প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সারাদেশে টিকা প্রয়োগ কার্যক্রম চলছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, দেশে এখন পর্যন্ত (২০ মার্চ) মোট ৪৭ লাখ ৬০ হাজার ৭৪৭ জন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়েছেন। এদের মধ্যে মোট নয়শ জনের জ্বর, সর্দির মতো সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ টিকায় অন্তত ৩০ জনের রক্ত জমাট বাঁধার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টিকে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই রক্ত জমাট বাঁধার সঙ্গে টিকার কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি। সুতরাং এসব অপপ্রচারে মানুষ যেন টিকা গ্রহণ থেকে বিরত না থাকে।

শনিবার (২০ মার্চ) স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় মোট টিকা নিয়েছেন ৭২ হাজার ৯২৩ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ৪০ হাজার ৪৭৭ জন এবং নারী ৩২ হাজার ৯২৩ জন। তার মধ্যে মাত্র তিন জনের সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, টিকা গ্রহীতাদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৭৪ জন টিকা নিয়েছেন। আর সর্বনিম্ন দুই লাখ ১০ হাজার ৭৮৪ জন টিকা নিয়েছেন ময়মনসিংহ বিভাগে।

সম্প্রতি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার সন্দেহজনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। নরওয়ে সর্বপ্রথম রক্ত জমাট বাঁধার কয়েকটি সন্দেহজনক কেসের ওপর ভিত্তি করে টিকাদান কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করে। এরপর ইতালি, আইসল্যান্ড, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, নেদারল্যান্ডস, থাইলান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখে।

রক্ত জমাট বাঁধা কি টিকার কারণে?
রক্ত জমাট বাঁধা বিশ্বব্যাপী একটি স্বাভাবিক ঘটনা। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) তথ্যানুযায়ী, শুধু আমেরিকায় প্রতি এক হাজারে এক বা দুজনে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ধরা পড়ে এবং প্রতিবছর ৬০ হাজার থেকে এক লাখ মানুষ (মূলত বয়স্ক) মারা যায় এই রক্ত জমাটা বাঁধার কারণে।

ইউরোপে এ পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়েছে। এর মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনার পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধি পায়নি। ৮ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত ইউরোপে মোট ৩৭টি রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই ৩৭টি ঘটনা স্বাভাবিকের চেয়েও কম। আরেকটি বিষয় হচ্ছে যে ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্নার টিকার ক্ষেত্রে মোটামুটি একই হারে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটেছে।

যা বলছেন দেশের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাক্তার সুলতানা শাহানা বানু ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে টিকা গ্রহীতার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এর কারণ হয়তোবা টিকা নিয়ে মানুষের মনে ভয় ঢুকে গেছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে যে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নেওয়ার পর রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে, অনেকেই মারা যাচ্ছে।

তিন বলেন, ইতোমধ্যে অনেকগুলো দেশে এই টিকা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও এটা নিয়ে এখনও তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। সুতরাং তারাও বলতে পারছে না যে অক্সফোর্ডের টিকার কারণেই রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে।

আশঙ্কা প্রকাশ করে শাহানা বানু বলেন, টিকা গ্রহণের পর রক্ত জমাট বাঁধা নিয়ে যেহেতু একটা অভিযোগ উঠেছে সেহেতু বিষয়টাকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। টিকা নেওয়ার পর এমনটা হতেও পারে। কারণ হলো একটি বা দুইটি দেশে করোনায় রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটেনি। দশ-বারোটি দেশেই এ টিকা দেওয়ার পর এরকমটা হয়েছে। এরপরই ওই দেশগুলোতে টিকা কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হলো, আর এই আটটি দেশেই একই ধরনের লক্ষণ দেখা গেল। টিকা দেওয়ার পরপরই এ ঘটনা ঘটেছে।

তিনি আরও বলেন, রক্ত জমাট বাঁধার পর তাদের অনেকেই আইসিইউ থেকে একেবারে কোমায় চলে গেছে। সুতরাং বিষয়টা কোনভাবেই হাল্কা করে নেওয়ার সুযোগ নেই, অবশ্যই এটি নিয়ে বিস্তর গবেষণা হওয়া উচিত এবং হচ্ছে।

ইউজিসি অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন পর্যন্ত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার বড় ধরনের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এই টিকা নেওয়ার পর রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া বা মারা যাওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।

তিনি বলেন, মিডিয়াগুলোকে যে কোনো খবর পরিবেশনের আগে আরেকটু সচেতন হতে হবে। কেউ একটা কিছু বললেই তো সেটা খবর বানিয়ে ফেলা যাবে না। টিকা নেওয়ার পর রক্ত জমাট বাঁধার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আজও বলেছে যে এটা ঠিক না।

বিভিন্ন দেশে অক্সফোর্ডের টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মানুষের মনে ভয় কাজ করছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ভয় তো অবশ্যই কাজ করছে এক্ষেত্রে আমাদের সবার উচিত মানুষের সামনে সঠিক বিষয়টা তুলে ধরা। মিডিয়াগুলো এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছি।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের নতুন ধরনে সব বয়সের মানুষই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। তবে আক্রান্তদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই বেশি দেখা যাচ্ছে। কারণ একটাই, তরুণরা হয়তো নিজেদের সুপারপাওয়ার মনে করে। যে কারণে তারাই সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া চলাচল করে। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা, চলাফেরায় তারা মাস্ক পরেনা, স্বাস্থ্যবিধি মানে না, এটাই মূল কারণ। যে যে বয়সেরই হোক স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সামনে বিপদ আছে, সেজন্য অবশ্যই সচেতন হতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. শাহরিয়ার মোহাম্মদ রোজেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (ইএমএ) দাবি, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ‘নিরাপদ ও কার্যকর’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও টিকাটির কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার তাগিদ দিয়েছে।

তিনি বলেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি এবং স্পেন পুনরায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। এদিকে, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ অধিকাংশ দেশ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়া অব্যহত রেখেছে।

প্রাকৃতিক নিয়মেই বিশ্বে প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে একজন রক্ত জমাট বাঁধাজনিত রোগ দেখা যায়। কাজেই রক্ত জমাট বাঁধার সঙ্গে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার কোনো যোগসূত্ৰ নেই। বাংলাদেশে প্রাপ্ত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ‘নিরাপদ ও কার্যকর’। ভ্যাকসিন নিয়ে করোনা মহামারি প্রতিরোধ করুন।

স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশিদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, টিকা নেওয়ার পর রক্ত জমাট বাঁধার বিষয়টি একেবারেই সঠিক নয়। আমরা জানতে পেরেছি এটি হলো অ্যাস্ট্রাজেনেকার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক একটি প্রোপাগান্ডা। এটা হল গ্লোবাল ভ্যাকসিন পলিটিক্স। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে এ টিকা অত্যন্ত নিরাপদ।

এদিকে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকায় রক্ত জমাট বাঁধা ও বিভিন্ন দেশে টিকা কার্যক্রম স্থগিত করে দেওয়ার প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দু-য়েকটা দেশে অক্সফোর্ডের টিকা স্থগিতের কথা আমরা শুনেছি। তবে রক্ত জমাট বাঁধার সঙ্গে টিকার কোনো সম্পর্ক নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলেছে, এটা নিরাপদ। এই টিকা ব্যবহার করা চলবে। এখানে কোনো বন্ধ করার বিষয় নেই। আমরাও চালাবো।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা বহু দেশে ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের দেশে ব্যবহার হচ্ছে, ইংল্যান্ড ও পার্শ্ববর্তী ভারতেও ব্যবহার হচ্ছে, কোথাও স্থগিত হয়নি। দু-য়েকটা দেশে এটা স্থগিতের কথা আমরা শুনেছি। তারা কিছুদিন দেখবে এবং পরর্বতী সময়ে আবার শুরু করে দেবে।

জাহিদ মালেক বলেন, সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ডের যে টিকাটি আমরা আনছি, সেটি অত্যন্ত ভালো। সেটা প্রায় আমাদের ৫০ লাখ জনগণকে দিয়েছি। সেটা আমরা বেক্সিমকোর মাধ্যমে আনছি। তারা হলো এ টিকার লোকাল এজেন্ট। সামনে যদি আরও লাগে সেটাও আমরা অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন গ্রহণ করব।

অ্যাস্ট্রাজেনেকা কী বলছে?

টিকার সঙ্গে রক্ত জমাটের ঝুঁকি বাড়ার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই বলে জানিয়েছে টিকা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা। তারা বলছে, ইউরোপে এক কোটি ৭০ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র ৩৭টির মতো রক্ত জমাটের ঘটনা ঘটেছে, এবং যারা এ টিকা নেয়নি তারাও একই সময়ে সমান সংখ্যায় রক্ত জমাটের শিকার হয়েছে।

কোম্পানির প্রধান মেডিকেল অফিসার অ্যান টেইল বলেন, ইউকে এবং ইইউতে প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ ইতোমধ্যেই আমাদের টিকা নিয়েছেন। এমনিতেই শত শত মানুষ স্বাভাবিক সময়েই রক্ত জমাটের শিকার হন। সেই তুলনায় ভ্যাকসিন নেওয়া মানুষদের মধ্যে রক্ত জমাটের সংখ্যা অনেক অনেক কম।

তিনি বলেন, মহামারির কারণে বিচ্ছিন্ন প্রতিটি ঘটনার ওপর এখন নজর অনেক বেশি, এবং মানুষের নিরাপত্তার জন্য অনুমোদিত ভ্যাকসিনের প্রতিক্রিয়ার ওপরও স্বাভাবিক এবং প্রচলিত নজরদারির চেয়ে অনেক বেশি নজরদারি হচ্ছে।

বর্তমানে বিশ্বের ৬৫টি দেশ এবং অঞ্চলে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকোর এ টিকা দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো আরও কয়েকটি দেশে শুধু এ টিকাই ব্যবহার করা হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র মার্গারেট হ্যারিস শুক্রবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, অক্সফোর্ডের টিকার ব্যবহার চালিয়ে যাওয়া উচিত। আমরা যা দেখব তা আমরা সব সময় দেখে থাকি—যেকোনো নিরাপত্তা সংকেত অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।

বিশ্বে করোনার সবশেষ পরিস্থিতি
বৈশ্বিক মহামারি শুরু হয়েছে এক বছরেরও বেশি সময়ে হয়ে গেল। এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টিকা প্রয়োগ শুরু হয়েছে। প্রাণঘাতী এই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে এ পর্যন্ত (২১ মার্চ) ২৭ লাখ ২২ হাজার ৩২ জন মারা গেছে। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছে নয় কোটি ৯৪ লাখ ১৫ হাজার ৭৯৬ জন।   

টিআই/এসএম