ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাজেদুর রেজা ফারুকী। এর আগে তিনি চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় আসামির দায়ের কোপে পুলিশ সদস্য জনি খানের বিচ্ছিন্ন হওয়া হাত জোড়া লাগিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন।

রোববার (৪ জুন) সকাল সাড়ে ৬টায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর আল মানার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

নিটোরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মাহফুজুল হক তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডা. সাজেদুর রেজা ফারুকীর মতো মানুষ হয় না। তিনি একজন অমায়িক মানুষ ছিলেন। হাসপাতালই ছিল ওনার বাসার মতো। রাত একটা-দুইটার সময়েই তিনি হাসপাতালে এসে রোগীদের খোঁজ-খবর নিতেন।

তিনি বলেন, ডা. সাজেদুর রেজা অনেক বড় মাপের চিকিৎসক ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের জন্য কিংবদন্তী চিকিৎসক। তার হাত ধরে অসংখ্য মানুষের হাত জোড়া লেগেছে। সর্বশেষ গত বছরের মে মাসে তিনি দীর্ঘ সাড়ে নয় ঘণ্টার অপারেশনে আসামির দায়ের কোপে বিচ্ছিন্ন হওয়া পুলিশ কনস্টেবলের (জনি খান) হাতের কবজি জোড়া লাগিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন।

মাহফুজুল হক তালুকদার বলেন, সেই পুলিশ কনস্টেবলের মতো তিনি এরকম আরও কত হাজার অসহায় মানুষের হাত ও পা বাঁচিয়ে পঙ্গুত্বের অভিশাপ থেকে বাঁচিয়েছেন, তা স্যারের কাছাকাছি আমরা যারা ছিলাম শুধু তারাই জানি। তার মৃত্যু দেশের জন্য যে কত বড় ক্ষতি, এটা হয়ত আমরা ধারণাও করতে পারি না। আগামী ১০০ বছরে স্যারের মতো ডেডিকেটেড সার্জন আসবেন কি না জানা নেই।

জানা গেছে, ডা. সাজেদুর রেজা ফারুকী নিটোরের হ্যান্ড অ্যান্ড মাইক্রোসার্জারি বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তিনি নিজ খরচে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং কঠোর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে অর্জিত দক্ষতায় গত ২০ বছর ধরে স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছেন। বিস্তৃত কর্মজীবনে এ রকম বহু জটিল অস্ত্রোপচারে দেখেছেন সাফল্যের মুখ। দলগতভাবে করোনা-ডেঙ্গুর মতো দুর্যোগেও অব্যাহত রাখেন স্বাস্থ্যসেবা।

বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির সেক্রেটারি জেনারেল ও নিটোর হাসপাতালের অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন,  ডা. সাজেদুর রেজা ফারুকীর এই আকস্মিক মৃত্যু মেনে নেওয়ার মতো না। আমি দীর্ঘদিন তার সঙ্গে কাজ করেছি। ব্যবহারে তিনি যেমন ছিলেন অমায়িক, কাজেও তিনি ছিলেন সেরা। যখনই দেখা হতো, সবসময় তিনি হাসিমুখে কথা বলতেন।

তিনি বলেন, ডা. ফারুকীর মৃত্যুতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা অপূরণীয়। মানুষের সেবা করেই তিনি জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির পক্ষ থেকে ডা. সাজেদুর রেজা ফারুকীর মৃত্যুতে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে আমরা বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। পাশাপাশি তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।

স্মৃতিচারণ করে প্রবাসী বাংলাদেশি আরেক চিকিৎসক ডা. বিএম আতিকুজ্জামান বলেন, ডা. সাজেদুর রেজা ফারুকীকে আমরা রকি নামেই ডাকতাম। রকির প্রাণশক্তি দেখে আমি অবাক হতাম। আমি ১৯৮৯ সালে প্রথমবার মেডিকেল কলেজের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হলাম। প্রকাশনার কাজে অনেক সময় প্রেসে কাটাতাম। রকি মহা আগ্রহে আমাদের সঙ্গে যেত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, রাতের পর রাত জেগে কাজ করত। আমি ওর আগ্রহ দেখে অবাক হতাম। ও একাগ্রচিত্তে কাজ দেখত এবং তা পরবর্তী সময়ে নিজেই করতো।

তিনি বলেন, রকি কাজ করতো নিজ আনন্দে। কোনও প্রাপ্তির প্রতি তার আগ্রহ ছিল না। খ্যাতিবান হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার মাঝে দেখিনি। সর্বশেষ দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল না। হঠাৎ করে জানলাম রকি বিখ্যাত হ্যান্ড সার্জন হয়ে গিয়েছে। কাটা হাত জোড়া লাগিয়ে সে চমক দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। আজ হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলে সে। আল্লাহ তাকে চিরশান্তিতে রাখুন।

এক নজরে ডা. সাজেদুর রহমান ফারুকী

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার দেহুন্দা গ্রামের সন্তান ডা. সাজেদুর রহমান ফারুকীর জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর, কুষ্টিয়ায় নানা বাড়িতে।

তিনি ১৯৮৪ সালে এসএসসি ও ১৯৮৬ সালে রাজধানীর নটরমেড কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেন।

এরপর চিকিৎসা সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। সেখান থেকে ১৯৯৩ সালে এমবিবিএস পাস করেন তিনি। ডা. সাজেদুর রহমান ফারুকী জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) থেকে অর্থোপেডিকসে এমএস পাস করেন।

পরে তিনি নিজস্ব অর্থায়নে ভারতের গঙ্গা ও বুম্বে হাসপাতাল এবং সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন।

তার বাবা ছিলেন বাংলাদেশ অ্যাটমিক অ্যানার্জি কমিশনের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা। ইংল্যান্ডে পিএইচডি পড়াকালীন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষ নেন দেশের এই প্রথম জিওফিজিস্ট (ভুগোল-পদার্থ বিদ্যায় বিশেষজ্ঞ)।

টিআই/কেএ