শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুদের কানে শোনা এবং কথা বলার সর্বাধুনিক চিকিৎসা কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট। কথা বলতে পারে না, কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট প্রয়োজন অথচ পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে দেশের প্রায় ৯৪ শতাংশ শিশু এ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। মাত্র ৬ শতাংশ শিশু সরকারি ও বেসরকারিপর্যায়ে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে শ্রবণ ও বাকশক্তি ফিরে পাচ্ছে।

কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট হলো বিশেষ এক ধরনের যন্ত্র, যা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মানুষ তার শোনার ক্ষমতা ফিরে পেতে পারে। বিশ্বে এখন পর্যন্ত যতগুলো ডিভাইস আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম, সর্বাধুনিক ও ব্যয়বহুল ডিভাইস হলো কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট। সহজভাবে বোঝার জন্য এটিকে আর্টিফিশিয়াল (মনুষ্যনির্মিত) কানও বলা যায়

ঢাকা পোস্টকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের হেড-নেক ও কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জন অধ্যাপক ডা. মো. জাকারিয়া সরকার এমন তথ্য জানান। কীভাবে এ সেবা গ্রহণ করা সম্ভব এবং শ্রবণপ্রতিবন্ধী সব শিশুকে কীভাবে এ সেবার আওতায় আনা যায়— সেসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন তানভীরুল ইসলাম।

ঢাকা পোস্ট : কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট কী? কাদের কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের প্রয়োজন হয়?

ডা. মো. জাকারিয়া সরকার : কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট হলো বিশেষ এক ধরনের যন্ত্র, যা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মানুষ তার শোনার ক্ষমতা ফিরে পেতে পারে। বিশ্বে এখন পর্যন্ত যতগুলো ডিভাইস আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম, সর্বাধুনিক ও ব্যয়বহুল ডিভাইস হলো কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট। সহজভাবে বোঝার জন্য এটিকে আমরা আর্টিফিশিয়াল (মনুষ্যনির্মিত) কানও বলে থাকি। ডিভাইসটি তাদের জন্যই প্রযোজ্য যারা জন্মগতভাবে বধির বা কানে শোনে না। যাদের আমরা শ্রবণ বা বাকপ্রতিবন্ধী, সমাজের বোঝো হিসেবে বিবেচিত করি।

কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী ২১৫ শিশু স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে / ছবি- ঢাকা পোস্ট

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি বাচ্চা একাধারে কানেও শোনে না, কথাও বলে না। আসলে বিষয়টি কিন্তু সে রকম নয়। সে কথা বলতে পারে। সে যখন বাবা-মা-মামা বলতে চেষ্টা করে বা কান্নাকাটি করে, তখন কিন্তু এক ধরনের শব্দ উচ্চারণ করে। কোনো শব্দের যখন কোনো অর্থ থাকে, তখন সেটাকে আমরা ‘কথা’ বলি। যেহেতু কথা বলতে না পারা শিশুটি যখন কোনো শব্দ উচ্চারণ করে, সেই শব্দের কোনো অর্থ আমাদের কাছে বিবেচিত হয় না, তখন আমরা ধারণা করি শিশুটি কথা বলতে পারে না, বোবা। আসলে কিন্তু সে বোবা নয়। তার মুখ থেকে বের হওয়া শব্দের কোনো অর্থ না থাকার মানে হচ্ছে, সে কোনোদিন কোনো কথা শুনতে পায়নি। যেহেতু সে কানে শোনে না, সেহেতু তার মস্তিষ্কে কোনো শব্দ পৌঁছে না। ফলে কোনো অর্থযুক্ত শব্দ সে উচ্চারণ করতে পারে না।

শিশুটি যদি কোনোদিন শুনতে পারত যে এটার নাম মোবাইল, ওটার নাম বই, এটা টেবিল আর ওটা চেয়ার; তাহলে সে ঠিক মতোই সেগুলো উচ্চারণ করতে পারত। অর্থাৎ কানে না শোনার কারণেই সে বোবা। তার মানে, যদি আমি কোনোভাবে তার মস্তিষ্কে শব্দ পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে সে শুনতে পারবে এবং একসময় সে অর্থযুক্ত শব্দের মাধ্যমে কথা বলতে পারবে। এসব বাক ও শ্রবণহীন বাচ্চাদের শব্দের জগতে ফিরিয়ে আনার জন্যই আবিষ্কৃত হয়েছে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট যন্ত্রটি। এর কাজ হচ্ছে কানের স্বাভাবিক শ্রবণশক্তিকে বাইপাস করে আর্টিফিশিয়াল যন্ত্রের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে দেওয়া।

জন্মগতভাবে যাদের কানে শোনা বা মুখে বলার ক্ষমতা নেই, তাদের আর্টিফিশিয়াল এ ডিভাইসের মাধ্যমে মস্তিষ্কে শব্দ পৌঁছে দিয়ে কানে শোনার ব্যবস্থা করা হয়। ডিভাইসটির তিনটি অংশ থাকে। একটি মস্তিষ্কের ভেতরে যা কানেরই একটি অংশ। সেখানে তারের মতো একটি বস্তু আমরা ঢুকিয়ে দিই। আরেকটি কানের পেছনে চামড়ার নিচে থাকে। অপর অংশটি থাকে কানের ওপরে, যা বাইরে দৃশ্যমান।

ঢাকা পোস্ট : কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করার কতদিন পর একটি শিশু তার শ্রবণ ও বাকশক্তি ফিরে পেতে পারে?

ডা. মো. জাকারিয়া সরকার : কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট অপারেশনটি সাধারণ অপারেশনের মতো নয়। অন্য অপারেশনের ক্ষেত্রে কিছুদিন পর ওই রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যান। কিন্তু কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট অপারেশনের রোগীরা লাইফ লং পেশেন্ট (আজীবন রোগী)। যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন কানে শুনতে হলে তাকে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট ডিভাইসটি নিয়েই বাঁচতে হবে।

কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট হলো বিশেষ এক ধরনের যন্ত্র, যা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে শিশু তার শ্রবণশক্তি ফিরে পেতে পারে / ফাইল ছবি

আরেকটি বিষয় হলো, এ অপারেশনের পর বাচ্চাদের আমাদের সঙ্গে প্রায় এক বছর কাটাতে হয়। আমাদের অধীনে একটি স্কুল আছে, সেখানে তাদের এবং তাদের মায়েদের পড়াশোনা করতে হয়। যেদিন বাচ্চার কানে আমরা মেশিনটি লাগায় তার ২১ দিন পর আমরা সুইচটি অন করে দিই। এটি অন করার পর প্রথমবারের মতো বাচ্চার কানে শব্দ পৌঁছায়। প্রথমবারের মতো সে শব্দের জগতে প্রবেশ করে।

একটি বাচ্চা প্রথমবারের মতো যখন শব্দের জগতে প্রবেশ করে, সঙ্গে সঙ্গেই সে কিন্তু কথা বলতে পারে না। স্বাভাবিকভাবে কানে শুনতে পারা বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও আমরা দেখি যে জন্মের পরপরই সে কথা বলতে পারে না। প্রায় দেড় থেকে দুই বছর সময় নেয়। এরপর কথা বলতে শুরু করে। কারণ, পুরো সময়টা তার মস্তিষ্কে শব্দগুলো জমা হয়। একটা পর্যায়ে যখন মস্তিষ্কে তার শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হয়, তখন সে কথা বলতে শুরু করে।

কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টে বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়। সুইচ অন করার পর যখন প্রথম তার কানে শব্দ পৌঁছায় তখনই কিন্তু সে কথা বলে না। তাকে এক বছর আমাদের কাছে রেখে সেই শিক্ষাটা দিতে হয়, মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত শব্দ জমা করতে হয়, একপর্যায়ে ধীরে ধীরে কথা বলায় তাকে অভ্যস্ত করতে হয়। এভাবে একটা সময় সে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।

ঢাকা পোস্ট : শ্রবণ ও বাকশক্তিহীনতা কেন হয়?

ডা. মো. জাকারিয়া সরকার : কানের সাধারণত তিনটি অংশ থাকে। এক. বহিঃকর্ণ, দুই. অন্তঃকর্ণ এবং তিন. মধ্য কর্ণ। কানের প্রত্যেকটা অংশই গুরুত্বপূর্ণ। অন্তঃকর্ণের সমস্যার কারণে বাচ্চারা শুনতে পারে না বা কথা বলতে পারে না। মাতৃগর্ভে থাকাকালীন মূলত কানে না শোনার সমস্যা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জন্মের সময় এটি হয়।

গর্ভাবস্থায় বধিরতার কারণগুলো হলো- ওই সময় যদি মায়ের কোনো ধরনের ভাইরাস ইনফেকশন হয়, যেমন- রুবেলা, মার্স ভাইরাসসহ বেশকিছু ভাইরাস আছে; এগুলোর সংক্রমণ হলে বাচ্চার অন্তঃকর্ণের বিশেষ অংশটা নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া অ্যাক্সিডেন্ট (দুর্ঘটনা), ট্রমা (মানসিক আঘাত) এমনকি বাইরের দূষণেও এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।

কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট পরবর্তী শিশুদের নিয়ে স্কুলিংয়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে কথা বলতে শেখানো হয় / ছবি- ঢাকা পোস্ট

আবার মায়েদের অনেকেই আছেন যারা স্মোকিং ও ড্রাগ নেন। এ কারণে গর্ভকালীন আমরা মায়েদের ড্রাগ রেস্ট্রিক্টেড করে দিই। কিন্তু ভুলবশত কোনো মা গর্ভকালীন এসব ড্রাগ বা মাদক ব্যবহার করলে বাচ্চার কানের শ্রবণক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

আর জন্মের সময় যদি ফোর্স ডেলিভারি করা হয়, যদি ট্রমা হয় বা অনেকক্ষণ যদি মা ব্যথা নিয়ে থাকেন তাহলে শিশুর শ্রবণশক্তি হ্রাস পেতে পারে। এছাড়া ডেলিভারি যদি দীর্ঘ সময় ধরে হয়, সে ক্ষেত্রে অনেক সময় বাচ্চাটা অক্সিজেন পায় না, ফলে তার শ্রবণশক্তি হ্রাস পেতে পারে।

আমরা প্রায়ই দেখি, অনেকেরই প্রিম্যাচিউরড (অকালপক্ক) বেবি হয়, অল্প ওজন নিয়ে তারা জন্মগ্রহণ করে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো কানেরও ডেভেলপমেন্ট হয় না। আবার কিছু বাচ্চার জন্মের পরই জন্ডিস, নিউমোনিয়া হয়। বিশেষ করে মেনিনজাইটিস (মস্তিষ্ক-ঝিল্লীর প্রদাহ) অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়। ফলে ব্রেন ইনফেকশন হয় এবং ব্রেনে যে কানের অংশ আছে সেটি নষ্ট হয়ে যায়।

এছাড়া কিছু সামাজিক কারণ রয়েছে, যেগুলোকে আমরা খুব বেশি গুরুত্ব দিই না। যেমন : আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিয়ে হওয়া। মামাত, খালাত, ফুফাত ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে হওয়া আমাদের সমাজে খুবই কমন একটি বিষয়। রক্তের সম্পর্ক আছে এমন আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিয়ের ক্ষেত্রে সন্তানের এমন সমস্যা খুবই কমন। তাই আমরা সবসময় বলি, যতটুকু সম্ভব যেন এ সম্পর্কটা এড়িয়ে চলা।

ঢাকা পোস্ট : আমাদের দেশে বাক বা শ্রবণহীন হয়ে জন্ম নেওয়া শিশুর হার কেমন?

ডা. মো. জাকারিয়া সরকার : ডেভেলপিং কান্ট্রি বা তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে এ অঞ্চলে বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় বধিরতা রোগের হারটা অনেক বেশি। একটা গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে বিভিন্ন মাত্রার ০.৯ শতাংশ মানুষের বধিরতা আছে। তবে সবমাত্রার জন্য আবার কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট প্রয়োজন হয় না।

আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় আড়াই হাজার শিশু বধিরতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে যাদের কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট প্রয়োজন। সমসংখ্যক মানুষও এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে, যারা স্বাভাবিক জন্মক্ষমতা নিয়ে জন্মালেও নানা কারণে শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলছে। তাদেরও কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের প্রয়োজন।

ঢাকা পোস্ট : বয়স্কদের ক্ষেত্রেও অনেক সময় বধিরতা দেখা যায়। তাদের ক্ষেত্রেও কি কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের প্রয়োজন?

ডা. মো. জাকারিয়া সরকার : বয়স্করাও নানা কারণে বধির হয়ে থাকেন। তাদেরও কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের প্রয়োজন হয়। স্বাভাবিকভাবে জীবন-যাপন করা একজন মানুষ হঠাৎ করে তার শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলতে পারেন। এক্ষেত্রে কিছু কিছু রোগ আছে যেগুলো শ্রবণশক্তিকে সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ভাইরাল ফিভার (ভাইরাসজনিত জ্বর)। এমনও হয় যে একজন লোক স্বাভাবিক শ্রবণশক্তি নিয়ে ঘুমাতে গেলেন, ভাইরাল ফিভারে পরদিন সকালে উঠে দেখতে পেলেন কানে শুনতে পারছেন না। শব্দজগৎ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন তিনি।

অনেক সময় ট্রমা হয়। ড্রাগ গ্রহণের কারণেও বয়স্কদের শ্রবণশক্তি লোপ পেতে পারে। সবমিলিয়ে স্বাভাবিক শ্রবণক্ষমতা নিয়ে জন্মায়, তাদের বিশাল একটি সংখ্যা বধির হয়ে যাচ্ছেন। আমরা তাদের কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে শব্দজগতে আবারও ফিরিয়ে আনি। দেখা যায়, প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক মানুষ বধিরতার জগতে প্রবেশ করেন। যাদের একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জারি।

ঢাকা পোস্ট : সরকারি বা বেসরকারিপর্যায়ে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের খরচ কেমন?

ডা. মো. জাকারিয়া সরকার : কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জারি অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা। কারণ, এটি খুবই সংবেদনশীল একটি অপারেশন। এর ডিভাইসটিও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তিনটি দেশ এ ডিভাইস তৈরি করে। অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশপ্রাপ্ত এ তিন দেশের কক্লিয়ার আমরা ব্যবহার করি। সাধারণ বাজারে প্রতিটির সর্বনিম্ন মূল্য সাত থেকে আট লাখ টাকা। ২৫ লাখ টাকা মূল্যের ডিভাইসও আছে।

যেহেতু আমরা সরকারি ব্যবস্থাপনায় ডিভাইসটি কিনে থাকি, সেহেতু খরচটাও আমাদের জন্য সহনীয় পর্যায়ে থাকে। সরকারিভাবে কেনা মূল্যেই রোগীদের ডিভাইসটি সরবরাহ করি। সরকারি ব্যবস্থাপনায় আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অপারেশন, অপারেশন পরবর্তী স্কুলিংসহ সব সেবা দিয়ে থাকি। এক্ষেত্রে আমাদের কিছু স্পেশাল সাপোর্ট ও জনবলের প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে  কার্ডিওলজি বিভাগ, অফথালমোলজি বিভাগ, সাইকোলজি বিভাগের সাপোর্ট লাগে। এগুলো আমাদের অন্যান্য হাসপাতাল থেকে নিতে হয়। এক্ষেত্রে কিছু খরচ হয় যা রোগীকে বহন করতে হয়। সবমিলিয়ে এ চিকিৎসায় কিছু খরচ তো রোগীদের বহন করতেই হয়। সেটিও রোগীর পরিবারের আয়-সাপেক্ষে হয়ে থাকে।

ঢাকা পোস্ট : জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা আছে কি না? সবাই কি এখানে সেবা নিতে পারেন?

ডা. মো. জাকারিয়া সরকার : সরকারি ব্যবস্থাপনায় কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করার ক্ষেত্রে আমাদের একটি নীতিমালা আছে। অনেক সময় দেখা যায় যে সরকারিভাবে ১০০টি ডিভাইস আমাদের জন্য বরাদ্দ আছে, সেখানে বধির বাচ্চা রয়েছে ১৫০টি। এক্ষেত্রে বাকি বাচ্চারা কোথায় যাবে? আমাদের সীমাবদ্ধতার কারণে সরকারিভাবে যারা ডিভাইসটি পান না, আমরা তাদের বলি যে আপনারা যদি ডিভাইসটি নিজ খরচে কিনে দেন, আমরা সরকারি ব্যবস্থাপনায় বাকি কাজটা করে দেব। এটা কিন্তু তাদের জন্য অনেকটা সহায়ক হয়ে থাকে।

ঢাকা পোস্ট : সরকারি অর্থায়নে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের ক্ষেত্রে বয়সের কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কি না?

ডা. মো. জাকারিয়া সরকার : আমরা আসলে বলে থাকি যে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত সরকারি অর্থায়নে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করা যায়। কারণ, পাঁচ বছরের অধিক বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা অনেকটা কমে আসে। আমাদের কাছে তো প্রতিনিয়ত বাচ্চা আসছে, কিন্তু আমাদের পর্যাপ্ত ডিভাইস নেই। সেক্ষেত্রে বয়সের কারণে সরকারি তালিকায় না আসা এবং ডিভাইস স্বল্পতায় বাদ পড়া শিশুদের জন্য আমরা আরেকটি সুযোগ রেখেছি। তারা যদি ডিভাইসটি কিনে দেন তাহলে সরকারি খরচে আমরা সেটা লাগিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি।

ঢাকা পোস্ট : বরাদ্দ কম থাকায় প্রতি বছর কত সংখ্যক শিশুকে সরকারি অর্থায়নে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না…

ডা. মো. জাকারিয়া সরকার : সরকারি ব্যবস্থাপনায় কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করা সম্ভব হচ্ছে না— এমন শিশুর সংখ্যা কিন্তু দিন দিন বাড়ছে। আমরা দেখেছি প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার বাক বা শ্রবণহীন শিশুর কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরকারিপর্যায়ে সারাদেশের সবগুলো হাসপাতাল মিলিয়ে সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ২৫০ বাচ্চাকে আমরা ডিভাইস দিতে পারছি। সুতরাং বাকি যে জনগোষ্ঠী, তারা স্বাভাবিকভাবেই এ সেবার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

এক্ষেত্রে অনেকেই হয়তো এ চিকিৎসা সম্পর্কে অসচেতন। কিন্তু এখন যেহেতু ধীরে ধীরে এর প্রচার বাড়ছে, রোগীর ভিড়ও বাড়ছে। যেহেতু আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তাই সক্ষমতা আছে এমন একটি অংশকে নিজ দায়িত্বে, নিজ খরচেই চিকিৎসা নিতে হবে। কারণ, এত রোগীকে সরকারি অর্থায়নে চিকিৎসার অধীনে আনা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই যার আর্থিক সক্ষমতা আছে, তিনি যদি ডিভাইসটি কিনে দেন, আমরা সার্জারি করে দিতে পারব।

ঢাকা পোস্ট : জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটে বধিরতার চিকিৎসা ও কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সেবা দেওয়া প্রসঙ্গে যদি আরও কিছু বলতেন…

ডা. মো. জাকারিয়া সরকার : নাক কান গলা ইনস্টিটিউটে বধিরতার চিকিৎসা খুবই উন্নত মানের। এখানকার কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জারি আমাদের জন্য একটি প্রেস্টিজিয়াস (মর্যাদাপূর্ণ) বিষয়। আমরা ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতায় এটি বাস্তবায়ন করছি। সরকারিপর্যায়ে আমরাই প্রথম প্রতিষ্ঠান যারা কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করছি। সরকার আমাদের কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। গত তিন বছরে এ হাসপাতালে প্রায় ২১৫টি সফল কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জারি হয়েছে।

আমরা মনে করি, অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতাল থেকেও আমরা অনেক ভালো সাপোর্ট দিচ্ছি। আমাদের সফলতার কারণ হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আমি যেটা মনে করি, আমরা আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে এবং কারিকুলাম মেইনটেইন করে প্রতিটি বাচ্চাকে সঠিক উপায়ে যাচাই-বাছাই করি। কারণ, এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ফল পেতে হলে বাচ্চাদের যাচাই-বাছাইটা খুবই জরুরি। যদি সঠিক বাচ্চা বাছাই করা না যায়, সেক্ষেত্রে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অবস্থিত জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউট / ছবি- ঢাকা পোস্ট

আমরা এখন পর্যন্ত ২১৫টি কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করেছি। প্রতিটি বাচ্চার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। কোনো বাচ্চাকে আমরা হারিয়ে যেতে দিইনি। বাস্তবতা হলো, কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট চিকিৎসায় ‘ড্রপ আউট’ (হারিয়ে যাওয়া) সারাবিশ্বের একটি বড় সমস্যা। ধরুন, একটি বাচ্চাকে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করা হলো, এরপর দেখা গেল যে তিন অথবা ছয় মাস পর তার আর কোনো খোঁজ নেই। ওই বাচ্চার ক্ষেত্রে কিন্তু ভালো ফলটা পাওয়া যাবে না।

এক্ষেত্রে আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। সেটি হলো- অপারেশন যেহেতু মস্তিষ্কে করতে হয়, সেক্ষেত্রে ইনফেকশন (সংক্রমণ) হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দেশের বাইরে আমরা দেখেছি, প্রচুর সংখ্যক বাচ্চার ইনফেকশন হয়। এমনকি একসময় বাধ্য হয়ে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টটি খুলে ফেলতে হয়। এ কারণে শুরু থেকেই আমরা বিষয়টির ওপর অত্যন্ত জোর দিয়েছি।

আমার টিমের বড় সফলতা হলো, যে ২১৫টি শিশুর কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করেছি, কারোরই ইনফেকশন হয়নি। এটি আমাদের জন্য বিশাল এক সফলতা।

ঢাকা পোস্ট : সারাবিশ্বে যেখানে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের বিষয়ে ঝুঁকির মাত্রা বেশ, সেখানে আপনারা কীভাবে শতভাগ সফল হচ্ছেন?

ডা. মো. জাকারিয়া সরকার : যেকোনো কাজে সফলতা অর্জনের প্রথম শর্ত হলো- ওই বিষয়ের ওপর পর্যাপ্ত স্টাডি ও রিসার্চ ওয়ার্ক করা। এটিই বলে দেবে যে আপনি এ কাজে কতটুকু সফল হবেন। গত দুই বছরে আমরা বাচ্চাদের ওপর দুটি স্টাডি করেছি। প্রথমত, আমরা ৪০টি বাচ্চাকে নিয়ে একটি স্টাডি করেছি, যা আন্তর্জাতিক একাধিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া গত বছর সরকারি অর্থায়নে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনায় ১০০টি বাচ্চার ওপর আরেকটি স্টাডি করেছি। এর মাধ্যমে আমরা দেখেছি যে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের পর বাচ্চাদের কথা বলার সক্ষমতা কতটুকু ডেভেলপ (বিকাশ/উন্নয়ন) করেছে। কত শতাংশ বাচ্চা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছে।

আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে তুলনা করার মতো আমাদের যে স্টাডি দরকার, সেটি আমরা অর্জন করেছি।

জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের হেড-নেক ও কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জন অধ্যাপক ডা. মো. জাকারিয়া সরকার / ছবি- ঢাকা পোস্ট

কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জারিতে যদিও আমাদের জনবলের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তারপরও যথার্থ টেকনিক্যাল সাপোর্ট আমরা পাচ্ছি। এ বিষয়ে ১৫ থেকে ২০ জন নার্সকে আমরা বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এনেছি। তারাই আমাদের টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে আমাদের সফলতার অন্যতম কারণ হলো, আমাদের টিমের ডেডিকেশন, একাডেমিক স্টাডি এবং যথাযথ রিসার্চ-ওয়ার্ক।

ঢাকা পোস্ট : বাক-শ্রবণহীন বাচ্চারা প্রায়ই সমাজে নিগ্রহের শিকার হয়। অনেক সময় মাকেও তার সন্তানকে নিয়ে নানা ধরনের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য শুনতে হয়। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাচ্ছি…

ডা. মো. জাকারিয়া সরকার : আমরা তো সামাজিকভাবে অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের মফস্বল এলাকাগুলোতে বধিরতা নিয়ে মানুষ এখনও বেশ অসচেতন। একই সঙ্গে অপচিকিৎসা এবং বিষয়টি ছোট করে দেখার মানসিকতাও রয়েছে। উন্নত দেশে যখন একটি শিশু জন্মায় তখনই স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে তার কানে কোনো সমস্যা আছে কি না, সেটি দেখা হয়। আমাদের দেশে এখনও এটি শুরু করা যায়নি।

আমাদের দেশে যখন একটি বাচ্চার বয়স বাড়তে থাকে, যখন সে কথা বলে বা কোনো কিছুর শব্দে ভয়ে কেঁপে ওঠে, তখন আমরা বুঝতে পারি সে স্বাভাবিক রয়েছে। বিষয়গুলো মায়েরাই সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারেন। যদি কোনো বাচ্চা ছোটবেলা থেকে কথা বলতে না পারে, বিষয়টি নিয়ে মায়েরা যখন তাদের অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তখন তারা বলেন এটা কোনো সমস্যা নয়, আরেকটু বড় হলে নিশ্চয়ই কথা বলবে। তোমার স্বামী, শ্বশুরও দেরিতে কথা বলেছে। সুতরাং চিন্তা করো না— এসব বলেই কিন্তু ওই মাকে আশ্বস্ত করা হয়।

বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে যেভাবে কাজ করে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট / ছবি- ঢাকা পোস্ট

পরবর্তীতে ওই শিশু যখন কথা বলতে পারে না, তখন কিন্তু এর সম্পূর্ণ দায় মায়ের ওপর দেওয়া হয়। তাকে পাপী, অপয়া বলেও সম্বোধন করা হয়। এমনকি তাকে অভিশপ্ত হিসেবে সমাজে পরিচিত করানো হয়। চিকিৎসক হিসেবে আমরা যেহেতু এটা নিয়ে কাজ করি, আমাদের কাছে প্রচুর মায়েরা আসেন যারা সমাজে এমন সন্তানের জন্য অবহেলিত ও নিগৃহীত হন। অনেকের সংসারও ভেঙে যায়।

সুতরাং, এক্ষেত্রে সবার জন্য আমাদের বার্তা হলো- যখনই মনে হবে বা সন্দেহ হবে যে বাচ্চা কানে শোনে না, সময় মতো কথা বলছে না, তখন অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এখন গ্রামগঞ্জে অহরহ কানের পরীক্ষা হচ্ছে। সেখানে না হলে উপজেলা বা জেলাপর্যায়ের হাসপাতালে এসে বা কোনো প্রাইভেট ক্লিনিকে গিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে। যখনই জানা যাবে তার কানে সমস্যা রয়েছে, তখনই কিন্তু চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

মনে রাখতে হবে, এ চিকিৎসার জন্য বয়স একটা বড় ফ্যাক্টর। কারণ, সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট ভালোভাবে কাজ করে। পাঁচ বছরের বেশি হলে খুব একটা ভালো রেজাল্ট আশা করা যায় না।

টিআই/এমএআর/এমএইচএস