চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসে ফি নির্ধারণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানাকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তবে, ফি নির্ধারণের বিষয়টিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘স্ট্যান্ডবাজি’ উল্লেখ করে ক্ষোভ জানিয়েছে পেশাজীবী চিকিৎসক নেতারা।

তারা বলছেন, একজন রোগীর চিকিৎসায় যে টাকা খরচ হয়, সেখানে চিকিৎসকের ফি খুবই সামান্য, ওষুধের দাম এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেই মোটা অংকের খরচ হয়। তাই চিকিৎসকের ফি নয়, বরং ওগুলোর দাম নির্ধারণ করা উচিত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, সচিবালয়ের নির্দেশে সোমবার অধিদপ্তরে এ নিয়ে পূর্বনির্ধারিত সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলমের সভাপতিত্বে বিএমএ মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী, বিএমডিসির সদস্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ, মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীরসহ আরও অনেকে সভায় উপস্থিত ছিলেন।

চিকিৎসকরা আরও বলেন, ১৯৯০ সালে তৎকালীন সরকার এ ধরনের একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। যার ফলে সরকার বিপদে পড়েছিল। বর্তমানে আমলারা সরকারকে বিপদে ফেলতে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণে কী কমিটি হয়েছে বা কত জনের কমিটি হয়েছে তা আমি জানিনা। আমাকে শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ফোন দেওয়া হয়েছিল, আমি কোনো চিঠি বা ইমেইল পাইনি। তবে ফি নির্ধারণের বিষয়টি একটি অনৈতিক সিদ্ধান্ত।’

তিনি বলেন, ‘তারা কেন চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ করতে চাচ্ছে এটা আমার বুঝে আসছে না। তারাতো ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি নির্ধারণ করতে পারে। একজন ব্যক্তির চিকিৎসা খরচ হয় তার কিয়দাংশ হলো চিকিৎসকদের ফি, আর মোটা অংকের খরচ হয়, তা হলো ওষুধ সরঞ্জাম ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। একজন চিকিৎসকের ফি তো সেই তুলনায় একদম নগণ্য। সেগুলোর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে চিকিৎসকদের ফি নিয়ে সরকারের এত মাথাব্যথা হওয়ার তো কিছু নেই। সরকারের মাথা ব্যথা হওয়া উচিত ছিল ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ, যেটা কিনা সরকারের পক্ষ থেকে যেটুকু লাগাম ছিল তা খুলে দেওয়া হয়েছে। সে লাগামহীন ও তার কারণে গত এক দশকে ওষুধের দামসহ পরীক্ষার ফিগুলোর দাম বেড়েছে। সরকারের উচিত এ জিনিসগুলো নিয়ন্ত্রণ করা, এতে সাধারণ মানুষের উপকার হবে।’

ফি নির্ধারণে বিষয়টিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘স্ট্যান্ডবাজি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এসময় সমস্ত বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক স্ট্যান্ডবাজি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করার কোনো মানে নেই। এতে করে চিকিৎসকদের সঙ্গে সরকারের একটা দূরত্ব তৈরি হবে, এমনকি এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যের কোনো মঙ্গল হবে না, সাধারণ মানুষেরও কোনো উপকার হবে না। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে এসব বিতর্কিত কাজের মাধ্যমে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করছে।’

পৃথিবীর কোনো দেশেই চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ নেই। আমাদের আইন মন্ত্রণালয় কি উকিলদের ফি নির্ধারণ করতে পেরেছে? শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি মাস্টারদের ফি নির্ধারণ করতে পেরেছে? কে পেরেছে? কোন মন্ত্রণালয় পেরেছে? এটা আসলে আদৌ সম্ভব নয়।

ডা. ইকবাল আর্সলান

এর আগে ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ করে দেবেন বলে জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, চিকিৎসকদের জন্য রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া ফিসের পরিমাণ নির্ধারণের একটি পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।

এ বিষয়ে চিকিৎসকদের সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি অ্যান্ড রাইটসের (এফডিএসআর) উপদেষ্টা ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ডা. আব্দুন নূর তুষার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণটা একটা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। এগুলো হলো স্বাস্থ্যবিভাগ সম্পর্কে ধ্যান-ধারণাহীন লোকজনের কিছু উদ্ভট সিদ্ধান্ত। এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিকল্পনাটা হচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগকে অস্থির করা। স্বাস্থ্যবিভাগের যে দুর্নীতি হয় সেগুলোকে ঢেকে ডাক্তারদের উত্তেজিত করে এক ধরনের গণ্ডগোল তৈরি করা যাতে মানুষের দৃষ্টি এদিক থেকে সরে যায়।’

তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগে অনেক অনেক দুর্নীতি হয়, তাদের চালক পর্যন্ত ১০০ কোটি টাকার মালিক হয়। সেজন্য এসব ইস্যু তৈরি করে দিয়ে ওগুলোকে ঢেকে রাখার প্রচেষ্টা।’

চিকিৎসকের ফি অবশ্যই চিকিৎসক নিজে নির্ধারণ করবেন। কারণ চিকিৎসকদের বাড়ি ভাড়া তো সরকার নির্ধারণ করে দেয়নি। চেম্বারের ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল কত হবে সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে? চেয়ার টেবিল, কম্পিউটারের দাম যে বছরে বছরে বাড়ে, সেগুলোর কি নির্দিষ্ট করা আছে? তাহলে শুধু চিকিৎসকদের ফিটাই নির্ধারণ হবে কেন? সুতরাং এমন সিদ্ধান্তকে আমরা নিন্দা জানাবো।

আব্দুন নূর তুষার, চিকিৎসক

এদিকে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমি আসলে গতকালের মিটিংটায় ছিলাম না, ওখানে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে তাও জানি না। আমি যতটুকু শুনেছি সেখানে আলোচনা করে একটা ফি নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এটা আসলে ঠিক হয়নি। বিগত দিনে অনেক সরকারি সব চিন্তা-ভাবনা করেছে, কিন্তু আর বাস্তবায়ন করতে পারেনি।’

তিনি বলেন, ‘একজন চিকিৎসক যদি হিসাব করে মনে করেন যে তিনি ১০০ টাকা বা ২০০ টাকা ফি নেবেন সেটা ওনার ব্যাপার। আবার কেউ যদি ফি না নিয়ে একদম বিনামূল্যে রোগী দেখেন, তাহলেও ওটা এটা ওনার ব্যাপার। আমার একজন ভালো অধ্যাপক যদি হিসাব করে মনে করেন, তার ৫০০ টাকা ফি নেওয়া দরকার, সেটাও ওনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সরকার ফি নির্ধারণ করে দিলেই কি রোগী সেভাবে আসবে বা উনি সেভাবে রোগী দেখবে? আমার তো সেটা মনে হয় না।’

আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের আহ্বান জানিয়ে বিএমএ সভাপতি বলেন, ‘চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়ে সবাই মিলে যদি আলোচনা করে একটা ফি ঠিক করে, আর এতে যদি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়, তাহলে আমরা সেটাকে খারাপ মনে করি না। তবে, সবাইকে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমেই হতে হবে। কিন্তু সেটা আদৌ হবে কিনা এটাই মূল বিষয়।’

মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন আরও বলেন, ‘ওষুধের দাম এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য নির্ধারণ না করে সরকার কেন চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ করতে চাই সেটা আমার জানা নেই। আর যারা এটা বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লেগেছে তারাই কতটা এটা বুঝে, অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তাদের কোনো চিন্তাভাবনা আছে কি না, নাকি শুধুমাত্র সাংবাদিকদের নিউজ করানোর জন্য এসব বিষয় বলা হচ্ছে এটা আমি জানি না।’

এ বিষয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে মোবাইল ফোনে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে এর আগে গতকাল (সোমবার) গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এ-সংক্রান্ত একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

তিনি আরও বলেন, অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানাকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন-বিএমএ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপ, বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন, প্রাইভেট মেডিকেল প্রাক্টিশনার অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল-বিএমডিসিসহ সব স্টেক হোল্ডারকে কমিটিতে রাখা হয়েছে। অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞাকে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য মহাপরিচালক বলেন, কমিটিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সময় দেওয়া হয়েছে। তারা আগামী দুই সপ্তাহ পরে যে প্রস্তাবনা দেবে সেটি পুনঃরায় পর্যালোচনা করা হবে।

টিআই/এসএম