দুই দফা প্রাণঘাতী করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে দেশের পোশাক খাত। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানসহ বিশ্ববিখ্যাত বায়াররা আবার নতুন করে বাংলাদেশে ফিরছেন। পোশাক রফতানির ক্রয়াদেশ বাতিল কিংবা স্থগিতের যে শঙ্কা ছিল তার অবসান হয়েছে। নতুন করে হাজার হাজার কোটি টাকার পোশাক রফতানির অর্ডার আসছে।

এ অবস্থায় করোনার পাশাপাশি বিভিন্ন কারণে বন্ধ থাকা কিংবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রমে থাকা শত শত পোশাক কারখানা আবারও চালু হয়েছে। সচল থাকা কারখানাগুলো আরও উজ্জীবিত হচ্ছে। চাকরি হারানোর শঙ্কায় থাকা পোশাক শ্রমিকদের এখন কদর বেড়েছে।

বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে সুষ্ঠু ও সুন্দর কর্মপরিবেশ বিরাজ করছে বলে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) স্বীকৃতি দিয়েছে। এছাড়া সবুজ কারখানা গড়ে তোলায় ১৫২টি প্রতিষ্ঠান সনদও লাভ করেছে। ফলে বলা যায়, বিদায়ী বছর পোশাক খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর বছর।

তবে এ বছর নতুন কিছু চ্যালেঞ্জেরও মুখোমুখি হতে হয়েছে পোশাক খাতকে। বিশ্ববাজারে সুতার দাম বৃদ্ধি এবং জাহাজীকরণের মাধ্যমে ইউরোপে পণ্য রফতানির মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া চীনের পণ্য সংকুচিতকরণ নীতি পোশাক খাতকে বেশ সমস্যার মধ্যে ফেলেছে।

করোনার ধাক্কা কাটিয়ে নতুন করে হাজার হাজার কোটি টাকার পোশাক রফতানির অর্ডার আসছে / ফাইল ছবি

বছরের শুরুতে করোনার থাবা

শিল্প পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে প্রায় সাত শতাধিক কারাখানা বন্ধ হয়ে যায়। এ সময়ের মধ্যেই শুরু হয় দ্বিতীয় দফায় করোনাভাইরাসের থাবা। সেই থাবা থেকে রক্ষায় সরকার বেশ কিছুদিন অফিস-আদালত, কল-কারখানা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখে।

কল-কারখানা বন্ধ থাকায় ইউরোপ-আমেরিকান বায়াররা পাশের দেশ ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামে যেতে শুরু করেন। বাংলাদেশের সঙ্গে পোশাক রফতানির ক্রয়াদেশ স্থগিত, এমনকি বাতিল করতে শুরু করেন তারা।

এমন পরিস্থিতিতে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, নিটওয়্যার মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএসহ পোশাক খাতের পাঁচটি সংগঠনের নেতারা কারখানা চালু রাখতে ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের কাছে তদবির শুরু করেন। সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে পোশাক খাত চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।

ঈদ আনন্দ ফিকে হয় ফিরে আসার ভোগান্তিতে

বিদায়ী বছরে দুই ঈদের আগের ও পরের কয়েকদিন কারখানা বন্ধ রাখা হয়। ওই সময় বাড়ি যেতে নিষেধ করা হলেও প্রতিবারের ন্যায় স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে গ্রামের বাড়িতে যান পোশাক শ্রমিকরা। কিন্তু ছুটি শেষে কর্মস্থলে আসার সময় পড়েন চরম ভোগান্তিতে। কঠোর বিধিনিষেধ থাকায় বাস, ট্রেন ও লঞ্চ ছিল বন্ধ। ফলে দ্বিগুণ-তিনগুণের বেশি ভাড়া গুনে পণ্যবাহী ট্রাক, ভ্যান, রিকশায় চড়ে এমনকি পায়ে হেঁটে কর্মস্থলে ফেরেন তারা।

পোশাক শিল্পে সবুজ বিপ্লবে অবদান রাখায় দেশের ১৫২টি কারখানাকে ‘লিড প্লাটিনাম’ সনদে ভূষিত করেছে ইউএসজিবিসি / ফাইল ছবি

হারানো অবস্থান পুনরুদ্ধার

করোনার সময় কিছুদিন কারখানা বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে বায়ারদের অর্ডার আসা কমে যায়। তারা ভিয়েতনামে চলে যেতে থাকেন। ফলে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে ভিয়েতনাম। তবে তিন মাসের ব্যবধানে ভিয়েতনামকে পেছনে ফেলে গত সেপ্টেম্বরে আবারও পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে বাংলাদেশ।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ১১ মাসে তিন হাজার ১৭৬ কোটি ৭৩ লাখ ৭ হাজার টাকার পোশাক রফতানি হয়েছে। ২০২০ সালের একই সময়ে ছিল দুই হাজার ৪৮১ কোটি ৯৮ লাখ ৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর ৬৯৪ কোটি ৭৫ লাখ ১ হাজার টাকার রফতানি আয় বেশি হয়েছে। নিটওয়্যার ও ওভেন খাত থেকে এ রফতানি আয় হয়েছে।

পোশাক খাতের প্রতি ইতিবাচক আইএলও

দেশের পোশাক শিল্পে নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি ও সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স প্রতিপালনে অগ্রগতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পোটিআইনেন। বিদায়ী বছরের ২৩ মে তিনি বিষয়টি ‘প্রশংসাযোগ্য’ বলে মত দেন। শিল্পের উন্নয়ন, বিশেষ করে শ্রমিকদের কল্যাণে আইএলও কাজ করছে।

নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি ও সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স প্রতিপালনের অগ্রগতি ‘প্রশংসাযোগ্য’— বলছে আইএলও / ফাইল ছবি

জার্মানির কিক প্রত্যাবর্তন ও টিকা সহায়তা

রানা প্লাজার দুর্ঘটনাসহ বেশকিছু কারণে বিখ্যাত জার্মান ব্র্যান্ড কিক (কেআইকে) বাংলাদেশের পোশাক খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। প্রতিষ্ঠানটি আবারও ফিরে এসেছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের সুরক্ষা দিতে করোনার টিকা কিনতে অনুদান দেয়।

কিক-এর সিইও প্যাট্রিক যাহন ওই সময় বলেন, আমাদের বহু বছরের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার ফল হিসেবে আমরা দেশটিতে, বিশেষ করে এ দেশের পোশাক শিল্পে করোনা মহামারির প্রভাব নিয়ে অত্যন্ত সচেতন। এ শিল্পের কর্মীরা আবদ্ধ স্থানে (ইনডোর) কাজ করে, যেখানে সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। আমি মনে করি, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় টিকা সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা দিতে পারে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের এ অনুদান দিয়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের কর্মীদের করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সবচেয়ে ভালো পন্থায় সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব।

লিড প্লাটিনাম সনদ

পোশাক শিল্পে সবুজ বিপ্লবে অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশের ১৫২টি কারখানাকে ‘লিড প্লাটিনাম’ সনদে ভূষিত করেছে ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি)। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এ সনদ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। আরও ৫০০ কারখানা সবুজ সনদ পাওয়ার অপেক্ষায়।

বিশ্ববাজারে সুতার দাম বৃদ্ধি সংকটে ফেলতে পারে দেশের পোশাক খাতকে / ফাইল ছবি

পরিবেশবান্ধব কারখানার বিচারে বিশ্বের সেরা ১০ কারখানার মধ্যে সাতটি বাংলাদেশের। এগুলো হলো- এনভয় টেক্সটাইল, রেমি হোল্ডিংস, প্লামি ফ্যাশনস, ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও, এসকিউ সেলসিয়াস, জেনেসিস ফ্যাশনস ও জেনেসিস ওয়াশিং এবং এসকিউ কোলবেন্স ও এসকিউ বিরিকিনা।

ডব্লিউআইটিএসএ’র অ্যাওয়ার্ড পেল বিজিএমইএ

চলতি বছরের ১৪ নভেম্বর পোশাককর্মীদের বায়োমেট্রিক ডেটাবেইজ তৈরির জন্য ‘ডব্লিউআইটিএসএ গ্লোবাল আইসিটি এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয় পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ-কে। ওয়ার্ল্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস অ্যালায়েন্স (ডব্লিউআইটিএসএ) হলো বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল প্রযুক্তি শিল্পের শীর্ষস্থানীয় স্বীকৃত একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ৮০টিরও বেশি দেশ ও অর্থনীতির সদস্য যুক্ত রয়েছে। এসব দেশ বিশ্বের আইসিটি বাজারের ৯০ শতাংশের বেশি প্রতিনিধিত্ব করে।

ডব্লিউআইটিএসএ অ্যাওয়ার্ডগুলো ২০২১ সালে প্রযুক্তি বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলোর স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে ওই সময় বলা হয়, ২০১৩ সালে পোশাককর্মীদের জন্য একটি বায়োমেট্রিক ডেটাবেইজ তৈরির উদ্যোগ নেন তারা। বায়োমেট্রিক আইডেন্টিটি অ্যান্ড ওয়ার্কার ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ওয়ার্কার ডাটাবেইস) স্থানীয় ও ক্লাউড সার্ভার ডেটাবেইজে কর্মসংস্থান এবং পরিচয় সম্পর্কিত তথ্যসহ শ্রমিকদের রেকর্ড সংরক্ষণ করে। বিজিএমইএ’র আড়াই হাজার সদস্য কারখানায় প্রতিদিনই ৪০ লাখেরও বেশি কর্মীর জন্য সফটওয়্যারটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে— জানায় সংস্থাটি।

চীনের পণ্য সংকুচিতকরণ নীতি পোশাক খাতকে বেশ সমস্যার মধ্যে ফেলেছে / ফাইল ছবি

করোনার পর সুতা ও জাহাজীকরণে ভোগান্তি

করোনার কঠিন সময়ের মধ্যে পোশাক খাতে নতুন করে সংকট দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম বেড়ে যাওয়ায় পোশাকের কাঁচামাল সুতা অর্থাৎ ইয়ার্নের মূল্যও গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। অর্থাৎ ২ ডলার ৪০ সেন্টের সুতার মূল্য দাঁড়ায় ৫ ডলারে। 

সুতার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় গত ৮ আগস্ট উদ্বেগ জানায় বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ পাঁচটি সংগঠন। তারা জানান, সুতার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে পোশাক শিল্পে প্রচুর ক্রয়াদেশ আসলেও উদ্যোক্তারা তা নিতে পারছেন না। দ্রুত সুতার দাম কমানোর দাবি জানান তারা।

করোনার কারণে আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে জাহাজের চলাচল কমে যাওয়া, কন্টেইনার সংকটসহ সাপ্লাই চেইনে বিপর্যয়ের কারণে ৪০০ থেকে ৫০০ শতাংশ ফ্রেইট চার্জ বেড়ে যায়। ফলে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে দেশের পোশাক শিল্প। পণ্যের উৎপাদনের মূল্য কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

বৈশ্বিক মহামারি করোনার সংক্রমণ শুরুর আগে একটি ২০ ফুটের কন্টেইনার (টিইইউ) পণ্য আমেরিকায় পাঠাতে ব্যয় হতো তিন হাজার মার্কিন ডলার। এক বছরের ব্যবধানে এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার মার্কিন ডলারে। শুধু আমেরিকায় নয় ইউরোপেও একই আকারের কন্টেইনার পাঠাতে খরচ হতো ২৫০০ মার্কিন ডলার। তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ হাজার মার্কিন ডলারে। সে হিসাবে প্রতি টিইইউ রফতানি পণ্যবাহী কন্টেইনারে গড়ে প্রায় ১২ হাজার ৫০০ ইউএস ডলার ফ্রেইট চার্জ (জলপথে পণ্য পরিবহন খরচ) বেড়ে যায়।

জাহাজীকরণের মাধ্যমে ইউরোপে পণ্য রফতানির মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের / ফাইল ছবি

এ বিষয়ে বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার সংকট কাটিয়ে উঠেছি। আমাদের কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ চমৎকার। এখন আমাদের কাছে প্রচুর অর্ডার আসছে। সময় ভালো যাচ্ছে। আগামীতে আরও ভালো যাবে, আশা করি। 

নতুন করে আমাদের কারখানাগুলোতে শ্রমিকের সংকট তৈরি হয়েছে। এটি সমাধানের চেষ্টা চলছে। তবে আমাদের বিপাকে ফেলেছে সুতা ও কন্টেইনারের ব্যয় বৃদ্ধি। এছাড়া চীনের সংকুচিত নীতির কারণে চাহিদা অনুসারে সাপ্লাই কমেছে। এগুলো সমন্বয় করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছি।

প্রায় একই সুরে কথা বলেন বিজিএমইএ’র পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মহিউদ্দিন রুবেল। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার ধাক্কা সামাল দিয়ে আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এ সময়ে নতুন করে সুতার দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচও বেড়েছে। উৎপাদন খরচ এক ধাক্কায় ৩০০ থেকে ৯০০ টাকায় চলে গেছে, যা কল্পনাতীত।

‘নতুন অর্ডার আসছে কিন্তু মুনাফা হচ্ছে না’— এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছে তিনি আরও বলেন, সুতার মূল্য বৃদ্ধির কারণে এখন আর ব্যবসা হচ্ছে না। ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক বেশি অর্ডার নিচ্ছি কিন্তু মুনাফা করতে পারছি না। এ অবস্থায় বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব না।

এমআই/এমএআর/