বেশির ভাগ ভ্রমণপিপাসুর এখন পছন্দের তালিকায় চট্টগ্রামের মিরসরাই (ছবি: মহামায়া লেক)

এখন শীতের মৌসুম। ভ্রমণপ্রেমীরা ছুটে চলেছেন দেশের বিভিন্ন পর্যটন এলাকায়। অন্যদিকে করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন ঘরবন্দী মানুষ এখন বাইরে বের হচ্ছেন, ঘুরছেন আপন মনে। যদিও এখনো করোনার প্রাদুর্ভাব রয়ে গেছে। এরপরও ভ্রমণপিপাসুরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন দেশের দর্শনীয় ও পর্যটন এলাকা। আর তাদের বেশির ভাগেরই এখন পছন্দের তালিকায় চট্টগ্রামের মিরসরাই।

এখানে রয়েছে পাহাড় ও সমতল বিস্তৃত ভূমি। রয়েছে আঁকাবাঁকা জলপথ। ঝরনা আর সুউচ্চ পাহাড়ের হাতছানি। দুই দিকে পাহাড় আর মাঝখানে গিরিপথ। সেখানে গেলেই মনে হবে যেন এটি দক্ষিণ আমেরিকার কোনো স্থান।

মহামায়া লেক
মিরসরাই উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ঠাকুরদিঘী বাজার থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে মহামায়া লেক। দেখে মনে হবে সত্যি এ যেন এক অপরূপ মায়া। পাহাড়ের কোলে ১১ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে মহামায়া লেকের অবস্থান। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম লেক এটি।

মহামায়া লেকে আছে কায়াকিং ও তাঁবুতে রাতে ক্যাম্পিং করার সুবিধা। আর এসব কিছুর জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানের পর্যটকদের আগ্রহের স্থান এটি। পর্যটনকেন্দ্রটি দেখতে প্রায় প্রতিদিন জনসমুদ্রে পরিণত হতো মহাময়া লেক। শিশু, বৃদ্ধা, শিক্ষার্থী কিংবা কর্মজীবী― সবার নজরে মীরসরাইয়ের এ স্থানটি।

২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহামায়া সেচ প্রকল্প উদ্বোধন করেন। ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত মহামায়া লেকের অন্যতম আকর্ষণ পাহাড়ি ঝরনা। স্বচ্ছ পানির জলাধারের চারপাশ সবুজ চাদরে আবৃত।

বোয়ালিয়া ট্রেইল
চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের অন্যতম আকর্ষণ এখন বোয়ালিয়া ট্রেইল। ঝরনা, খুম, ক্যাসকেড, ঝিরিপথ এই ট্রেইলটিকে করেছে বহুগুণ দর্শনীয়। এই এক রুটেই আপনি দেখা পাবেন তিনটি ঝরনার।

বোয়ালিয়া ট্রেইলে আছে বোয়াইল্যা, বাউশ্যা, অমরমানিক্য ঝরনা। এ ছাড়া আছে ন হাইত্যে কুম, পালাকাটা খুম, উঠান ঢাল, আন্দারমানিক ঝরনা, তিন নং ছড়া, কলাতলি ঝরনা, লতকাও বা কেম্বাতলী ঝরনা এবং লতা বায়ানী।

দুই দিকে উঁচু পাহাড় আর মাঝখানে গিরিপথ, পাথুরে দুর্গম ঝিরি, যার দুপাশে গহিন জঙ্গল বোয়ালিয়া ট্রেইলকে  করেছে এডভেঞ্চারাস। ঝরনার পানিতে পাহাড়ে তৈরি হয় নতুন পরিবেশ। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বেড়ে ওঠা ঝরনাগুলো তখন ফিরে যায় যৌবনে। ঝরনার শোঁ শোঁ শব্দে প্রাণ চঞ্চল হয়ে ওঠে নিমেষেই। তার পাশাপাশি রয়েছে ট্র্যাকিং পথ ও পর্যটকদের অনেক আকর্ষণ করার বিষয়।

আর এখানে অ্যাডভেঞ্চারের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়। দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করে ঝরনার শীতল জলের ছোঁয়া পাওয়ার আনন্দ অন্যরকম।

নাপিত্তাছড়া ঝরনা
মীরসরাই উপজেলা। ভ্রমণপ্রেমী মানুষের কাছে এটি ঝরনার শহর নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এ উপজেলায় প্রবেশ করতে শুনতে পাওয়া যায় ঝরনার ধ্বনি। চোখজুড়ে আসে এই উপজেলার পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সৌন্দর্যে। আর এমনই এক সৌন্দর্যের নাম নাপিত্তাছড়া ঝরনা।

ঝরনায় প্রবেশে যে ঝিরিপথ আছে, তা নাপিত্তাছড়া ট্রেইল নামে পরিচিত। এই ট্রেইলে আছে টিপরা খুম, কুপিটা খুম, বাঘবিয়ানী ঝরনা ও বান্দরখুম নামের আরও বেশ কিছু ঝরনা ও খুম। তুলনামূলক সহজ ট্রেইল হওয়ায় একটু কষ্ট করলে এক দিনেই পুরো ট্রেইল হেঁটে উপভোগ করতে পারবেন।

উপজেলার নয়দুয়ারী বাজার থেকে পূর্ব দিকের রাস্তা রেললাইন পার হয়ে আরও কিছুদূর হেঁটে গেলে নাপিত্তাছড়া পাড়ার দেখা পাবেন। সেখান থেকে থেকে ঝিরি ও পাহাড়ি পথের ট্রেকিং শুরু হবে। কিছুদূর যাওয়ার পর প্রথমে এই ট্রেইলের টিপরা খুমের দেখা পাবেন। মূলত এটি একটি ক্যাসকেড। টিপরা খুমের ওপরেই কুপিকাটা খুম। এই খুম বেশ গভীর।

কুপিকাটা খুমের ডান পাশ দিয়ে পাহাড়ে উঠে আবার ঝিরিতে নেমে সামনে গেলে হাতের বাঁয়ে আরও একটি ঝিরি পড়বে। এই ঝিরি ধরে ৩০ মিনিটের মতো গেলে ঝিরির শেষ মাথায় বাঘ বিয়ানী ঝরনা দেখতে পাবেন। সেই ঝরনা দেখে আবার পেছনে এসে আগের ঝিরি ধরে সামনে এগিয়ে গেলে কিছু সুন্দর ক্যাসকেড পাবেন আর ঝিরির শেষে দেখা পাবেন বান্দর খুম ঝরনার।

বাওয়াছড়া লেক
বাওয়াছড়া লেক। ঝরনার পানির কলকল ধ্বনি, সবুজ গাছের বেষ্টনী। পরিযায়ী পাখিদের আগমন। মিরসরাই উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের ছোটকমলদহ বাজারের দক্ষিণ পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দেড় কিলোমিটার পূর্বে বাওয়াছড়া লেকটির অবস্থান। বাওয়াছড়া লেকটি মিরসরাইয়ের ওয়াহেদপুর গ্রামের বারমাসি ছড়ার মুখে অবস্থিত বলে লেকটির নামকরণ করা হয়েছে বাওয়াছড়া লেক।

বাওয়াছড়া লেকের মূল আকর্ষণ এখানে অনেক জীববৈচিত্র্যের এক মিলনমেলা। আছে লাল আর নীল রঙের ফড়িঙের মিছিল। একটি ঝিরিপথ। চলার পথে শোনা যায় হরিণের ডাক। পাখিদের ডাক। বাওয়াছড়া লেকের ঝরনার পানি আপনাকে গোসল করতে যেন বাধ্য করবে।

কেউ কেউ রাতের বেলায় চাঁদের আলোয় ঝরনার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে বাওয়াছড়া পাহাড়ের পাদদেশে ক্যাম্পিং করে অবস্থান করছেন। জোছনা রাতের রুপালি আভার সঙ্গে ঝরনার নূপুর ধ্বনি শুনতেই ছুটে আসেন তারা।

মুহুরি সেচ প্রকল্প
চট্টগ্রাম জেলার প্রবেশপথের এই উপজেলার কাছেই রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প মুহুরি প্রকল্প। তবে এটির বেশির ভাগই পড়েছে ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলায়। ফেনী সদর থেকে সোনাগাজী উপজেলা পর্যন্ত দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। সোনাগাজী উপজেলা থেকে ২০ কিলোমিটার। অর্থাৎ ফেনী সদর থেকে মুহুরি প্রকল্পের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার।

একটা সময় ছিল, যখন এই প্রকল্পের স্থানে ছিল দুই মাইল প্রশস্ত নদী। এপার-ওপার ছিল বিচ্ছিন্ন। পরে ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে ফেনী নদী ও মুহুরি নদীর দুই তীরকে সেচসুবিধার আওতায় আনার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গৃহীত পরিকল্পনা মোতাবেক এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। আর সময়ে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের নানা প্রান্তের মানুষদের এটি নিয়ে বেড়েছে আগ্রহ, হয়েছে শিক্ষাসফরের স্থান ও হয়েছে বিনোদনকেন্দ্র।

অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য ছাড়াও এটি দেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ-কেন্দ্র। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ২০০৪ সালে প্রায় সাত কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি ২২৫ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম বায়ুশক্তিচালিত বিদ্যুৎ ইউনিট স্থাপন করে। তা ছাড়া এটিকে দেশের বড় মৎস্য জোনগুলোর একটিও মনে করা হয়।

খৈয়াছড়া ঝরনা
এক অনিন্দ্য সৌন্দর্যের ঝরণা চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত খৈয়াছড়া ঝরনা। সবুজ বনবৃক্ষে আচ্ছাদিত পাহাড়ের গভীরে এই ঝরনা। যেমন সুন্দর এই ঝরনা, তেমনি এর চারপাশের প্রকৃতি।

উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রায় ৪ দশমিক ২ কিমি পূর্বে এই ঝরনা অবস্থিত। ধারণা করা হয়, অনেক বছর আগে থেকে নির্জন পাহাড়ে নীরবে বয়ে চলেছে এই ঝরনা। তবে সবুজ বৃক্ষ, গুল্ম, বনলতার আড়ালে এটি অবিষ্কার হতে সময় লেগেছে প্রায় ৫০ বছরের মতো। আবার অনেকে মনে করছেন পাহাড়ি ঢলের ফলে সৃষ্টি হয়েছে এই ঝরনা।

২০১০ সালে সরকার বারৈয়াঢালা ব্লক থেকে বড়তাকিয়া ব্লকের প্রায় ২৯৩৪ হেক্টর পাহাড়কে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করায় খৈয়াছড়া ঝরনা জাতীয় উদ্যানের আওতাভুক্ত হয়। তা ছাড়া বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের রামগড়-সীতাকুণ্ড-রিজার্ভ ফরেস্টের খৈয়াছড়া ঝরনাকে কেন্দ্র করে ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যার অন্যতম মূল লক্ষ্য হলো খৈয়াছড়া ঝরনার সংরক্ষণ।

খৈয়াছড়া ঝরনায় মোট ৯টি বড় ঝরনার ধাপ রয়েছে। তা ছাড়া রয়েছে অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধাপ। মূল সড়ক থেকে এই ঝরনায় যেতে হলে কিছুটা পথ সিএনজি অটোরিকশায় করে যেতে হয়। বাকিটুকু পাহাড়ি উঁচুনিচু পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয়।

রূপসী ঝরনা
মিরসরাইয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিস্ময় রূপসী ঝরনা। উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের বড়কমলহ এলাকার আঁকাবাঁকা গ্রামীণ সবুজ শ্যামল মেঠো পথ পার হয়ে পাহাড়ের পাদদেশে গেলেই দেখা মিলবে এই ঝরনার।

রূপসী ঝরনা দেখতে যাওয়ার পথে দৃষ্টিনন্দন ছড়া, পাহাড়, সবুজ প্রকৃতি― তিনটি ভিন্ন ভিন্ন অপরূপ ঝরনা রূপসীর সৌন্দর্যকে অন্য ঝরনা থেকে আলাদা করেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ঝরনার মায়াবি রূপ দেখে স্থানীয় লোকজন এই ঝরনার নাম দিয়েছে রূপসী ঝরনা। রূপসী ঝরনার তিনটি ধাপ রয়েছে। বড় কমলদহ ঝরনা, ছাগলকান্দা ও পাথরভাঙ্গা ঝরনা। প্রথম ধাপটা বড় একটি ঝরনার মতো। অনেকটা খাড়া তবে ঢালু।

এখানে বর্ষায় পুরো ঝরনা বেয়ে পানি পড়ে। শুষ্ক মৌসুমে শুধু দক্ষিণ দিকটায়। ভেতরের রূপ আরও বেশি সুন্দর। ওপরে উঠলে খোলা একটা জায়গা। তারপর একটা বড় পাথর। এই পাথরের মাঝ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। দশ ফুটের খাড়া পাথরটি বেয়ে উঠতে পারলেই এবার অন্য রকম এক সৌন্দর্য। বিশাল ছড়া, তবে বেশ আঁকাবাঁকা। ঠিক বয়ে চলা কোনো নদীর মতো।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিনহাজুর রহমান বলেন, মিরসরাইয়ের পর্যটন স্থানগুলোয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আশা করছি ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের জন্য মিরসরাই একটি নান্দনিক পর্যটন এলাকায় পরিণত হবে।

এনএ