করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার আলোকে স্বাস্থ্যখাত সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনার মহামারির দুই বছরের বেশি সময় পার করছে বাংলাদেশ। এ সময়ে করোনা নিয়ন্ত্রণসহ টিকাদানে সফলতা পেলেও প্রকট অব্যবস্থাপনা ছিল।

মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে বাংলাদেশ কোভিড-১৯: প্রথম দুই বছর ও সামনের দিনগুলো শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে তারা এসব কথা বলেন।

প্রতিবেদনে মহামারি শুরুর দিকে করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য অংশীজনদের গ্রহণ করা ব্যবস্থার কথা তুলে ধরা হয় এবং এর ভুলগুলো খুঁজে বের করা হয়। একইসঙ্গে ভুল থেকে কী শিক্ষা পাওয়া গেল সেসব কথাও বলা হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে মহামারি মোকাবিলায় পূর্বের ভুল থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার আলোকে স্বাস্থ্যখাত সংস্কারে করণীয় বিষয়গুলোর কথা তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহ্বায়ক ড. আহমেদ মুশতাক রাজা চৌধুরী স্বাগত বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আমাদের স্বাস্থ্যখাতে মনোযোগ অনেক কম। তাই প্রতি বছর বাজেটে এর বরাদ্দ অনেক কম দেখা যায়। আমাদের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে মনোযোগী হওয়া উচিত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, করোনা মহামারির মতো এত বড় যুদ্ধে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আরও সম্পৃক্ত করার দরকার ছিল। স্বাস্থ্যে ভালো কিছু করতে হলে সঠিক ব্যবস্থাপনা জরুরি। শুরু থেকে আমাদের পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল। এ কারণে মানুষের কাছে ভুল বার্তা গেছে। করোনা রোগীর কথা শুনলেই বাড়িতে লাল পতাকা টাঙানো হয়েছে। এর দায় আমাদেরও আছে। এটাকে এক ধরনের ফ্লুয়েঞ্জা বলে ধরে নেওয়া হয়েছে।

বে-নজির আহমদ বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবস্থাগুলো নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের না দিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের হাতে দেওয়া হয়েছে।এতে করে কোভিডে আক্রান্তরা সমাজ থেকে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। জেলা প্রশাসকদের এখানে সকল কাজের কাজী বানাতে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ছিল না। ফলে পরিকল্পনা হয়েছে এক, মাঠ পর্যায়ে বাস্তবে হয়েছে আরেক। হাসপাতালগুলোতে ইনফেকশন প্রতিরোধী ব্যবস্থা ছিল না। ফলে ডেল্টার সময়ে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এ জন্য জনস্বাস্থ্যে আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিটি জেলায় ৩০ লাখ মানুষের বসবাস হলেও এপিডেমিওলজি নেই।

তবে লকডাউন নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এটি অনেক বড় প্রভাব ফেলেছে বলেও জানান এই রোগ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ।

সরকারের রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মোশতাক হোসেন বলেন, দেশের মানুষ সবকিছু মানেন কিন্তু পালন করতে পারেন না। যেটা আমরা করোনায় সরকার ঘোষিত নির্দেশনা বাস্তবায়নের দিকে তাকালেই দেখতে পাই। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীরা যখন করোনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন, তখন বাংলাদেশের সরকার প্রধান মানুষকে মাস্ক পড়তে বলেছেন। হ্যাঁ, আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। কারণ, তখন এটি জানা ছিল না।

তিনি বলেন, আমাদের প্রধান সংকট প্রাতিষ্ঠানিক হেলথ কাভারেজ নেই। একই সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও ঠিকভাবে সম্পৃক্ত করা যায়নি। ফলে করোনায় এক কোটি মানুষকে খাদ্য বিতরণকালে অনিয়মের খবর এসেছে। কী পরিমাণে হয়েছে সেটি বের করা দরকার। অনেক দেশের আগেই লকডাউন দেওয়া হলেও এর ইতিবাচক ফল এসেছে। আমাদের প্রস্তুতি ও অর্জন মাঝামাঝি। যে দেশের হেলথ কাভারেজ যত ভাল, তারা ততটাই উন্নত। গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও শহরাঞ্চলে নেই। ফলে গ্রামে সংক্রমণ কম ছড়ালেও শহরে বেশি ছড়িয়েছে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনা যখন বিশ্বব্যাপী ব্যাপক তাণ্ডব চালায় তখন ইতালির প্রধানমন্ত্রী কোনো উপায় না দেখে আকাশের পানে চেয়েছিলেন, সেখানে আমাদের সরকার প্রধান প্রতিদিনই মাস্ক পড়তে বলেছিলেন। এক কোটি মানুষকে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। করোনার ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় কেউ বাইরে চিকিৎসা নিতে যায়নি। প্রথমদিকে সামনে থেকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে অনেকে মারা গেছেন। ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সব থেকে এগিয়ে।

টিআই/ওএফ