সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য দেশের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল ‘সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল’। এই হাসপাতালে সচিব থেকে শুরু করে অফিস সহায়ক— সবাই সেবা নেন। তবে ১৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতালে নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। ১৭ বিভাগের ১৩টিতেই নেই সিনিয়র কনসালটেন্ট। 

জানা গেছে, রাজধানীর ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত এ হাসপাতালটি শিগগিরই ৫০০ শয্যায় উন্নীত হচ্ছে। হাসপাতালটিতে নতুন করে এক হাজার ৭৬২ জনবলের চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে। যেখানে চিকিৎসকই থাকবেন ৫০০ জনের মতো।

জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১২ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সরকারি কর্মচারী হাসপাতালকে ৫০০ শয্যায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে প্রাথমিকভাবে খরচ ধরা হয় ৩৭৯ কোটি ৯৬ লাখ ৫১ হাজার টাকা, যার পুরোটাই অর্থায়ন করবে সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় গণপূর্ত অধিদপ্তর। ২০২১ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা থাকলেও তা হয়নি। পরে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়।

এ প্রকল্পের আওতায় বর্তমান পাঁচতলা ভবনটি ১৬ তলায়, বিভিন্ন ধরনের ১ হাজার ৭০০ মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র, চারটি অ্যাম্বুলেন্সসহ ১১টি যানবাহন ক্রয়, নয়টি লিফট, দুই হাজার কেভিএ সাব-স্টেশন ও ৪০০ কেভিএ জেনারেটর, স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, ৫০০ বর্গকিলোমিটার অভ্যন্তরীণ রাস্তা, ২ হাজার ৬৫৭ বর্গমিটার কম্পাউন্ড ড্রেন করাসহ বেশকিছু কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার কথা রয়েছে।

এসব বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মনিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগামী বছরের (২০২৩) জুন পর্যন্ত আমাদের প্রকল্পের নির্ধারিত সময়সীমা আছে। যদি এরপরও প্রয়োজন হয় সময় বর্ধিতকরণ করা লাগতে পারে। ইতোমধ্যেই সময় বাড়ানোর আবেদন করেছি। যদি সময় বাড়ানো হয়, তাহলে কাজ শেষ করে পুরোপুরিভাবে কার্যক্রম শুরু করা যাবে। আর যদি বাড়ানো না হয়, তাহলে হয়তো আংশিক কার্যক্রম শুরু করা যাবে।

১৭ বিভাগের তিনটিতেই নেই সিনিয়র চিকিৎসক

কর্মচারী হাসপাতালের উপসচিব দিদারুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আউটডোর প্রতিদিন গড়ে ছয় শতাধিক রোগী আসেন। হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন রোগী ভর্তি থাকেন। মহামারির সময়ে এখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সব রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সচিব থেকে শুরু করে অফিস সহায়ক— সবাই সেবা নিতে আসেন।

তিনি বলেন, ১৫০ শয্যার এ হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার, জুনিয়র ও সিনিয়র কনসালট্যান্টসহ চিকিৎসকের মোট পদ রয়েছে ৯৬টি। তবে বর্তমানে চিকিৎসক আছেন ১০৫ জন। করোনার জন্য বেশি সংখ্যক চিকিৎসককে এখানে পদায়ন করা হয়। এখানে মেডিকেল অফিসার আছেন মোট ৪৬ জন। যার মধ্যে ২১ জন নন-ক্যাডার ও ২৫ জন ক্যাডার (স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে) রয়েছেন। তবে সিনিয়র চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। হাসপাতালের ১৭টি বিভাগের মধ্যে সিনিয়র কনসালটেন্ট চিকিৎসক আছেন মাত্র ৩টি বিভাগে।

দিদারুল ইসলাম আরও বলেন, ৪২তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে আমাদের হাসপাতালের ১৪ জন মেডিকেল অফিসার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহকারী সার্জন পদে যোগদান করেছেন। এতে আমাদের এখানে ১৪টি পদ ফাঁকা হয়েছে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে করোনা বা অন্য কোনো মহামারির কথা বিবেচনায় রেখে এবং ৪২তমের অপেক্ষমানদের প্রথম দফার চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এ বছরের মার্চে ১৯ জন চিকিৎসক নিয়োগের জন্য চাহিদাপত্র পাঠিয়েছি।

উত্তীর্ণ হয়েও নিয়োগ বঞ্চিত ৪২তমের ১৩৮০ চিকিৎসক

৪২তম বিসিএস (বিশেষ) পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল অনুযায়ী, মোট ৫ হাজার ৯১৯ জন উত্তীর্ণ হলেও বাংলাদেশ কর্ম কমিশনের (পিএসসি) কাছে পদ স্বল্পতার কারণে ৪ হাজার জনকে ‘সহকারী সার্জন’ পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে। অবশিষ্ট ১ হাজার ৯১৯ জনকে অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হয়। এরপর গত ২৯ মার্চ ৪২তম বিশেষ এই বিসিএস থেকে ৫৩৯ জন চিকিৎসককে নন-ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। এ অবস্থায় আরও এক হাজার ৩৮০ চিকিৎসক এখনো নিয়োগের জন্য দ্বারে-দ্বারে ঘুরছেন।

৪২তম বিসিএসে অপেক্ষমাণ নিয়োগ প্রত্যাশী ডা. মেহেদি হাসান শুভ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েও দিনের পর দিন অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকা খুবই কষ্টের। বিসিএস একজন শিক্ষার্থীর জীবনে একটা স্বপ্ন। আমরা বিসিএসের সব ধাপ অতিক্রম করে চূড়ান্ত পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছি। এ পর্যায়ে এসে যদি আমরা নিয়োগ বঞ্চিত হই, সেটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয়।

তিনি বলেন, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে এডহক, ৩৩তম বিসিএস ও ৩৯তম বিসিএসের মাধ্যমে ১৮ হাজারের বেশি চিকিৎসক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সমযোপযোগী সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের মাধ্যমেই দেশে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। বেড়েছে দেশের মানুষের গড় আয়ু ও এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও সম্ভব হয়েছে। আমরাও যদি নিয়োগপ্রাপ্ত হই তাহলে দেশের যেকোনো প্রান্তে চিকিৎসা সেবা দিতে চাই।

ডা. শুভ আরও বলেন, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল দেশের চিকিৎসাখাতে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণের সেবায় নিয়োজিত সরকারি কর্মচারীরা এখান থেকে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন। কাজেই এখানে চিকিৎসকের ঘাটতি থাকলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের সরকারি কার্যক্রম বাধার সম্মুখীন হবে। যেহেতু চিকিৎসকের পদ শূন্য আছে, কাজেই আমাদের ৪২তম বিসিএসের অপেক্ষমানদের মধ্যে থেকে নিয়োগ দেওয়া হোক। জনগণের সেবায় আমরা সদা প্রস্তুত থাকব।

প্রয়োজন ৫০০ চিকিৎসক 

সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের উপপরিচালক ও সিনিয়র কনসালটেন্ট রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. শাহ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে সীমিত জনবল নিয়েই কার্যক্রম পরিচালনা করছি। তবে, ১৫০ শয্যা থেকে ৫০০ শয্যায় পরিণত হলে সেখানে নতুন জনবলও যুক্ত হবে। ইতোমধ্যে ৫০০ শয্যার হাসপাতালের জনবল কাঠামোর জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বিএসএমএমইউ) বেশ কয়েকটি হাসপাতাল পরিদর্শন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চাহিদাপত্র দিয়েছি। সর্বশেষ এটি পাশ হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পারমিশনের জন্য প্রক্রিয়াধীন আছে।

তিনি আরও বলেন, চাহিদাপত্রে ৩১টি বিভাগের জন্য সর্বমোট এক হাজার ৭৬২ জন নতুন জনবলের বিষয়ে বলা হয়েছে। সেখানে চিকিৎসক থাকবে ৫০০ জন। আর বাকি যেই পদগুলোতে নার্স, টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ানসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছে। বর্তমানে ১৫০টি শয্যায় আছে ৩২০ জনের মতো। সবমিলিয়ে নতুন ওই হাসপাতালটিতে দুই হাজার ৮২ জনের মতো জনবল থাকবে।

প্রসঙ্গত, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত একটি হাসপাতাল। এর আগে ২০১৫ সাল পর্যন্ত হাসপাতালটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ছিল। মহামারিকালে হাসপাতালটিতে করোনার রোগীদের সেবা দেওয়া হলেও এখন অন্য রোগীও ভর্তি করা হচ্ছে। হাসপাতালটির পরিচালক (যুগ্মসচিব) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আবু আহমদ ছিদ্দীকী।

টিআই/ওএফ