দেশের মোট মাতৃমৃত্যুর ২৪ শতাংশই গর্ভাবস্থায় হাইপারটেনসিভ (উচ্চরক্তচাপ জনিত) রোগে হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া আরও ৩১ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হয় প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণের জন্য, যা ভয়াবহ জেস্টোসিস রোগের অন্যতম কারণ বলেও মনে করেন তারা।

শনিবার (২০ মে) রাতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ চ্যাপ্টার অব অর্গানাইজেশন জেস্টোসিস ও অবস্টেট্রিকাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে এসব কথা বলেন বক্তারা।

তারা বলেন, গর্ভবতী মায়েদের জন্য জেস্টোসিস খুবই ভয়াবহ একটি রোগ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের সম্মিলিতভাবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ করতে হবে, যা প্রসূতি ও গাইনোকোলজির অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাবে। যার ফলে মা, মহিলা এবং নবজাতকের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে। জেস্টোসিসজনিত মৃত্যু কিভাবে শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে আনা যায় সে সম্পর্কেও তারা সচেতনতায় জোর দেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, গর্ভাবস্থায় নারীদের উচ্চরক্তচাপ এবং এর জটিলতা সম্পর্কে গাইনি চিকিৎসকদের নিয়ে আজকের এ আয়োজন। আমি মনে করি, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ গর্ভ অবস্থায় উচ্চরক্তচাপ হয়, এমন শতকরা ১০ শতাংশ নারী পাওয়া যায়। এ অবস্থায় যদি যথাযথভাবে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা না হয়, তাহলে মায়ের ঝুঁকি ও জটিলতার সম্ভাবনা থাকে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুও হতে পারে। তেমনি গর্ভের বাচ্চাদেরও জটিলতা হতে পারে, এমনকি সেটা সন্তানের মৃত্যুর কারণও হতে পারে। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে চিকিৎসকদের বেশি করে জানা উচিত।

এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, শুধু গর্ভবতী মায়ের ক্ষেত্রেই নয়, যে কারোর জন্যই উচ্চরক্তচাপ ঝুঁকির কারণ। কেউ যদি এটাকে কন্ট্রোল না করেন, তাহলে ব্রেন অ্যাটাক হয়ে স্ট্রোক হতে পারে। এমনকি হার্ট অ্যাটাক করে হার্ট ফেইলিওর হতে পারে। এছাড়া কিডনি ফেইলিওরসহ চোখেরও ক্ষতি হতে পারে। সুতরাং এ বিষয়গুলোতে চিকিৎসকদের জোর দিতে হবে।

তিনি বলেন, অধিকাংশ নারীরাই এ বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেন না। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের উচিত নিজ দায়িত্বে একটু সময় বেশি দিয়ে রোগীকে বোঝানো এবং সচেতন করা। শুধু রোগী এলো আর চিকিৎসক চিকিৎসা করে দিলো, এমনটা যেন না হয়। চিকিৎসার পাশাপাশি চিকিৎসকদের রোগ প্রতিরোধেও কাজ করা উচিত।

উচ্চরক্তচাপের কারণ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট এ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, সাধারণত উচ্চরক্তচাপের জন্য আমরা অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসকেই দায়ী করি। আমরা যে পরিমাণ খাই, সেই তুলনায় শরীর থেকে ক্যালরি বের করি না। আমরা এখন পাঁচ মিনিট হাঁটতে চাই না, একটু সময় করে শারীরিক ব্যায়াম করতে পারি না। সঙ্গে থাকে সংসার পরিবার নিয়ে নানা দুশ্চিন্তা। এছাড়াও এর সঙ্গে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহারও বড় একটা ভূমিকা পালন করে।

অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা বেগম বলেন, জেস্টোসিস রোগের মূল উপাদান হলো প্রি-একলামশিয়া ও একলামশিয়া। এ রোগটি যদি সময়মতো নির্ণয় এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা না যায়, তাহলে মা এবং নবজাতকের মৃত্যু হয়ে থাকে। একলামশিয়া হলে গর্ভবতী মায়ের খিঁচুনি হয়। আমাদের দেশে এ রোগের কারণে মৃত্যুর হার ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি বছরে যে পরিমাণ মায়ের মৃত্যু হয়, তাদের মধ্যে প্রতি ১০০ জনে ২৪ জনের একলামশিয়ায় মৃত্যু হয়। আর ৩১ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হয় প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণের জন্য, যেটিও জেস্টোসিসের একটি রিচ-ফ্যাক্টর। এ যে শতকরা ৫৫ শতাংশ মায়ের মৃত্যু, যদি সময়মতো জেস্টোসিস রোগ নির্ণয় করা যায়, একইসঙ্গে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তাহলে মৃত্যুগুলো রোধ করা সম্ভব হয়। তবে আমাদের দেশে একলামশিয়ায় আগের তুলনায় মৃত্যুর হার কমেছে।

গর্ভবতী মায়েদের করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জেস্টোসিস থেকে বাঁচতে মায়েদের অ্যান্টিনেটাল চেকআপ করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে অ্যান্টিনেটাল চেকআপের হার খুবই কম। ৪৭ ভাগ মায়েরা শুধু ৪টি অ্যান্টিনেটাল চেকআপ নেয়, বাকিগুলোও নিতে হবে যে সেটিও জানেন না। এজন্য আমরা বলি যে, গর্ভাবস্থায় মায়েদের অ্যান্টিনেটাল চেকআপ খুবই জরুরি। একইসঙ্গে হসপিটাল ডেলিভারি বাড়াতে হবে, ডেলিভারির পরে যে কেয়ার নেওয়া হয়, সেটিও বাড়াতে হবে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ চ্যাপ্টার অব অর্গানাইজেশন জেস্টোসিসের সভাপতি অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসী বেগম। এছাড়া অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. টিটো মিয়া। ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. টিএ চৌধুরী, ওজিএসবির সাবেক সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক শাহলা খাতুন, বাংলাদেশ চ্যাপ্টার অব অর্গানাইজেশন জেস্টোসিসের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ানসহ আরও অনেকে।

টিআই/এফকে