দেশে আবারও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ১৮ দফা জরুরি নির্দেশনা দিয়েছে। এরই মধ্যে লক্ষাধিক পরীক্ষার্থী নিয়ে ২ এপ্রিল (শুক্রবার) ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগামী অবস্থায় প্রশ্ন থেকেই যায়, করোনাকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর?

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে নতুন করে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৪২ জন। ফলে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ পাঁচ হাজার ৯৩৭ জনে। ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৪৫ জন। এ নিয়ে ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৯৯৪ জনে।

ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ববিদরা এটাকে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ বলে উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন, বিগত ঢেউয়ের তুলনায় এবার সংক্রমণ বাড়ছে লাফিয়ে। করোনা অধিক শক্তি নিয়ে এসেছে যা উদ্বেগজনক।

ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা জানান, দেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন। এই অবস্থাকে শুধু ঊর্ধ্বমুখী বললে হবে না, এটা রেকর্ড সংক্রমণ। এছাড়াও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নয়। ঢাকার কোনো হাসপাতালে আইসিইউ সিট খালি নেই। এমন পরিস্থিতিতে এত বড় পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া কীভাবে সম্ভব, যেখানে অনেক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে কেন এপ্রিলের ২ তারিখেই পরীক্ষা নেওয়া জরুরি?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরীক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি বছর মেডিকেলে ৭৫ থেকে ৭৮ হাজার পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। সেখানে এই বছর এক লাখ ২২ হাজারের ওপর পরীক্ষা দিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে অভিভাবকরাও থাকবেন। এতো বড় জনসমাগম কেন হতে দেওয়া হবে? এতে পরীক্ষার্থী বা তাদের পরিবারগুলোর কোনো ক্ষতি হলে এর দায়ভার কে নেবে?

তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি না হয় হলের ভেতরে এক ঘণ্টা মানা হলো। কিন্তু গণপরিবহনগুলোতে কী হবে? করোনা পজিটিভ শিক্ষার্থী যারা আছেন, তারা বাসায় আইসোলেটেড অবস্থা থেকে এসে কীভাবে পরীক্ষা দেবেন? তারা তো গণপরিবহনগুলোতে করেই পরীক্ষা কেন্দ্রে আসবেন।

সোমবার (২৯ মার্চ) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস স্বাক্ষরিত ১৮ দফা জরুরি নির্দেশনার প্রথম দফাতেই বলা হয়েছে, সব ধরনের জনসমাগম (সামাজিক/রাজনৈতিক/ধর্মীয়/অন্যান্য) সীমিত করতে হবে। উচ্চ সংক্রমণযুক্ত এলাকায় সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হলো। বিয়ে/জন্মদিনসহ যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে জনসমাগম নিরুৎসাহিত করতে হবে।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এক লাখ ২২ হাজারের অধিক পরীক্ষার্থী আসবে। মাত্র ১৯টি কেন্দ্রে তাদের পরীক্ষা নিতে গেলে কী পরিমাণ জনসমাগম হবে তা সহজেই বোঝা যায়। জনসমাগম কমাতে সরকার নির্দেশনা দিলেও এত সংখ্যক শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারকে ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. এ কে এম আহসান হাবিব বলেন, পরীক্ষার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। প্রশ্নপত্র ছাপানো থেকে শুরু করে সব প্রস্তুতি এখন শেষ পর্যায়ে। এমন অবস্থায় পরীক্ষা পেছানো সম্ভব না।

সংক্রমণ বৃদ্ধি সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা যখন পরীক্ষার বিষয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেছি, তখন সংক্রমণের এমন ঊর্ধ্বগতি ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তা বেড়েছে। যেকোনো সময় যেকারোর সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকেই। তাই এবার প্রতি কেন্দ্রে আলাদা আইসোলেশন কক্ষ থাকবে।

করোনা পজিটিভ শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পরীক্ষা চলাকালে যদি কারও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় বা কারও মাঝে করোনা উপসর্গ থাকে তবে তাকে সেখানেই চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। কেন্দ্রের ভেতরে পরীক্ষা চলাকালীন পরীক্ষার্থীদের ও বাইরে অপেক্ষমাণ অভিভাবকদের স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সংক্রমণের এমন ঊর্ধ্বগতিতে পরীক্ষা নেওয়া শুধু শিক্ষার্থী নয়, আমাদের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। এতো পরীক্ষার্থী আসবে, সেখানে আমাদেরও যেতে হবে। সংক্রমণের ভয় তো স্বাভাবিকভাবেই থাকে। এই মুহূর্তে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টা উপরমহলের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে। চাইলে পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

এদিকে, কেন্দ্র পরিদর্শকের দায়িত্ব পাওয়া এক চিকিৎসক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখন সংক্রমণের যে ধারা, যাদেরকেই টেস্ট করতে পাঠাচ্ছি, তাদের প্রায় সকলেরই করোনা ধরা পড়ছে। এর বাইরেও এমন অনেকেই আছে যারা ভয়ে ডাক্তারের কাছে না এসেই ফার্মেসি থেকে ওষুধপত্র খেয়ে ফেলছেন। তাদের আমরা টেস্ট করতে পারছি না। তাদের বাইরেই আমাদের পাঁচ হাজারের ওপর সংক্রমণ। তাহলে সংক্রমণটা কতো ভয়াবহ ভাবাই যায় না। এই অবস্থায় একটা পাবলিক পরীক্ষা জেনে বুঝে আত্মাহুতি দেওয়ার মতো। এতে আমরাও ঝুঁকিতে পড়েছি।

তিনি বলেন, সংক্রমণের পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এই মুহূর্তে বলা যায়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দিয়ে আমাদের কোনো লাভ নেই। এখন দিতে হবে অন্তত ১৪ দিনের পূর্ণ লকডাউন। অনেকটা কারফিউ জারির মতো। এই ১৪ দিনের মধ্যে যদি আমরা ভাইরাসকে একজন থেকে অন্যজনের মধ্যে ছড়াতে না দেই, তাহলে সর্বোচ্চ ক্ষতিটা হবে না। কিন্তু আমরা যদি এরকম বড় একটা পাবলিক পরীক্ষা নিতে যাই, তাহলে এটা বড় একটা ধাক্কার কারণ হবে।

এবিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউসিজি অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই মুহূর্তে পরীক্ষা নেওয়া নীতিনির্ধারণী ব্যাপার। তারা চাইলে পুনরায় বিবেচনা করতে পারেন। যদি পরীক্ষা নিতেই হয়, তাহলে অবশ্যই কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নিতে হবে। নয়তো বড় একটা ঝুঁকি তৈরি হবে।

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকতে হলে অবশ্যই ডাবল (একাধিক) মাস্ক পরে আসতে হবে। হাতে গ্লাভস, প্রয়োজনে মাথায় ক্যাপ পরে আসতে হবে। আর সঙ্গে অভিভাবকদের না নিয়ে আসাই উচিত হবে। পরীক্ষা কেন্দ্রের গেইটে সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে। তাহলে সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন বলেন, এই মুহূর্তে পরীক্ষা পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। ইতোমধ্যেই ২ এপ্রিল পরীক্ষা নিতে আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। গত রোববার (২৮ মার্চ) স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে সব কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্তদের নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরীক্ষার দিন স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেন সুষ্ঠুভাবে সবকিছু সম্পন্ন করা যায় সে বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সংক্রমিতদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি কেউ আশঙ্কা করে থাকেন যে তার মাঝে করোনা উপসর্গ আছে অথবা কারও মাঝে সংক্রমণ থাকে, তবে আমরা তাদের আলাদাভাবে বিশেষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরীক্ষা নেব। এক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো প্রতিটা কেন্দ্রে আইসোলেশন কক্ষের ব্যবস্থা থাকছে। তাপমাত্রা পরিমাপ করে সবাইকে পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করতে হবে। আশা করছি সফলভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন হবে। সবাই যার যার প্রস্তুতি নিয়ে এতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।

টিআই/ওএফ