জলাতঙ্ক একটি মরণব্যাধি, যা প্রাণি থেকে মানুষে ও প্রাণিতে সংক্রমিত হয়। সাধারণত কুকুর, বিড়াল, বানর, বেজি, শিয়ালের কামড় বা আঁচড়ে এ রোগটি সংক্রমিত হয়। জানা গেছে, বিশ্বে বছরে ৫৯ হাজারেরও অধিক মানুষ এ রোগে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশেও বছরে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী মৃত্যুবরণ করেন।

শুধু মানুষই নয়, প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার গবাদিপশুও জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে থাকে দেশে। এ অবস্থায় সচেতনতা ও টিকা প্রয়োগে গুরুত্বারোপ করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, টিকা নেওয়ার মাধ্যমে শতভাগ মৃত্যুরোধ করা সম্ভব।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সরকার প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখের অধিক জলাতঙ্ক সংক্রমণকারী প্রাণির কামড়/আঁচড়ের রোগীকে বিনামূল্যে জলাতঙ্কের টিকা প্রদান করছে। এর ফলে জলাতঙ্কে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।

এছাড়াও বর্তমানে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর নির্ভর করে পরিবেশে জলাতঙ্কের প্রধান উৎস কুকুরের মধ্যে ব্যাপকহারে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিন প্রদান করা হচ্ছে। ব্যাপকহারে কুকুরের টিকাদান (এমডিভি) কার্যক্রমের মাধ্যমে সারা দেশে ইতোমধ্যে ৬৪টি জেলায় ১ম রাউন্ড, ১৭টি জেলায় ২য় রাউন্ড এবং ৬টি জেলায় ৩য় রাউন্ড ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমের মাধ্যমে কুকুরকে প্রায় ২২ লাখ ৫১ হাজার ডোজ জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা প্রদান করা হয়েছে। যা মানুষ ও প্রাণিদেহে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের গাইডলাইন অনুসারে, বর্তমানে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিনের পূর্ণ ডোজ (প্রথম, তৃতীয় ও সপ্তম দিনে তিন ডোজ) এক সপ্তাহে দেওয়ার ফলে রোগীদের অর্থ ও সময় সাশ্রয় হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সব সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এর পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রাণিদেহে জলাতঙ্কের জীবাণু ল্যাবে নিশ্চিতকরণের কাজ করে চলেছে। এতে করে নির্দিষ্ট স্থানে এ রোগের উপস্থিতি ও প্রাদুর্ভাব নির্ণয় করে মানুষ ও প্রাণিদেহে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের পরিচালক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, জলাতঙ্কে আক্রান্ত হলে মূলত তিনটি লক্ষণ দেখা দেয়। সেগুলো হলো— পানিভীতি, আলোভীতি ও বায়ুভীতি। এ ধরনের লক্ষণ যখন দেখা দেয়, তখন রোগীকে আর বাঁচানো সম্ভব হয় না। শুধু পানির প্রতি আতঙ্কই নয়, জলাতঙ্কে আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণেও কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। অস্বাভাবিক কথাবার্তা ও ভাবভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তির উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো, ক্ষুধামান্দ্য, খাওয়া-দাওয়ায় অরুচি, বিকৃত আওয়াজ, কণ্ঠস্বর কর্কশ হয়ে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, বিনা প্ররোচনায় অন্যকে আক্রমণ বা কামড় দেওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি কিছু লক্ষণ প্রকাশ করতে পারেন।

তিনি বলেন, সাধারণত উপসর্গ দেখা দিলেই রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হয়। তবে উপসর্গ নিয়ে বেশিরভাগ রোগীই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। অনেক সময় আমরা যখন জানাই রোগীকে বাঁচানো সম্ভব না, তখন পরিবার তাদের হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায়।

মিজানুর রহমান বলেন, উপসর্গের বিষয়টি নির্ভর করে মূলত কোন স্থানে কামড় দিয়েছে সেটার ওপর নির্ভর করে। যেহেতু এই রোগটি ব্রেনে আক্রান্ত করে থাকে। সেক্ষেত্রে মাথার যত কাছাকাছি প্রাণীর আক্রমণের শিকার হয় তত দ্রুত উপসর্গ দেখা দেয়। সেজন্য গৃহপালিত প্রাণি যেমন কুকুর কিংবা বিড়াল যখন কামড় দেয় তখন ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই টিকা নিয়ে নিতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শ. ম. গোলাম কায়ছার বলেন, সরকারের নানাবিধ স্বাস্থ্য উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের ফলে জলাতঙ্ক রোগের সংক্রমণ কমে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারা দেশে জেলা ও উপজেলা হাসপাতাল পর্যায়ে ৩০০টির অধিক জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, ঢাকার মহাখালীতে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ও ৫টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে জলাতঙ্কের আধুনিক চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসব কেন্দ্রে কুকুর বা অন্যান্য প্রাণির কামড়/আঁচড়ের আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি বিনামূল্যে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা ও কামড়ের ধরন অনুযায়ী আরআইজি প্রদান করা হচ্ছে।

অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম সামাজিক জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে লিফলেট, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন, ফেস্টুন, বিভিন্ন দিবস পালন, ক্রোড়পত্র প্রকাশ, স্কুল প্রোগ্রাম, জনবার্তাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, আজ (২৮ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস। জলাতঙ্কের টিকা আবিষ্কারক বিখ্যাত বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর ১৮৯৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তার প্রয়াণ দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০০৭ সাল থেকে পৃথিবীব্যাপী বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস পালিত হবে। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘জলাতঙ্কঃ মৃত্যু আর নয়, সবার সাথে সমন্বয়’। এ প্রতিপাদ্যে প্রধানত জলাতঙ্ক, মৃত্যু ও সমন্বয় এ তিনটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং বাংলাদেশ সরকার, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংগঠনের পারস্পরিক সমন্বয়ের ভিত্তিতে জলাতঙ্কে মৃত্যু হার শূন্যে আনা সম্ভব।

টিআই/এসএসএইচ