হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে নিঃশব্দে কাঁদছেন নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী সেলিম হাওলাদার (৬৫)। দুচোখ বেয়ে ঝরছে অশ্রু। কিছুক্ষণ পরপর করছেন বমি। বারবার আর্তনাদ করে বলছেন, ‘আমি আর বাঁচব না’। চিকিৎসক জানিয়েছেন, তীব্র পানিশূন্যতা রয়েছে তার। দুই হাতে দুটি স্যালাইন লাগিয়ে তাকে ঝুঁকিমুক্ত ও স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

সেলিম হাওলাদারের মতো একের পর এক ডায়রিয়া রোগী আসছে একসময়ের কলেরা হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) হাসপাতালে। তাদের স্বজনরা বলছেন, ডায়রিয়া শুরুর পর হঠাৎ করেই রোগী বেশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন। তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালে নিয়ে আসতে আসতেই একাধিকবার জ্ঞান হারাচ্ছেন তারা।

আজ বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে গিয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ভিড় এবং তাদের নানা অসহায়ত্বের চিত্র দেখা গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, গতকাল মধ্যরাত থেকে আজ বেলা ১১টা পর্যন্ত হাসপাতালে ৪৪৪ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। 

ডায়রিয়ায় আক্রান্ত সেলিম হাওলাদারের ছেলে ঢাকা পোস্টকে জানান, গত তিন দিন ধরে তার বাবা অসুস্থ। স্থানীয় ফার্মাসিস্টের পরামর্শে তিন দিনই স্যালাইন খাওয়ানো হয়, তারপরও গতকাল (বুধবার) মধ্যরাত থেকে শারীরিক অবস্থা আরও দুর্বল হতে থাকে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে তাকে এই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।

আরামবাগ থেকে আসা মো. শহীদ মিয়া নামে এক রোগী জানান, আজ সকাল সাতটার দিকে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। গত তিন দিন ধরে টানা পাতলা পায়খানা হচ্ছে তার। শারীরিকভাবে তিনি বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন। বাসায় বেশ কয়েকবার টয়লেটেই ঢলে পড়েন বলে জানান তিনি।

পানিশূন্যতা নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন রোগীরা 

চার দিনেও শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় অবশেষে তাকে নিয়ে হাসপাতালে আসেন স্ত্রী আয়েশা খাতুন। ঢাকা পোস্টকে আয়েশা খাতুন বলেন, হাসপাতালে আসার পর তার স্বামীর দেহে একাধিক স্যালাইন পুশ করা হয়। একইসঙ্গে বিশেষভাবে তৈরি খাবার স্যালাইন দেওয়া হয়। এখন বিছানা থেকে তিনি উঠে বসতে পারছেন।

আইসিডিডিআরবির অ্যাসিস্ট্যান্ট সায়েন্টিস্ট ডা. শোয়েব বিন ইসলাম বলেন, এবারের ডায়রিয়ার প্রকোপে লক্ষণীয় বিষয় হলো, রোগীদের ৩০-৪০ শতাংশই তীব্র পানিশূন্যতা নিয়ে হাসপাতালে আসছে। এই পানিশূন্যতাকে যদি আমরা বয়স অনুপাতে ভাগ করি, সেখানে প্রাপ্ত বয়স্কদের সংখ্যাটাই বেশি। তবে অনেক শিশুও আসছে পানিশূন্যতা নিয়ে।

তিনি  বলেন, এখানে যে রোগীরা আসছেন, তাদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের সংখ্যা বেশি। তবে শিশুদের সংখ্যাও কম নয়। শতকরা হিসাবে দেখা যাবে, ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক আর বাকি ৪০ থেকে ৩৫ শতাংশ শিশু। 

কর্মঘণ্টার বাইরে গিয়ে কাজ করছেন চিকিৎসক-নার্সরা 

নির্ধারিত কর্মঘণ্টার বাইরে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা

ডা. শোয়েব বিন ইসলাম বলেন, আমাদের হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা এখনো আগের মতোই আছে। যদিও দৈনিক রোগী ভর্তির সংখ্যা কিছুটা কমেছে। কিছুদিন আগেই দৈনিক রোগী ভর্তি ১৩শ থেকে ১৪শ হয়ে গিয়েছিল। এখন সেই তুলনায় কিছুটা কমে এসেছে। তবে এই সংখ্যা হাজারের নিচে নয়।

তিনি বলেন, গত এক মাসে আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে ৪৫ হাজারের অধিক রোগী চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। আমাদের হাসপাতালের ধারণক্ষমতা হলো সাড়ে তিনশ। সেখানে এত রোগীর চাপ সামলানো আমাদের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য। তারপরও রোগীদের স্বার্থে নির্ধারিত কর্মঘণ্টার বাইরে গিয়ে আমাদের কর্মীরা অতিরিক্ত সময় কাজ করছেন।

তিনি বলেন, প্রথমে আমরা অতিরিক্ত একটি তাঁবু স্থাপন করি। পরে আরেকটি তাঁবু স্থাপন করি। রোগী বাড়তে থাকায় এরপর প্রথম তাঁবুটাকে আরও বর্ধিত করি। এখন পর্যন্ত আমরা রোগীদের যথাসম্ভব সেবা দিয়ে যাচ্ছি।

আইসিডিডিআরবির অ্যাসিস্ট্যান্ট সায়েন্টিস্ট ডা. শোয়েব বিন ইসলাম

কাছের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ

রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলো থেকে আইসিডিডিআরবিতে নিয়ে আসার পথে এ পর্যন্ত অন্তত ২০ জন রোগী প্রাণ হারিয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। (যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আনুষ্ঠানিকভাবে বলছে, এ বছর এখন পর্যন্ত ডায়রিয়ায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে)

এ অবস্থায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ঝুঁকিপূর্ণ কোনো রোগীকে দূরবর্তী স্থান থেকে আইসিডিডিআরবিতে না আনার পরামর্শ দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আইসিডিডিআরবির মিডিয়া ম্যানেজার তারিফ হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত সব রোগীকে এখানে না এনে প্রাথমিক অবস্থায় নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দিচ্ছি। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন গুরুতর রোগী এ হাসপাতালে আসার পথেই মারা গেছেন।

তিনি বলেন, ঢাকায় যানজটের অবস্থা ভয়ানক। ফলে রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে সর্বপ্রথম নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে। এতে রোগীর প্রাণহানির ঝুঁকি কমে আসবে।

আরামবাগ থেকে আসা মো. শহীদ মিয়া নামে এক রোগী জানান, আজ সকাল সাতটার দিকে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। গত তিন দিন ধরে টানা পাতলা পায়খানা হচ্ছে তার। শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। বাসায় বেশ কয়েকবার টয়লেটেই ঢলে পড়েন বলে জানান তিনি।

নারায়ণগঞ্জ বা যাত্রাবাড়ী থেকে একজন রোগীকে নিয়ে আসতে অনেক সময় লেগে যায়। এ সময় রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটে, মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। অথচ এ রোগীদের যদি প্রাথমিক অবস্থায় স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হতো, তাহলে তাদের ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যেত।

তারিফ হাসান বলেন, একজন ব্যক্তির যখন ডায়রিয়া হয়, তখন তার শরীর থেকে প্রচুর পানি বের হয়ে যায়। আর যখন অনেক পানি চলে যায়, তখন দেহের বিভিন্ন অঙ্গে এর প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে হার্ট অ্যাটাক থেকে শুরু করে কিডনি বিকল হওয়া, ব্রেন স্ট্রোকসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এজন্য আমরা প্রত্যেককেই এ বার্তা পৌঁছে দিতে চাই যে, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে সর্বপ্রথম কাছের হাসপাতালে যেতে হবে।

টিআই/আরএইচ/জেএস