২০১৭ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) কর্মরত আছেন ডা. মিলি দে। চাকরির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ৯টি ঈদে কর্মস্থলে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। ১০ম ঈদ হিসেবে এই ঈদেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়টির হেমাটোলজি বিভাগে কর্মরত এই চিকিৎসক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঈদ মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব হলেও আমাদের মধ্যেও একটা ভালোলাগা ও আমেজ কাজ করে। তবে ঈদটা যেহেতু আমাদের মুসলিম সহকর্মীদের বিশেষ একটা উৎসব, সেহেতু তাদেরকে ছুটির ব্যবস্থা করে দিয়ে আমাদেরকেই দায়িত্ব পালন করতে হয়।

তিনি বলেন, ঈদেও কিন্তু অসংখ্য মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসেন। সেক্ষেত্রে আমরা যারা ডিউটিতে থাকি, আমাদেরকেই রাতদিন এক করে কাজ করতে হয়। যদিও আমাদের উপর চাপটা বেশি যায়, তারপরও মুসলিম সহকর্মীদের ঈদ উদযাপনের সুযোগ করে দিতে পেরে নিজেদের মধ্যে আলাদা একটা প্রশান্তি কাজ করে। আমরা বিষয়টিকে খুবই স্বাভাবিকভাবে নেই। কারণ আমাদের যখন উৎসব থাকে, তখন তারাও আমাদেরকে সাপোর্ট দেয়।
 
শুধু ডা. মিলি দে-ই নন, এরকম আরও অসংখ্য হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান চিকিৎসক আছেন, যারা মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবগুলোতে দায়িত্ব পালন করে, মুসলিম সহকর্মীদের ঈদ উদযাপনের সুযোগ করে দেন। তেমনটি আবার হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসবগুলোতেও মুসলিম চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সবমিলিয়ে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- এই মন্ত্রই যেন আমাদের সবার মূলমন্ত্র হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।

‘মুসলমানদের ঈদ পালনের সুযোগ করে দেওয়াটা আমাদের কাছে গর্বের’

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ, তারও একটি বড় উদাহরণ ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া। আমরা যারা হিন্দু চিকিৎসক রয়েছি, পূজার সময়ও আমরা ছুটিতে যাই। ওই সময়টাতে মুসলিম চিকিৎসকরা হাসপাতালে ডিউটি করেন। একইভাবে ঈদের সময়ে আমাদের মুসলিম সহকর্মীরা ঈদ পালনে ছুটিতে যান, তখন আবার আমরা দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসি। এই যে আমাদের জন্য তারা স্বাচ্ছন্দ্যে ঈদ উৎসব পালন করতে পারে, এজন্য আমরাও গর্ব অনুভব করি। এটা যেকোন দেশের সামাজিক ও সম্প্রীতির বন্ধনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি আরও বলেন, আমাদের ধর্মীয় প্রধান উৎসব হলো দুর্গাপূজা। তখন আমরা তিন/চার দিনের ছুটিতে থাকি। এরপর আবার বুদ্ধ পূর্ণিমা, বড়দিনে আমাদের খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধধর্মাবলম্বী সহকর্মীরা ছুটিতে যান, তখন আবার আমরা ডিউটিতে থাকি। এই যে একজনের উৎসবে অন্যজনের এগিয়ে আসা, এটা ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে অনেক ভালো লাগে। অন্য সহকর্মীরা উৎসব আনন্দে থাকলেও তাদের দেখে আমরা শান্তি অনুভব করি। 

ডা. প্রদীপ কুমার বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধেও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এক হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং এই স্বাধীনতা অর্জন হয়। এজন্য বাংলাদেশ শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশই নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়ও আমরা এক এবং ঐক্যবদ্ধ।

চিকিৎসা হলো সেবামূলক এবং সেক্রিফাইসিং পেশা : বিএসএমএমইউ উপ-উপাচার্য

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের প্রতিটি ঈদেই হিন্দু চিকিৎসকদের পাশাপাশি অনেক মুসলিম চিকিৎসকও হাসপাতালে ডিউটিতে থাকেন। সুতরাং বিষয়টি যদি এভাবে বলা হয় যে, ঈদে শুধু অমুসলিম চিকিৎসকরাই দায়িত্বে থাকেন, সেটি কিন্তু ভুল। হ্যাঁ, এই সময়টিতে হয়ত হিন্দু চিকিৎসকরা ছুটি নেয় না, এরকম তো মুসলিম চিকিৎসকরাও তাদের অনুষ্ঠানগুলোতে দায়িত্ব পালন করে।  

তিনি বলেন, আমাদের ধর্মীয় বিধান কিন্তু এরকম নয় যে, আপনি ঈদ করবেন আর এই সময়ে হিন্দু আর খ্রিস্টানরা দায়িত্ব পালন করবে। উৎসব সার্বজনীন। এক ধর্মের উৎসব বলে, অন্য ধর্মাবলম্বীরা যে তা পালন করতে পারবে না, তা তো নয়। তাই আমি মনে করি, এটা নিয়ে আসলে খুব বেশি বলা ঠিক হবে না।

মোশাররফ হোসেন বলেন, আমাদের যে অসুখ-বিসুখ, সেটি কিন্তু ঈদের সময়েও থাকে। এটা তো এমন না যে ঈদে মানুষ অসুস্থ হয় না। এদিকে আমরা যারা চিকিৎসক, আমাদের পেশাটি কিন্তু সেবামূলক এবং সেক্রিফাইসিং পেশা। ঈদ উপলক্ষে মানুষের আনন্দ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এর পাশাপাশি দায়িত্ব জ্ঞান এবং দায়িত্ববোধটাও থাকতে হবে। এক্ষেত্রে আমি মনে করি শুধুমাত্র অমুসলিমদের উপর নির্ভর করেই আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে তা কিন্তু নয়।

তিনি আরও বলেন, আমরা যারা মুসলিম, আমাদের অনেকেই আছেন ঢাকায় বা আশেপাশে থাকি, আমরা শারীরিকভাবে হাসপাতালে না এলেও যেন ‘অন কলে’ থাকি, এমনকি প্রয়োজনে চিকিৎসায় অংশগ্রহণ করি। সেই মনোভাবটা যেন আমাদের সবারই থাকে। আমরা যারা এই পেশায় কাজ করি, সে মেডিকেল অফিসার হোন বা অধ্যাপক হোন, প্রত্যেকেরই যেকোন সময়ে সেবার মানসিকতা থাকা উচিত।

এক ধর্মের ত্যাগে অন্য ধর্মের উৎসব পূর্ণতা পায় : স্বাস্থ্য মহাপরিচালক

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশের অধিকাংশ মানুষই কিন্তু অসাম্প্রদায়িক। কিছু মানুষ আছে এরকম যারা এটাকে উসকে দেয়। কিন্তু প্রফেশনাল ক্ষেত্রে বিশেষ করে চিকিৎসা সেবায় অত্যন্ত চমৎকার সম্প্রীতি বিদ্যমান আছে। আর সেটারই বহিঃপ্রকাশ হলো ঈদের ছুটিতে মুসলিম চিকিৎসকদের ঈদ পালনের সুযোগ দিয়ে দায়িত্ব পালনে হিন্দু চিকিৎসকদের এগিয়ে আসা। তেমনটা কিন্তু আবার মুসলিম চিকিৎসকরাও করে থাকেন, হিন্দুদের নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হিন্দু চিকিৎসকদের সুযোগ দিয়ে মুসলিম চিকিৎসকরাও দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এতে করে এক ধর্মের চিকিৎসকদের সক্রিয় অংশগ্রহণে কিন্তু অন্য ধর্মাবলম্বীদের উৎসব পূর্ণতা পায়।

তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতাল ম্যানেজমেন্টও চেষ্টা করে থাকে যারাই বিশেষ ছুটিগুলোতে ডিউটিতে থাকে, তাদের দেখভাল করার। আপনি হয়তো খেয়াল করে থাকবেন, গত কোভিডের সময় একটা ঈদে আমি ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিলাম, তখন করোনার খুবই খারাপ অবস্থা। কিন্তু তখন যে ডাক্তাররা ডিউটিতে ছিলেন, তাদের সঙ্গে আমরা কুশল বিনিময় করেছিলাম, তাদের খাওয়া-দাওয়াসহ যাবতীয় খোঁজখবর আমরা নিয়েছিলাম। এরকমটা আমরা সবসময় করে থাকি। বিশেষ করে ইউনিট চিফ যারা থাকেন, তারাও ব্যক্তিগতভাবে তাদের অধীনস্থ চিকিৎসকদের খাবার-দাবারসহ বিভিন্ন আয়োজন করে থাকেন।

স্বাস্থ্য মহাপরিচালক আরও বলেন, আমি যখন ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত ছিলাম, প্রায় প্রতি ঈদেই আমাদের বিভাগে ঈদে দায়িত্বপালনরত হিন্দু চিকিৎসকদের জন্য আলাদা করে একটু খাবার-দাবার পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি, এর বাইরে হাসপাতাল থেকে তো বিশেষ খাবার থাকেই। তারপরও আমরা করতাম। আবার পূজার পরেও হিন্দু চিকিৎসকরা যখন কর্মস্থলে ফিরে আসেন নাড়ু, মিষ্টান্নসহ বিভিন্ন খাবার নিয়ে আসেন। এটা একটা সাম্প্রদায়িক সম্পৃতির বড় বন্ধন এবং বড় একটি উদাহরণ আর মনে করি।

টিআই/জেডএস