১৯৭১ সাল, দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের সীমাহীন বৈষম্য আর কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছিল বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৫২ বছরে বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়ানোর পাশাপাশি ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জনে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।

জানা গেছে, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭.৫ কোটি, পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৪.৫ কোটি। বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সফলতার কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি, অন্যদিকে পাকিস্তানের জনসংখ্যা এক লাফে ২৫ কোটিতে পৌঁছে গেছে।

এক সময়ে যেই দেশটি বাংলাদেশের ওপর চালিয়েছিল কর্তৃত্ববাদের খড়গ, সেই দেশটি আজ বিশাল জনসংখ্যার বোঝা মাথায় নিয়ে চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। ১৯৭০ সালেও একত্রে থাকা দুটি দেশের মধ্যে কোন জাদুর কাঠির বলে এমন সফলতা পেয়েছে একটি দেশ? বিশেষজ্ঞদের মতে, সফলতার অন্যতম কারণ হলো- পরিবার পরিকল্পনার সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল নির্ধারণ এবং সুষ্ঠু তদারকির মাধ্যমে দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) ১৯৯৯-২০০০ সালের জরিপ মতে, সেই সময়ে বাংলাদেশের টিএফআর ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, এরপর ২০০৪ সালে ৩ শতাংশ, ২০০৭ সালে ২ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর ২০১১, ২০১৪, ২০১৭-১৮ এবং সর্বশেষ ২০২২ বিডিএইচএসের জরিপমতে, দেশের মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ৩ শতাংশেই অবস্থান করছে।

বিডিএইচএসের ২০২২ সালের জরিপ বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশের একজন নারী তার জীবদ্দশায় গড়ে ২ দশমিক ৩টি সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকেন। আর শহর এলাকায় টিএফআর ২ দশমিক ১ এবং গ্রামীণ এলাকায় ২ দশমিক ৪ শতাংশ।

নতুন তথ্য বলছে, বর্তমানে ময়মনসিংহে সর্বোচ্চ টিএফআর (২.৭) এবং রাজশাহীতে সর্বনিম্ন (২.০)। শুধুমাত্র রাজশাহীরই টিএফআর ২.১ বা তার নিচে আছে। এছাড়াও চারটি বিভাগের (বরিশাল চট্টগ্রাম ময়মনসিংহ এবং রংপুর) টিএফআর ২.৫ বা তারও বেশি।

কোন বিভাগে প্রজনন হার বেড়েছে-কমেছে কতো?

বিডিএইচএসের ২০১১ সালের জরিপ বলছে, সেই বছরে বরিশালের প্রজনন হার ছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ, চট্টগ্রামের ২ দশমিক ৮ শতাংশ, ঢাকায় ২ দশমিক ২ শতাংশ, খুলনায় ১ দশমিক ৯ শতাংশ, রাজশাহী ২ দশমিক ১ শতাংশ, রংপুরে ২ দশমিক ১ শতাংশ আর সিলেটে ৩ দশমিক ১ শতাংশ।

২০১৪ সালের জরিপ বলছে, সেই বছরটিতে বরিশালে প্রজনন হার ছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ, চট্টগ্রাম ২ দশমিক ৫ শতাংশ, ঢাকা ২ দশমিক ৩ শতাংশ, খুলনায় ১ দশমিক ৯ শতাংশ, রাজশাহী ২ দশমিক ১ শতাংশ, রংপুর ১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সিলেটে ২ দশমিক ৯ শতাংশ। ওই বছর দুটিতে ময়মনসিংহ জেলা হিসেবে স্বীকৃত ছিল, যা ঢাকা বিভাগের অধীনস্থ ছিল।

এরপর বিডিএইচএসের ২০১৭-১৮ জরিপ বলছে, বরিশালে বছরটিতে টিএফআর ছিল ২ দশমিক ৪ শতাংশ, চট্টগ্রাম ২ দশমিক ৫ শতাংশ, ঢাকা ২ দশমিক ২ শতাংশ, খুলনা ১ দশমিক ৯ শতাংশ, ময়মনসিংহে ২ দশমিক ৫ শতাংশ, রাজশাহীতে ২ দশমিক ১ শতাংশ, রংপুরের ২ দশমিক ১ শতাংশ এবং সিলেটের ২ দশমিক ৬ শতাংশ।

সর্বশেষ ২০২২ সালের জরিপে দেখা গেছে, বরিশালে টিএফআর ছিল ২ দশমিক ৫ শতাংশ, চট্টগ্রাম ২ দশমিক ৬ শতাংশ, ঢাকা ২ দশমিক ৩ শতাংশ, খুলনা ২ দশমিক ২ শতাংশ, ময়মনসিংহে ২ দশমিক ৭ শতাংশ। এছাড়াও রাজশাহীতে ২ শতাংশ, রংপুরের ২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সিলেটে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।

কাঙ্খিত সন্তান লাভের আশা ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রভাব

ময়মনসিংহ নগরীর আনন্দমোহন কলেজ এলাকায় বসবাস বাংলাদেশ পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদে চাকরিরত মো. রুহুল আমিনের। আর্থিক সক্ষমতা ভালো থাকায় এবং ‘কাঙ্ক্ষিত’ একটি সন্তান লাভের আশায় তিনি এখন তিন সন্তানের বাবা। প্রথম-দ্বিতীয় সন্তান ছেলে হওয়ার পর একটি মেয়ে সন্তানের মুখ দেখতে চেয়েছিল তার পরিবার, তবে তৃতীয় সন্তানও এসেছে সেই ছেলেই। যেকারণে এখন তিন সন্তান তার।

রুহুল আমিন বলেন, দুটি সন্তান একটি পরিবারের জন্য যথেষ্ট আমরা সেটা জানি। কিন্তু তারপরও একটি মেয়ে সন্তানের প্রত্যাশা ছিল আমাদের। এমনটি শুধু আমাদের ক্ষেত্রেই নয়, পরিচিত অনেকেরই এমনটা হয়েছে। মানুষেরা এখন আয়-রোজগার বেড়েছে যে কারণে তিনটি বা চারটি সন্তান লালনপালন করা তাদের জন্য কোন সমস্যাই না। আমি যে বাসায় থাকি, সে বাসায় অন্য যেসব ভাড়াটিয়া থাকছেন, তাদের অধিকাংশ পরিবারেই দুয়ের অধিক সন্তান।

শুধু ময়মনসিংহের রুহুল আমিন নয়, কাঙ্ক্ষিত সন্তান লাভ আর আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে সারাদেশেই এমন চিত্র দেখা যায়। তাদের ধারণা, একাধিক সন্তান থাকলে তাদের মানসিকভাবে বেড়ে ওঠা, খেলাধুলাসহ ভবিষ্যতেও একটি আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।

বঙ্গবন্ধুর হাতেই আলোর মুখ দেখে ‘পরিবার পরিকল্পনা’

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের আওতাধীন একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। স্বেচ্ছামূলক উদ্যোগে বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির ইতিহাসের সূচনা হয় পঞ্চাশ দশকের গোড়াতে। কর্মসূচির গুরুত্ব বিবেচনায় ১৯৬৫ সালে পরিবার পরিকল্পনাকে জাতীয়করণ করা হয় এবং সরকারিভাবে পরিবার পরিকল্পনা সেবাদান কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭৩-৭৮ সালের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে বেগবান করার জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সরকারিভাবে দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ছিল প্রথম পদক্ষেপ।

তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৬ সালে প্রথম জাতীয় জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন করা হয়। পরিবার পরিকল্পনার গুরুত্ব অনুধাবন করে ২৫টি মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করে ২০১২ সালে পরবর্তী সময়ে জনসংখ্যা নীতি প্রণীত হয়। বর্তমানে এই নীতির আলোকে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের আয়তন খুব কম কিন্তু তার তুলনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি। বাংলাদেশ বিশ্বে আয়তনে ৯০তম দেশ হলেও জনসংখ্যার দিক দিয়ে অষ্টম জনবহুল দেশ। জনসংখ্যার ভয়াবহতা চিন্তা করে ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রত্যেক বৎসর আমাদের ৩০ লাখ লোক বাড়ে। আমার জায়গা হলো ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি আমাদের প্রত্যেক বৎসর ৩০ লাখ লোক বাড়ে তা হলে ২৫/৩০ বৎসরে বাংলার কোনো জমি থাকবে না হালচাষ করার জন্য... ফ্যামিলি প্লানিং করতে হবে।’

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কাজের পরিধি

অধিদপ্তরের তথ্য মতে, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর শুধুমাত্র জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়েই কাজ করে না বরং পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ছাড়াও মা ও শিশু স্বাস্থ্য, প্রজননস্বাস্থ্য, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা এবং পুষ্টিসেবা নিয়ে কাজ করে। পরিকল্পিত পরিবার গঠন পরিবার পরিকল্পনার মূল বিষয়। কারণ পরিকল্পিত পরিবার আলোকিত পরিবার। পরিকল্পিত পরিবার গঠন করতে পারলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধ হবে এবং মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুহার কমবে।

অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন,  আমরা চাই প্রতিটি গর্ভই হোক পরিকল্পিত এবং প্রতিটি জন্মই হোক নিরাপদ। নিরাপদ প্রসব নিশ্চিতকরণে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরাধীন ৩ হাজার ৩৬৪টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের মধ্যে ২ হাজার ৮৬০ কেন্দ্রে ২৪/৭ঘণ্টা নিরাপদ প্রসব সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়া ৯৬টি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের মধ্যে ৭০টি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে জরুরি প্রসূতি সেবা দেওয়া হচ্ছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রমের জন্য যেখানে ১৯৭৫ সালে মোট প্রজনন হার ছিল ৬.৫ সেখানে বর্তমানে মোট প্রজনন হার ২.৩ এ নেমে এসছে।

জানা গেছে, বিভিন্ন আর্থ সামাজিক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর কর্তৃক যুগোপযোগী ও বহুমুখী সমন্বিত কার্যক্রম সমূহ গ্রহণ করায় মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হার হ্রাসহ বিভিন্ন জনমিতিক সূচকে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।

পরিবার পরিকল্পনার উল্লেখযোগ্য অর্জন

বিডিএইচএস-২০২২ জরিপের তথ্যমতে, বিগত বছরগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশু স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন হয়েছে। বিশেষ করে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২২ সালে শিশু মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হ্রাস পেয়েছে। ধারাবাহিক তিন বছরের গড় অনুযায়ী, ৫ বছরের নিচে জীবিত শিশু জন্মের পর মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৪০ থেকে ৩১- এ নেমে এসেছে। এক বছরের কম বয়সের শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৫ জন এবং এক মাসের কম বয়সের শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২০ জন। পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অর্থাৎ সঠিক বৃদ্ধি ঘটছে না এই হার ৩১ থেকে ২৪ শতাংশে নেমে এলেও কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের সংখ্যায় কোনো পরিবর্তন হয়নি।

জরিপ বলছে, একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ সেবাদানকারীর সহায়তায় প্রসবের হার বিগত বছরগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী ৭০ শতাংশ প্রসবই একজন দক্ষ সেবাদানকারীর সহায়তায় ঘটছে। এছাড়া শতাংশ প্রসব কোনো না কোনো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে হচ্ছে, যা ২০১৭ সালে ছিল ৫১ শতাংশ। বর্তমানে ৮৮ শতাংশ নারী অন্তত একবার একজন প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্য কর্মীর থেকে গর্ভকালীন বা এএনসি সেবা গ্রহণ করেছেন, যা ২০১৭ সালে ছিল ৮২ শতাংশ।

জানা গেছে, জন্ম বিরতিকরণ সামগ্রী ব্যবহারের হার বিগত সময়ের চেয়ে ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারের হার ৩ শতাংশ বেড়ে ৫৫ শতাংশ হয়েছে। ২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী মহিলা প্রতি সন্তানের সংখ্যা ২.৩ জন। কিশোরী বয়সেই সন্তান জন্ম দেওয়ার মাত্রা বিগত বছরগুলোর তুলনায় কমেছে। ২০১৭ সালে এ মাত্রা ছিল ২৮ শতাংশ। ২০২২ এ এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশে। অল্প বয়সে বিবাহের মাত্রা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। ২০ থেকে ২৪ বছরের মহিলাদের মধ্যে ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যাওয়ার মাত্রা ২০১১ সালে ছিল ৬৫ শতাংশ, ২০১৭ তে তা কমে দাঁড়ায় ৫৯ শতাংশে এবং ২০২২ সালে তা ৫০ শতাংশে নেমে আসে।

পরিবার পরিকল্পনার ‘কর্মপরিকল্পনা’ এলোমেলো করে দিয়েছে কোভিড

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রজনন হার কমাতে সরকারের চেষ্টা ঠিকই আছে। তবে আমরা বলি, যেসমস্ত জায়গায় আর্লি ম্যারেজ হচ্ছে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এছাড়া আমাদের কিছু কিছু জেলা আছে, যেগুলোতে এখন সন্তান গ্রহণের হার বেশি। বিশেষ করে বস্তি এলাকাগুলোতেও সন্তান গ্রহণের হার বেশি।

তিনি বলেন, আমাদের কিছু কিছু বিভাগ আছে, যেগুলোতে প্রজনন হার আমাদের কম ছিল, কিন্তু এবার সেগুলোতে বেড়ে গিয়েছে। বরিশালে বেড়ে গিয়েছে, ময়মনসিংহে সবচেয়ে বেশি প্রজনন হার দেখা গেছে। তবে, সিলেটের টিএফআর আগে বেশি ছিল, কিন্তু এ জরিপে আবার কমে গিয়েছে। যেসব জায়গাগুলোতে পিএফআর কম ছিল সেখানে বেড়ে গিয়েছে, যেখানে বেশি ছিল সেখানে আবার কমে গিয়েছে। এর সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা আমরা এখনো খুঁজে পাচ্ছি না। কিছু জেলাতে একসময় আমরা চিন্তা করেছিলাম টিএফআর দুইয়ের নিচে চলে আসবে, সেগুলো আবার বাড়া শুরু হয়েছে। যে কারণে আমাদের প্রজনন হার একই জায়গাতে রয়ে গেছে।

আমিনুল হক বলেন, আমরা গত ১০ বছর যাবত এভাবে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলাম, গত কোভিডকালীন আমাদের সবকিছুই এলোমেলো করে দিয়েছে। কোভিডের আগে পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কিত প্রোগ্রামগুলোতে মানুষের সম্পৃক্ততা বেশ ছিল, কিন্তু কোভিডের ফলে সবকিছুতেই ভাটা পড়ে গিয়েছিল। এখন আবার আমাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।

তৃতীয় সন্তান গ্রহণ ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে

ঢাবির পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের এ অধ্যাপক বলেন, আমরা আরেকটি বিষয় দেখেছি, যাদের ঘরে প্রথম দুটি সন্তান ছেলে হয়েছে এবং আর্থিকভাবে পরিবারটা মোটামুটি সচ্ছল আছে, তাদের অধিকাংশই এখন তৃতীয় সন্তান নিয়ে নিচ্ছে। এমনকি এটি সমাজে নতুন একটি ফ্যাশন হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছে। শহরাঞ্চলগুলোতে আমরা দেখছি যে, ইচ্ছে করেই স্বামী-স্ত্রী তৃতীয় সন্তান গ্রহণ করছে। এটিও কিন্তু প্রজনন হার না কমার পেছনে অন্যতম কারণ।

তিনি আরও বলেন, তারমানে এখন আমাদের ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের টোটাল প্রোগ্রামটিকে নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে। আমাদের পরিকল্পনা হওয়া উচিত শুধুমাত্র একই জায়গায় থাকা নয়, বরং আন্তঃবিভাগে গত ১০ বছরে কাজের যে ধারাবাহিকতা ছিল, সেই গতিতে কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। একই সঙ্গে নতুন করে ফিল্ড লেভেল প্রোগ্রাম এবং টিএফআর নিয়ে চিন্তা করতে হবে।

বৈষম্য মাড়িয়ে দ্রুতগতিতে পথ চলতে হবে

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, সারা বিশ্বের ন্যায় আমরা দারিদ্র হ্রাস করার চেষ্টা করছি, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমের দিকে যাচ্ছে ও মানুষের জীবনকাল দীর্ঘায়ু হচ্ছে। কিন্তু এই সব কিছুর মধ্যে অনেক ঘাটতি এবং প্রতিটি মানুষকে নিয়ে চিন্তার অভাব রয়ে যাচ্ছে। আমাদের জনসংখ্যা ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। মানুষ ক্রমেই কম সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করছে এবং এতে করে জনসংখ্যার গঠন পরিবর্তিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমাদের ক্রমশই ষাটোর্ধ্ব লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। কোভিড-১৯ মহামারির মতো সংকট ও তার সঙ্গে জলবায়ুর সমস্যার কারণে সৃষ্ট মানুষের উন্নতির প্রতি গুরুত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। এই সমস্ত পরিবর্তন সমাজের সব ক্ষেত্রের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। জনসংখ্যাগত পরিবর্তন জাতিসংঘের মহাসচিব দ্বারা চিহ্নিত পাঁচটি মেগাট্রেন্ডের মধ্যে একটি, যা এজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়নে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দিকে অগ্রগতি নিয়ে আসবে।

আমাদের দেশে প্রতিস্থাপনের উর্বরতা কম ও তরুণ জনসংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সময়ে সারা বিশ্বের মতো আমাদের এখানে উদ্বেগজনক বৈষম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। বৈষম্যগুলোর অধিকাংশই লিঙ্গ, বয়স, উৎস, জাতি, অক্ষমতা, যৌন অভিমুখিতা, শ্রেণি এবং ধর্ম বিষয়ক অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে।

করণীয় প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, নারীদের সম্পূর্ণ প্রজনন অধিকার প্রয়োগ করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে, জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ও ব্যবহারের অপূরণীয় চাহিদা পূরণ করতে হবে, মাতৃমৃত্যুর হার ৩ সংখ্যা থেকে দ্রুত কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। সমাধান শুধুমাত্র জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের ওপর সম্ভব নয়, সেখানে মানুষের জন্য আরও বেশি সমান সুযোগ করে দিতে হবে। এমনকি দেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার আরও আধুনিকায়ন করতে হবে এবং মানব পুঁজিতে বিনিয়োগ করতে হবে।

আবু জামিল ফয়সাল বলেন, জনসংখ্যাগত পরিবর্তন বিশ্লেষণ করতে দক্ষতা, রাজনৈতিক ইচ্ছা, ব্যাপক জনসমর্থন, তথ্য প্রমাণ এবং মানবাধিকারের ওপর ভিত্তি করে কার্যকর জনসংখ্যা এবং সামাজিক নীতি গড়ে তোলা দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি।টেকসই উন্নয়ন কেবলমাত্র তখনই অর্জন করা যেতে পারে যখন নারীদের বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে যার সঙ্গে জড়িত প্রজনন অধিকার পছন্দ এবং লিঙ্গ সমতা, ও উন্নয়ন।

পরিবার পরিকল্পনায় গতি সঞ্চার হলে কমবে মোট প্রজনন হার

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (আইইএম) ও লাইন ডাইরেক্টর (আইইসি) আব্দুল লতিফ মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোভিডকালীন আমাদের কাজ অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যে কারণে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। তবে এখানে জনবলের ঘাটতির বিষয়টিও বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। আমাদের দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু সেই হারে আমাদের জনবল কিন্তু বাড়ছে না। বরং আমাদের কাজের পরিধি বেড়েছে।

তিনি বলেন, আশার দিক হলো আমাদের জনবল নিয়োগ কার্যক্রম চলমান আছে। বাল্যবিয়েটাও টিএফআর বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ। আপনারা জানেন কোভিডকালীন আমাদের বাল্যবিবাহের হার কিন্তু বেড়ে গিয়েছিল। এখন আমরা যদি বাল্যবিয়ে কমানোর পাশাপাশি জনবলের ঘাটতিটাও কমিয়ে ফেলতে পারি, তাহলে আমাদের কাজে আরও গতি সঞ্চার হবে। সেইসঙ্গে মোট প্রজনন হারও আশা করছি কমে আসবে।

লতিফ মোল্লা বলেন, আমাদের কার্যক্রমকে আরো বেগবান করতে হবে। আমরা বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। যেন প্রতিটি ছেলে-মেয়ে বাল্য বিবাহের কুফল সম্পর্কে জানে। বাল্যবিয়েটা যদি আমরা প্রতিরোধ করতে পারি, তাহলে টিএফআর অটোমেটিক্যালি কমে যাবে।

মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের কাজের শিথিলতা দেখছেন কিনা এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, কাজের শিথিলতা হয়তো নেই। কিন্তু তাদের কাজের ভলিউম এখন অনেক বেড়ে গেছে। আগে আমাদের বাড়ি বাড়ি কার্যক্রম ছিল, এখন আসলে আমাদের বাড়ি বাড়ি কার্যক্রমটি খুব বেশি নেই। এখন আমাদের কর্মীরা কমিউনিটি ক্লিনিকে বসে, স্যাটেলাইট ক্লিনিকে যায়, বিভিন্ন ক্যাম্প করতে হয়, উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন প্রোগ্রামে আসতে হয়। যে কারণে বাড়ি বাড়ি কার্যক্রমটি ওদের কমে গিয়েছে। এর জন্যই আমাদের কাছে মনে হতে পারে তাদের শিথিলতা চলে এসেছে। কিন্তু তারা আসলেই অনেক কাজ করছে।

টিআই/এসএম