বছর ঘুরে ফেব্রুয়ারি মাস এলেই অনুভূত হয় মায়ের ভাষাকে বাঁচানোর তাগিদ। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি চলে গেলেই আবার ভুলে যাই সব। দেশের মেডিকেল শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই ইংরেজি ভাষার দাপটে বাংলা ভাষা যেন অসহায়। এ অবস্থায় মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ভাষায় প্রথম মেডিসিন রেফারেন্স বই লিখেছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আজিজুল হক (আবদুল্লাহ)। দীর্ঘ চার বছরের চেষ্টায় বাংলা ভাষায় মেডিসিন রেফারেন্স বইটি লেখা শেষ করেন তিনি।

গত  ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর একটি অডিটোরিয়ামে এ চিকিৎসকের বাংলায় লেখা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়। ডা. আজিজুল মনে করেন, মেডিকেল শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রেই মায়ের ভাষাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। সে লক্ষ্যে চিকিৎসকদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, মেডিকেল শিক্ষায় বাংলায় লেখা কোনো বই নেই, সব বই-ই ইংরেজিতে। এখানে বাংলা ভাষার বইয়ের খুবই অভাব বোধ করি। আন্তর্জাতিক শিক্ষার মান বজায় রাখতে কিছু মেডিকেল টার্ম ইংরেজি থেকে বাংলা করা সম্ভব না। তবে মেডিকেলের বইয়ে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাটাও থাকতে পারে।

রোববার (২১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ঢাকা পোস্টকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ডা. আজিজুল হক বলেন, জিপিএ ৫ পেলেও আমাদের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পক্ষে এ ভাষা পড়া, বুঝা ও লেখা অত্যন্ত কঠিন। অনেকসময় অনেক রোগ সম্পর্কে বুঝতে না পেরে তারা ওই সম্পর্কে বর্ণিত পাঠের উল্টো বা ভুল বুঝে থাকে।

তিনি বলেন, বিদেশি ভাষায় মেডিসিন চর্চা করতে গিয়ে রোগ বালাই, তার লক্ষণাদি ও চিকিৎসা সম্পর্কে সম্যক ধারণার অভাবে অনেকে ভবিষ্যতে ভাল চিকিৎসক হতে পারে না। আমি যা পড়ছি, সেটা যদি ভালো করে বুঝতে না পারি, তাহলে আমি কেমন করে ভালো ডাক্তার হবো? কেমন করে রোগীর কাছাকাছি যাবো? আর কিভাবেই রোগীর রোগ বা রোগের উপসর্গ বুঝবো? এসব বিষয় মাথায় নিয়েই বইটা লিখেছি। ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি যদি বাংলা ভাষায় সহায়ক কোনো পুস্তক থাকে তবে শিক্ষার্থীদের পাঠ বুঝতে সুবিধা হবে। 

প্রখ্যাত এ চিকিৎসক বলেন, আমি মেডিসিনের দুটি বাংলা বই লিখেছি। তবে এর মধ্যে কিছু টার্ম ইংরেজিতে আছে, যেগুলো আসলে বাংলা করা সম্ভব না। তবে সেক্ষেত্রে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও কিছু বিষয় তুলে ধরেছি। আমরা যদি এই টার্মগুলো থেকে পুরোপুরি বাংলায় যেতে চাই, তাহলে আরও ২০ বছর লাগবে।

মেডিকেল শিক্ষায় পুরোপুরি বাংলার ব্যবহার সম্ভব কি না- জানতে চাইলে ডা. আজিজুল হক বলেন, চাইলেই সম্ভব। আমি মনে করি এটি পুরোপুরি ইচ্ছাশক্তির ব্যাপার। আমি বিশ্বাস করি যে, জাপান, জার্মান, রাশিয়া ও চীন প্রভৃতি দেশে যেরূপ মাতৃভাষার মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানের চর্চা হয়। সেভাবে অন্তত এমবিবিএস কোর্স পর্যন্ত বাংলা মিডিয়ামে পড়াশোনা হলে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা বিপুলভাবে উপকৃত হবে।

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আসলে আমাদের মানসিকতাই ইংরেজিতে গেঁথে গেছে। এ কারণে এর বিকল্প আমরা কোনোভাবেই চিন্তা করতে পারছি না, মনে হচ্ছে এখান থেকে বের হওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। এর একটা কারণ হলো আমরা দীর্ঘদিন ইংরেজদের শাসনের অধীনে ছিলাম, তারপর আবার পাকিস্তানিদের অধীনে ছিলাম, এরপর বাংলাদেশ হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধারাটা সে একই রয়ে গেছে। ভাষার জন্য জাতি রক্ত দিলেও  আমাদের মন মানসিকতায় পরিবর্তন আসেনি।

শুধু কি মন-মানসিকতা দায়ী, নাকি অন্য কোনো কারণ আছে জানতে চাইলে আজিজুল হক বলেন, ভাষার প্রতি তো আসলে সবারই ভালোবাসা আছে, টান আছে। কিন্তু আমরা তো সবাই শুধু কথাই বলি, কিন্তু তেমন কাউকে এগিয়ে আসতে দেখি না, এটাই অন্যতম সমস্যা। যেমন আমি ইচ্ছে করেই সাহস করে এগিয়ে আসলাম, আমার মতো কি আর কোনো ডাক্তার নেই? তাদেরকেও তো এগিয়ে আসতে হবে। একাডেমিক বইগুলো ইংরেজিতে লিখতে হবে।

বই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, বইটি দুটি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের মূলনীতি ও চিকিৎসার প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিভিন্ন অঙ্গতন্ত্র ও সেগুলোর রোগসমূহ এবং চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলায় বইটি লেখার পূর্বে ইংরেজিতে রচিত অনেক মেডিসিনের বইপত্র ও জার্নাল পড়েছি। তবে বাংলা ভাষায় একটিও মেডিসিনের বই পাইনি। বইটি সম্পূর্ণ নিজের ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছি। এজন্য দুর্বোধ্য বাংলা শব্দ যথাসম্ভব পরিহার করে সহজ বাংলা শব্দ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। যেসব ইংরেজি শব্দের বাংলা অনুবাদ কোথাও পাইনি বা অনুবাদ করতে পারিনি পাঠকের সুবিধার্থে সেগুলো অবিকল ইংরেজি ভাষায় রেখে দিয়েছি, বিশেষভাবে মেডিকেল টার্মগুলো।

একনজরে ডা. আজিজুল হক 

অধ্যাপক ডা. আজিজুল হক ১৯৫৮ সালে রাজশাহী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তৎকালীন কিন্ডার গার্টেন ইংলিশ মিডিয়াম অ্যান্ড প্রিপারেটরি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। মাধ্যমিক স্তরে ছিলেন রাজশাহী সরকারি ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের ছাত্র। ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় রাজশাহী বোর্ডে তৃতীয় স্থান লাভ করেন। রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষায়ও একই বোর্ড থেকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১৮তম স্থান অধিকার করেন তিনি।

ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ায় পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে তিনি নিজ জেলার বাইরে বা দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা না করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ১৯৭৮ সালে ভর্তি হন। তিনি ১৯৮৩ সালে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৮৩ সালে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্বাস্থ্যপ্রকল্প ও হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন এ চিকিৎসক। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজে বিভিন্ন সময়ে ইনডোর মেডিকেল অফিসার, রেজিষ্ট্রার, আরপি (মেডিসিন) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

রেজিস্ট্রার থাকা অবস্থায় তিনি ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আইপিজিএমআর (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এমডি (ইন্টারনাল মেডিসিন) পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ২০০০ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে যোগদান করেন এবং ২০০৫ সালে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। সর্বশেষ তিনি মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭ সালে অবসরে যাওয়ার পর তিনি বাংলা ভাষায় মেডিকেলের বই লেখায় মনোনিবেশ করেন।

টিআই/আরএইচ