সাগরের ভয়ঙ্কর মৃত্যুফাঁদ রিপ কারেন্ট বা সমুদ্রের উল্টো স্রোত | ছবি- সংগৃহীত

রিপ কারেন্ট বা সমুদ্রের উল্টো স্রোত; একধরনের ঢেউ যা সমুদ্রতটে ধাক্কা খেয়ে উল্টো দিকে অর্থাৎ গভীর সমুদ্রের দিকে ধাবিত হয়। সমুদ্র থেকে ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙেলে দুদিক থেকে আসা এ ঢেউ প্রথমে সমুদ্র সৈকতে ধাক্কা দেয়, তারপর সরু একটি পথ ধরে আবার সমুদ্রে ফিরে যায়। যদি কেউ এ স্রোতে পড়েন তাহলে তার জীবিত ফিরে আসা দুষ্কর। এ কারণে এটাকে সাগরের ভয়ঙ্কর মৃত্যুফাঁদ বলেও অভিহিত করেন। 

এটা যেকোনো সমুদ্র সৈকতে হতে পারে। রিপ কারেন্টের আরও একটি ভয়ঙ্কর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- ওপর থেকে একে দেখতে গাঢ় নীল ও খুব শান্ত মনে হয়ে। না বুঝে শান্ত এ গাঢ় নীলের ছোবলে পড়লে স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে জীবনঘণ্টা।

সেন্টমার্টিনের উত্তর-পূর্বকোণের সৈকত ‘রিপ কারেন্ট’ বা মৃত্যুকূপ হিসেবে পরিচিত। পরিসংখ্যান বলছে, গত ৮-১০ বছরে এ সৈকতে পানিতে তলিয়ে মারা গেছেন অন্তত ১৮ জন। ২০১৪ সালে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষার্থী মারা যান। পুরো পৃথিবীতে এ সময়ে মারা যান ৫০ হাজারের বেশি মানুষ

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের উত্তর-পূর্বকোণের সৈকত ‘রিপ কারেন্ট’ বা মৃত্যুকূপ হিসেবে পরিচিত। পরিসংখ্যান মতে, গত ৮ থেকে ১০ বছরে সেন্টমার্টিনের এ সৈকতে পানিতে তলিয়ে মারা গেছেন অন্তত ১৮ জন। ২০১৪ সালেই এখানে গোসল করতে নেমে মারা যান একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষার্থী। একই সময়ে পুরো পৃথিবীতে রিপ কারেন্টে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি।

৯০ ডিগ্রি অ্যাঙেলে সৈকতে এসে ধাক্কা দিয়ে আবারও ফিরে যায় রিপ কারেন্ট | ছবি- সংগৃহীত

 সমুদ্র সৈকতের ৮০ ভাগ মৃত্যুই হয় এ রিপ কারেন্টের জন্য। এমন একটি বিপদজনক বিষয়ে পর্যটকদের সতর্ক করতে সরকার এখনও কাজ শুরু করতে পারেনি। কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের অভাব রয়েছে। এগুলোর জন্য চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে। সেগুলো পেলেই বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকতগুলোর কোথায় কোথায় রিপ কারেন্ট আছে তা পরিমাপ করা যাবে।

রিপ কারেন্টে কতজন মারা গেছে, এমন কোনো স্ট্যাডি এখনও হয়নি। এটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তাদের উচিত রিপ কারেন্ট এরিয়াগুলো আইডেন্টিফাই করে ডেনজার ফ্ল্যাগ টাঙিয়ে দেওয়া

ড. মোসলেম উদ্দীন, চেয়ারম্যান, সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সমুদ্রের কারেন্ট কত ধরনের

সমুদ্রের কারেন্ট বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়। কোস্টাল ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে কারেন্টকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হচ্ছে- লঙশোর কারেন্ট (longshore current) এবং অপরটি হচ্ছে রিপ কারেন্ট (rip current)। সমুদ্রকূলের কাছাকাছি যে স্রোত প্রবাহিত হয় সেটি লঙশোর কারেন্ট। আর যে স্রোত সমুদ্র থেকে ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙেলে সৈকতে এসে ধাক্কা দিয়ে আবার ভেতরের দিকে চলে যায় সেটা হচ্ছে রিপ কারেন্ট।

ওপর থেকে দেখতে গাঢ় নীল ও খুব শান্ত মনে হয়ে। কিন্তু এর মধ্যে পড়লে সব শেষ | ছবি- সংগৃহীত

সমুদ্র সৈকতে পলি জমবে না ভেঙে যাবে, সেটা স্রোতের ওপর নির্ভর করে। পলি যখন স্রোতের পাশ দিয়ে যাবে তখন স্রোতটা আস্তে আস্তে প্রবাহিত হবে। স্রোত যত আস্তে আস্তে যাবে পলি তত বসে যাবে। মূলত লঙশোর কারেন্টের মাধ্যমে একটির বিচ বা সৈকত তৈরি হয়, সৈকতের উন্নয়ন ঘটে বা নতুন ভূমি তৈরি হয়।

সরকারের উচিত এটার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সবাইকে একত্রিত করে মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা। যারা এটা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন, তাদের সামুদ্রিকজ্ঞানটাও বৃদ্ধি করতে হবে

ড. মোসলেম উদ্দীন, চেয়ারম্যান, সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

যখন রিপ কারেন্ট হয়, তখন দুদিক থেকে পানি এসে ধাক্কা দিয়ে পলিগুলোকে মিশিয়ে ফেলে এবং সেটা খোলা সমুদ্রের দিকে চলে যায়। এজন্য সেখানে পলির স্তর ভেঙে যায় বা ক্ষয় হয়ে যায়। এটাকে অনেক সময় ডিস্ট্রাক্টিভ কারেন্ট বলা হয়। এমনটি জানিয়েছেন সমুদ্র বিশেষজ্ঞরা।

রিপ কারেন্টে দুদিক থেকে পানি এসে ধাক্কা দেয়। ফলে পলির স্তর ভেঙে যায় | ছবি- সংগৃহীত

রিপ কারেন্টে বছরে কতজন মারা যায়

ইউনাইটেড স্টেট লাইভ সেভিংস অ্যাসোসিয়েশন’র তথ্য অনুযায়ী, সেখানে বছরে ১০০ এর বেশি মানুষ রিপ কারেন্টে মারা যায়। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রিপ কারেন্টে কতজন মারা গেছেন, এমন কোনো স্ট্যাডি এখনও হয়নি। কিন্তু আমি মনে করি, এটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা আছেন অর্থাৎ সরকার ও বিচের বিজনেসম্যান; তাদের উচিত রিপ কারেন্ট এরিয়াগুলো আইডেন্টিফাই (শনাক্ত) করে ডেনজার ফ্ল্যাগ (বিপদজনক হিসেবে লাল পতাকা) টাঙিয়ে দেওয়া। আমাদের এখানে এরকম কোনো নির্দেশনা দেওয়া নাই। ফলে আমরা আদৌ বুঝতে পারি না যে, বিচ থেকে একজন মানুষ সমুদ্রে ভেসে গেল, সে কি রিপ কারেন্টে ভেসে গেল নাকি অন্য কোনো কারণে। এ বিষয়ে আমাদের সঠিক কোনো তথ্য নাই।

পাখির চোখে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন | ছবি- সংগৃহীত

“উন্নত দেশগুলোতে (যেমন- ফিনল্যান্ড, ইউএসএ, ইতালি) রিপ কারেন্ট জোন আইডেন্টিফাই (চিহ্নিত) করে বিপদজনক মার্ক করে দেওয়া হয়েছে। আমেরিকার নিউজার্সির নর্থ আটলান্টিকের প্রতিটি বিচে লাইভ ক্যামেরা বসানো আছে। যা একসঙ্গে ছবি ও ভিডিও ধারণ করে। ছবি ও  ভিডিও দেখে তারা একটি ম্যাপ তৈরি করে। সেই ম্যাপে দেখানো হয়, এসব এরিয়াতে (এলাকা) রিপ কারেন্ট আছে। সাইনবোর্ডও লাগিয়ে দেওয়া হয়। নোট দেওয়া হয় ‘ডেঞ্জার ফর সুইমিং’।”

রিপ কারেন্ট সাধারণত সেন্টমার্টিনের দেখা যায়। সেখানের কয়েকটি জায়গা আইডেন্টিফাই (চিহ্নিত) করে সাইনবোর্ড (সতর্কবার্তা) দেওয়া আছে

ইব্রাহীম হাবীবুল্লাহ, টুরিস্ট পুলিশ সুপার (লিগ্যাল ও মিডিয়া)

তিনি বলেন, প্রস্তাবনাটি বাংলাদেশের জন্য পেয়েছিলাম। কিন্তু কোনো ফান্ড না পাওয়ায় এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।’

টুরিস্ট পুলিশকে সমুদ্রজ্ঞান সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের এ চেয়ারম্যান বলেন, যাদের টুরিস্ট পুলিশ হিসেবে সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার, পটুয়াখালী ও সুন্দরবনে পাঠানো হবে তাদের ওইসব এলাকার পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞান দিতে হবে বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। টুরিস্ট পুলিশ গঠনের বিষয়টা সরকারের অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। কিন্তু তাদের যদি সমুদ্র, সমুদ্রের গুরুত্ব, সমুদ্রের অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তবে তারা ভালোভাবে পর্যটকদের বুঝাতে সক্ষম হবে।

দেশের একমাত্র সমুদ্রবিদ্যা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট- বিওআরআই

 পর্যটকদের জীবন রক্ষায় যা করতে পারে সরকার

সমুদ্র সৈকত হচ্ছে বাণিজ্যিক ও পরিবেশগত সংবেদনশীল একটি জায়গা। এজন্য এটাকে সবসময় পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন। পৃথিবীর প্রতিটি বিচে কারেন্ট মনিটরিং সিস্টেম আছে। সেখান থেকে বোঝা যায়, বিচ এক বছরে কতটুকু বড় বা ছোট হয়েছে, পানির লেভেল কতটুকু বেড়েছে না কমেছে, সেখানে কতটুকু পলি জমল বা কমল। মনিটরিং করে এটাকে ১০ বা ২০ বছর পরপর রিপেয়ার (মেরামত) করা হয়। তাই সরকারের উচিত এটার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সবাইকে একত্রিত করে মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা। ডেভেলপমেন্টের সিদ্ধান্ত নেওয়া। যারা এটার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন, তাদের সামুদ্রিকজ্ঞানটাও বৃদ্ধি করতে হবে— এমনটি মনে করেন ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দীন।

আমরা রিপ কারেন্ট নিয়ে এখনও কোনো কার্যক্রম শুরু করিনি। আমাদের পরিকল্পনায় আছে। কিছু ইন্সট্রুমেন্টের (যন্ত্রপাতি) কথা বলেছি। সেগুলো পাওয়ার পর সতর্কবার্তা দিতে পারব

মুহাম্মদ শাহীনুর রহমান, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিওআরআই

রিপ কারেন্ট থেকে পর্যটকদের সতর্ক করতে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে টুরিস্ট পুলিশ— এমন প্রশ্নের জবাবে টুরিস্ট পুলিশ সুপার (লিগ্যাল ও মিডিয়া) ইব্রাহীম হাবীবুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, রিপ কারেন্ট সাধারণত সেন্টমার্টিনের দেখা যায়। সেখানের কয়েকটি জায়গা আইডেন্টিফাই (চিহ্নিত) করে সাইনবোর্ড (সতর্কবার্তা) দেওয়া আছে। ওখানে আমাদের যেসব টুরিস্ট পুলিশ সদস্য নিয়োজিত তারা প্রতিনিয়ত পর্যটকদের সতর্ক করছেন।

‘ডেঞ্জার ফর সুইমিং’, উন্নত দেশের উপকূলে এভাবে সতর্কবার্তা দেওয়া আছে | ছবি- সংগৃহীত  

বিপদজনক রিপ কারেন্ট নিয়ে এখনও কাজ শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র সমুদ্রবিদ্যা বিষয়ে জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিওআরআই)। প্রতিষ্ঠানটির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুহাম্মদ শাহীনুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা রিপ কারেন্ট নিয়ে এখনও কোনো কার্যক্রম শুরু করিনি। আমাদের পরিকল্পনায় আছে। 

‘কারেন্ট মেজারমেন্টের জন্য আমরা কিছু ইন্সট্রুমেন্টের (যন্ত্রপাতি) কথা বলেছি। সেগুলো পাওয়ার পর যখন আমরা বিভিন্ন স্থানে বসাতে পারব, তখন কারেন্ট মেজারমেন্ট করতে পারব। তারপর এ বিষয়ে সতর্কতামূলক একটা বার্তা দিতে পারব। আমাদের প্রতিষ্ঠানটা একদমই নতুন। আমরা আশাবাদী, খুব দ্রুতই কাজগুলো সমাপ্ত করে একটা ভালো মেজারমেন্ট (পরিমাপ) দিতে পারব।’

এইচএন/এমএআর/