয়েছে বাল্যবিয়ে

করোনার জন্য অনেকে কর্ম-শ্রম হারিয়েছেন। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। আবার করোনার প্রভাবে সন্তানদের স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে। যেকোনো সময় একটা ঝামেলা হতে পারে, মেয়ে পালিয়ে যেতে পারে। সামাজিক এসব নিরাপত্তাহীনতার কারণে কোনো অভিভাবক ঝুঁকি নিতে রাজি নন।

এলিনা খান বলেন, ‘আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা অভিভাবকরা মনে করেন, যদি বিয়ে দিয়ে দিই তাহলে বখাটে ছেলেদের হয়রানি বা ধর্ষণের ঘটনা ঘটবে না, অর্থনৈতিক চাপও কমবে।

বাল্যবিয়ে বন্ধে সরকারের পদক্ষেপ যথোপযুক্ত নয়

মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাল্যবিয়ে বন্ধে সরকারের যে ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, সেটা করা হচ্ছে না। একটা বাল্যবিয়ের খবর আসলে স্থানীয়, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান বা ইউএনও দায়ী থাকবেন। এমন মনিটরিংয়ের বিধান রাখার দাবি ছিল। সেটা করা হয়নি। এটা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

বিদ্যমান আইনের কালো ধারাটি বাতিলসহ তিন দাবি

ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, আমরা জানি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বাল্যবিয়ে বন্ধে সদিচ্ছা দেখাচ্ছেন। কিন্তু এটা নিরোধে যে আইনটা করা হয়েছে সেটা অসম্পূর্ণ এবং কোর্টের অনুমতিতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার যে ‘কালো ধারা’ সংযুক্ত করা হয়েছে সেটা বাতিল করতে হবে। মেয়েদের লেখাপড়াকে নিশ্চিত করতে হবে। করোনায় স্কুল-কলেজ থেকে ঝরে পড়া বন্ধ করতে হবে। বিবাহ রেজিস্ট্রেশন পলিসি আরও শক্ত করতে হবে। বিবাহ রেজিস্ট্রিতে জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

অন্যদিকে ইউনিসেফ বলছে, একজন মেয়েশিশু যখন যৌবনপ্রাপ্ত হন, পিতা-মাতা তখনই তার বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। তারা মেয়েশিশুর বয়ঃসন্ধির শুরুতে যৌন নির্যাতনের ভয়ে সতীত্ব রক্ষায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বাল্যবিয়ে রোধের ক্ষেত্রে এটি হলো মূল বাঁধা। বিবাহিত কিশোরী দৈহিক-যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও তাদের মধ্যে ৩৩ শতাংশই বিশ্বাস করেন যে, একজন স্বামীর তার স্ত্রীকে আঘাত করবে, এটি যৌক্তিক।

আবার শিশুদের বিয়ে দেওয়া একধরনের যৌন নির্যাতনের মধ্যে পড়ে— এটি বিশ্বাস করেন না বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ। এ কারণে যেসব কিশোরী মেয়েদের বিয়ে হয়, তারা আগাম গর্ভবতী হওয়া এবং নেতিবাচক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন।

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুবিশেষজ্ঞ প্রফেসর রাজেশ মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, একজন কিশোরীকে হঠাৎ যখন বিয়ে দেওয়া হয় তখন তিনি সংসার, নতুন পরিবার, বিশেষ করে শারীরিক সম্পর্কের বিষয়ে অপ্রস্তুত থাকেন। যা তার মনে ও শরীরে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। শারীরিক সম্পর্কের কারণে অপ্রস্তুত কিশোরী মানসিক স্ট্রেস থেকে মারা যেতে পারেন। এছাড়া অপ্রাপ্ত বয়সে মা হলে বাচ্চাও অপুষ্টিতে ভোগে।

জেইউ/এমএআর/