কষ থেকে প্রস্তুত রাবার শুকাতে দেওয়া হয়েছে / ছবি- সংগৃহীত

একদিকে দেশে উৎপাদিত রাবার বিক্রির ওপর বড় অঙ্কের ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ, অন্যদিকে আমদানিতে নামমাত্র শুল্ক। সবমিলিয়ে মহাসংকটে দেশীয় রাবার শিল্প। দীর্ঘদিন ধরে চলা এমন সংকটের মধ্যে অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে হাজার হাজার টন রাবার। কেবল বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের আওতায় ১৮টি রাবার বাগানে উৎপাদিত প্রায় দুই হাজার টন রাবার এভাবে পড়ে আছে।

সরকারি হিসাবে, ক্রমপুঞ্জিভূত ওই পরিমাণ রাবার বিক্রি না হওয়ায় তা বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। বেসরকারি পর্যায়ে যা কয়েকগুণ বেশি হবে বলে রাবার বোর্ড ও রাবার-মালিক সূত্রে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে উৎপাদিত রাবার শিট টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রির ওপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক), ৫ শতাংশ আয়কর ও 8 শতাংশ সারচার্জ প্রযোজ্য রয়েছে। অন্যদিকে, আমদানি করা রাবার শিটে মাত্র ৫ শতাংশ শুল্ক বিদ্যমান।

বর্তমানে দেশে উৎপাদিত রাবার শিট টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রির ওপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক), ৫ শতাংশ আয়কর ও 8 শতাংশ সারচার্জ প্রযোজ্য রয়েছে। অন্যদিকে, আমদানি করা রাবার শিটে মাত্র ৫ শতাংশ শুল্ক বিদ্যমান

ফলে একদিকে উৎপাদন খরচ ও সরকার নির্ধারিত করসহ দেশে উৎপাদিত রাবারের মূল্য বেশি হওয়ায় তা অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে থাকছে। মার খাচ্ছেন দেশীয় রাবার উৎপাদনকারীরা। অন্যদিকে, কম শুল্কের কারণে আমদানি নির্ভরতা যেমন বাড়ছে তেমনি রাবার বাগানে কর্মরত হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ছেন।

এমন সংকট থেকে উত্তরণে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) ভ্যাট প্রত্যাহার এবং আমদানি শুল্ক বৃদ্ধিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ রাবার বোর্ড থেকেও মন্ত্রণালয়কে একই বিষয়ে বারবার অবহিত করা হয়েছে।

গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় কষ। সেই কষ শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরি হয় রাবার শিট / ছবি- সংগৃহীত

দেশীয় রাবার শিল্পের এমন সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দা সারওয়ার জাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাবার উৎপাদনে অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। মূলত বাগানের রাবার বিক্রিতে কোনো ভ্যাট-ট্যাক্স নেই। সমস্যা হচ্ছে রাবার শিট হিসেবে যখন এটি বিক্রি করতে যাই তখন প্রায় ২৫ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হয়।

তিনি বলেন, ভ্যাট-ট্যাক্সের কারণে দেশীয় রাবারের বিক্রয়মূল্য বেশি পড়ে। অন্যদিকে, রাবার আমদানির শুল্ক কম হওয়ায় শিল্পোদ্যোক্তারা পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় রাবার বিদেশ থেকে আমদানি করেন। ফলে দেশীয় রাবার অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে।

‘রাবার শিট তৈরিতে শ্রমিকের পারিশ্রমিকসহ উৎপাদন খরচ অনেক বেশি পড়ে। বিক্রয়মূল্যের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় বাগান-মালিকরা রাবার চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এখানে ভ্যাট-ট্যাক্স একটি বড় বিষয়। আর একটি বড় সমস্যা হচ্ছে কৃষিপণ্য হিসেবে রাবারের স্বীকৃতি না পাওয়া। ফলে কৃষিপণ্য হিসেবে প্রণোদনা কিংবা সহজ শর্তে ঋণ নেওয়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চাষিরা। অথচ অন্যান্য দেশে রাবার কৃষিপণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।’

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিম বরাবর পাঠানো চিঠিতে দেশে উৎপাদিত রাবার শিটের ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশ ভ্যাট কমানো এবং আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের অধীনে চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে অবস্থিত ১৮টি রাবার বাগানের ৩২ হাজার ৬২৬ একর জমিতে বছরে প্রায় ছয় হাজার টন রাবার উৎপন্ন হয়। এতে প্রায় পাঁচ হাজার ২৭৭ শ্রমিক কর্মরত। এছাড়া বৃহত্তর সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রায় ৬০ হাজার একর জমিতে বছরে প্রায় নয় হাজার টন প্রাকৃতিক রাবার উৎপন্ন হয়। যার মাধ্যমে দেশের রাবার উৎপাদনের চাহিদা পূরণের চেষ্টা চলছে।

দেশীয় প্রযুক্তিতে স্থানীয় পর্যায়ে কষ থেকে তৈরি হচ্ছে রাবার শিট / ছবি- সংগৃহীত

চিঠিতে আরও বলা হয়, ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে উৎপাদিত রাবার টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রির ওপর এনবিআর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক), ৫ শতাংশ আয়কর এবং 8 শতাংশ সারচার্জ আরোপ করায় দেশের ভেতরে উৎপাদিত রাবার বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। এমনকি অবিক্রিত রাবারের পরিমাণ সরকারি হিসাবে ক্রমপুঞ্জিভূতভাবে প্রায় ২০০০ টনে উন্নীত হয়েছে। যা মূলত বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। পাশের দেশ ভারত পৃথিবীর অন্যতম চারটি রাবার উৎপাদনকারী দেশগুলোর একটি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে কিছু রাবার আগে আমদানি করতো। ভারত রাবার আমদানির ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করায় বাংলাদেশ রাবার রফতানির ক্ষেত্রে ট্যারিফ বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে। অপরদিকে, বাংলাদেশে রাবার আমদানির ক্ষেত্রে মাত্র ৫ শতাংশ শুল্ক ধার্য থাকায় বেসরকারি পর্যায়ের রাবার ব্যবহারকারীরা দেশীয় রাবার আন্তর্জাতিক মানের হওয়া সত্ত্বেও তা ক্রয় না করে আমদানি করা রাবার ব্যবহারে উৎসাহী হচ্ছেন।

২০১৬ সালে অর্থমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিষয়টি উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের লক্ষ্যে তথ্য-উপাত্তসহ তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর নিকট বিষয়টি উপস্থাপন করা হলে তার নির্দেশনায় এনবিআর ২০১৬ সালের ২ জুন রাবার বিক্রির ওপর ১৫ শতাংশ মূসক প্রত্যাহার করে গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করে। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ওই বছরের ৩০ জুন এনবিআর ১৫ শতাংশ মূসক পুনঃআরোপ করে। ফলে বাজারে টিকে থাকা, রফতানিতে গতি আনা এবং এ শিল্পকে লাভজনক ও বেগবান করার ক্ষেত্রে এটি বিশাল অন্তরায় হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ রাবার উৎপাদনে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় দেশ হওয়া সত্ত্বেও উৎপাদিত রাবার বিক্রিতে সৃষ্ট বৈষম্যের কারণে বর্তমানে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ অবস্থার নিরসন না হলে সম্ভাবনাময় রাবার শিল্প ক্রমশ ঝুঁকিতে পড়বে।

এর আগেও একই বিষয়ে কয়েকবার চিঠি দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে সেখানে আরও বলা হয়, রাবার উৎপাদনের ব্যয়ভার ও লোকসান বিবেচনায় এর উৎপাদনে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে যাচ্ছে। নতুন রাবার বাগান তৈরি, বিদ্যমান রাবার বাগানের উন্নয়নে উন্নত মানের নতুন রাবার গাছ লাগানো এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদি কার্যক্রমে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে উঠেছে। হাজার হাজার শ্রমিক রাবার চাষে কর্মরত। সম্প্রতি তাদের মজুরিও সরকার কর্তৃক প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। ফলে রাবার বিক্রি অলাভজনক হওয়ায় তাদের বর্ধিত মজুরি স্কেল প্রদান করাও দুরূহ হয়ে পড়েছে।

এ অবস্থায় দেশে উৎপাদিত রাবার বিক্রির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ মূসক, ৫ শতাংশ আয়কর ও ৪ শতাংশ সেবা চার্জ প্রত্যাহার এবং রাবার আমদানির শুল্ক বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুনরায় অনুরোধ করা হয় ওই চিঠিতে।

আমদানি করা রাবার শিটে মাত্র ৫ শতাংশ শুল্ক বিদ্যমান থাকায় মার খাচ্ছে দেশীয় এ পণ্য / ছবি- সংগৃহীত

এদিকে, বেসরকারি পর্যায়ে রাবার উৎপাদন ও বিক্রিতে প্রায় একই সমস্যার কথা পুনরাবৃত্তি করে রাবার মালিক সমিতির সভাপতি মো. কামালউদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেসরকারি পর্যায়ে ১৩২৭টি রাবার বাগান রয়েছে। যেখানে প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ হাজার টন রাবার উৎপাদন হয়। অথচ দেশেই রাবারের চাহিদা রয়েছে ৩০ হাজার টনের বেশি। এরপরও রাবার বিক্রির পদে পদে বাঁধা সৃষ্টি করে এ শিল্পকে সংকটের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, সমস্যা দুটো। একদিকে বিদেশ থেকে স্বল্প মূল্যে রাবার দেশে আসছে, অন্যদিকে দেশীর রাবার বিক্রির ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে। ২০১০ সালের আগে এটি (ভ্যাট-ট্যাক্স) ছিল না। ২০১৬ সালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ভ্যাট-ট্যাক্স প্রত্যাহারে চিঠি দেন। এরপরও তা প্রত্যাহার হয়নি। বর্তমানে রাবার আমদানিতে মাত্র ৫ শতাংশ শুল্ক বলবৎ রয়েছে। আমাদের দাবি তা বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হোক। পাশের দেশ ভারতেও দেশীয় রাবার শিল্প রক্ষায় এমন শুল্ক বিদ্যমান রয়েছে। এজন্য আমরা দুটো বিষয়েই সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।

রাবারকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়ে কামালউদ্দিন বলেন, কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকায় রাবার নেই। এ কারণে ঋণ ও প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধাও পাচ্ছি না। রাবারকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা আমাদের অন্যতম প্রধান দাবি।

আরএম/এমএআর/