দেশে গত এক সপ্তাহে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ডেঙ্গু সংক্রমণ। সাধারণত বর্ষাকালে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার বিস্তার হয়ে থাকে। তবে বর্ষা শুরুর আগেই এ বছর ডেঙ্গুর যে চিত্র সামনে আসছে, তা বিশেষজ্ঞদের মনে ভয় ধরাচ্ছে।  

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এ বছরের প্রথম ৫ মাসে যে পরিমাণ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তা গত বছরের তুলনায় পাঁচ গুণ। গত বছর এই সময়ে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্য থাকলেও এবার এরইমধ্যে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ জনে। 

এ অবস্থায় এডিস মশার বংশ বিস্তারের লাগাম টেনে না ধরলে দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের নতুন ইতিহাস তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ৬০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩০, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিডফোর্ড) হাসপাতালে ২৪ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯ জন, শিশু হাসপাতালে ৫ জনসহ সরকারি হাসপাতালগুলোতে ১৪৪ জন ভর্তি আছেন। আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন ইসলামি ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে, সেখানে ১৯ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। 

মুগদা মেডিকেলে শিশুদের জন্য এই প্রথম আলাদা শিশু ওয়ার্ড
ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধির পাওয়ার কারণে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে শিশুদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড প্রস্তুত করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, এই প্রথম হাসপাতালটিতে ডেঙ্গুর জন্য আলাদা শিশু ওয়ার্ড প্রস্তুত করা হয়েছে। শিশুদের ওপর ডেঙ্গু সহজেই ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, এই কারণেই শিশুদের জন্য হাসপাতালটিতে আলাদা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 

মুগদা হাসপাতালের ডেঙ্গু শিশু ওয়ার্ডে একই পরিবারের দুই ভাই-বোন চিকিৎসা নিচ্ছে। তারা যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে এসেছে। এই দুই শিশুর মা আফরোজা আক্তার জানান, প্রথমে তার ছেলে জ্বরে আক্রান্ত হয়, এর দুইদিন পর মেয়ে আক্রান্ত হয়। জ্বর বেশি হওয়ায় তাদের বাড়িতে রাখা সম্ভব হয়নি। হাসপাতালে ভর্তি করার পর জানা যায় তারা ডেঙ্গু আক্রান্ত।

আফরোজা আক্তার বলেন, আমার বাসা যাত্রাবাড়ী এলাকায়। ওই এলাকায় প্রতি বিল্ডিংয়েই অন্তত একজন জ্বরের রোগী। অনেকেই বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন, হাসপাতালে আসছেন না। সবার পরীক্ষা করলে হয়তো অধিকাংশেরই ডেঙ্গু সংক্রমণ ধরা পড়তে পারে।

মুগদা এলাকার মারুফ হোসেনও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। তিনি বলেন, তিনদিন যাবৎ হাসপাতালে ভর্তি আছি। শুরুতে অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এখন আলহামদুলিল্লাহ কিছুটা ভালো। ডাক্তার বলেছে কাল-পরশু বাসায় চলে যেতে পারব।

২৪ ঘণ্টা ডেঙ্গু পরীক্ষা চালু
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, শিশু ওয়ার্ডে ১০ জন ও ৫০ জন প্রাপ্তবয়স্কসহ মোট ৬০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা ডেঙ্গু পরীক্ষা চালু রাখা হয়েছে। 

আরও পড়ুন : আর্জেন্টিনায় ডেঙ্গু দমনে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার!

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান

মুগদা হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, সারা দেশের মধ্যে এখন এই হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। 

এই হাসপাতালে আসা রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি জানান, যাত্রাবাড়ী ও আশপাশের এলাকা থেকেই বেশি রোগী আসছে।  

হাসপাতাল পরিচালক বলেন, গত ১৫ থেকে ২০ দিন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।  

চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১৮শ জন। এর মধ্যে মে মাসেই শনাক্ত হয়েছেন ৮শ রোগী। এ রোগীরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকার। 

মুগদা হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলছেন, শনির আখড়া, কুতুবখালী, কাজলা এলাকার পাশাপাশি মান্ডা, মুগদা, সবুজবাগ এলাকার কিছু রোগীও পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে আস্তে আস্তে ডেঙ্গু সংক্রমণ স্প্রেড করছে। সামনের দিনে সংক্রমণকে নির্দিষ্ট এলাকায় রাখা আরও কঠিন হয়ে যাবে।

করণীয় প্রসঙ্গে নিয়াতুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের সতর্ক হতে হবে। সেইসঙ্গে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাও লাগবে। আমরা সবাই মিলে যদি চেষ্টা করি, তাহলে নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। কারণ এই কাজটিতে ব্যক্তি, পরিবার, সিটি কর্পোরেশন, এলজিআরডি মন্ত্রণালয়, চিকিৎসক এবং হাসপাতালসহ সবারই ভূমিকা আছে। সবাই মিলে সমবেতভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে, আর নয়তো বাড়তেই থাকবে।

হটস্পট চিহ্নিত করে মশা নিধন জরুরি 
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এডিস মশা নির্মূলে পুরো দেশে মশা নিধন প্রক্রিয়া অসম্ভব। তাই সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগীর আবাসস্থল চিহ্নিত করে এডিস মশা নিধন কার্যক্রম পরিচালনার পরামর্শ তাদের।

বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার জানান, ডেঙ্গু রোগীর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এডিস মশার লার্ভা ধ্বংসে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় এ রোগের বিস্তার রোধ অসম্ভব হয়ে পড়বে। 

তিনি আরও বলেন, ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর হটস্পট শনাক্ত করা জরুরি। প্রয়োজনে হাসপাতালগুলো থেকে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য সংগ্রহ করে উচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা নির্ধারণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গু রোগীরা যে বাড়ি থেকে আসছে, সে বাড়ির আশপাশের উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। কারণ, এই উড়ন্ত মশাগুলোই একেকটা ডেঙ্গু রোগের বাহক। স্বাভাবিকভাবেই এই মশাগুলো বেঁচে থাকলে আরেকজন সুস্থ মানুষকে আক্রান্ত করবে। মশা নিধনের এ প্রক্রিয়াটিকে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। যেসব জায়গায় এখনও ডেঙ্গু হয়নি, সেসব জায়গায় এডিস মশা ধ্বংস করে দিতে হবে।  

মশা মারার বন্দোবস্ত করতে হবে : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডেঙ্গুর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অংশে রয়েছে পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট। আমাদের পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইনটি পুরোপুরি আপডেট করা আছে। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু কর্নার, ডেঙ্গু ওয়ার্ড অথবা ডেঙ্গু রোগী ম্যানেজমেন্টের জন্য বিশেষায়িত ইউনিটের ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া আছে। পরীক্ষা, চিকিৎসা কেমন হবে, সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দেওয়া আছে। আমাদের অংশে আমরা এর প্রস্তুতিগুলো অনেক আগে থেকেই নিয়ে আসছি। এখন মশার উৎপত্তি যদি বন্ধ না হয়, তাহলে আমরা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবো? 

আরও পড়ুন : মশা নিধন : আর্থিক ক্ষতি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

তিনি বলেন, আমাদের সীমিত সম্পদ, সীমিত জনবল দিয়ে আমরা সর্বোচ্চটা করে যাচ্ছি। ঢাকা শহরে আমরা ৯টা সার্ভে করি। সঙ্গে সঙ্গে আমরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশনকে এর রিপোর্ট দেই, পরবর্তীতে তারা নিজেদের মতো করণীয় ঠিক করেন। অর্থাৎ আমাদের অংশে আমরা সব কাজ করে ফেলেছি। বাকিটা স্থানীয় সরকার এবং সিটি করপোরেশনকেই দেখতে হবে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আরও বলেন, মশা মারার বন্দোবস্ত করতে হবে। এই কার্যক্রম টেকসই হতে হবে। পাশাপাশি কমিউনিটি এঙ্গেজমেন্টটাও খুবই জরুরি। তাহলে পরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের বুধবারের তথ্যমতে, সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৯৫ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন; যা চলতি বছরের একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ।  

এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮২ জন ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৩ জন। তবে এ সময়ে ডেঙ্গুতে কারো মৃত্যু হয়নি।

টিআই/এনএফ