গর্ভবতী মায়েরা কোয়ালিটি অ্যান্টিনেটাল কেয়ার (মানসম্মত প্রসবোত্তর সেবা) না পাওয়ায় বিশ্বব্যাপী জন্ম নেওয়া শিশুরা মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। এর প্রভাবে বছরে আনুমানিক ৫ লাখ ৬৬ হাজার মৃত সন্তান প্রসব এবং অপরিণত বা কম ওজনের শিশুর জন্মের ঘটনা ঘটছে ৫২ লাখের মতো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে কোয়ালিটি অ্যান্টিনেটাল কেয়ার খুবই ভয়াবহ পর্যায়ে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে, একজন গর্ভবতী মাকে প্রসব পূর্ব সময়ে অন্তত ৮ বার অ্যান্টিনেটাল কেয়ারের আওতায় আসার কথা থাকলেও বাংলাদেশে সর্বোচ্চ আসে ৪ থেকে ৫ বার।

মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) রাজধানীর আইসিডিডিআর,বির সাসাকাওয়া মিলনায়তনে দ্য ল্যানসেট সিরিজের আঞ্চলিক উদ্বোধন উপলক্ষ্যে এক প্রেস কনফারেন্সে বক্তারা এসব কথা বলেন।

অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী বলেন, একজন প্রসূতি মায়ের জন্য অ্যান্টিনেটাল কেয়ার (প্রসব পূর্ব সেবা) অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের যদি আন্ডারওয়েট থাকে, তাহলে দেখা যাবে যে তার গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটা জন্ম থেকেই দুর্বল হয়ে জন্মাবে। সেক্ষেত্রে আমরা সকলেই বুঝতে পারি যে, মায়ের যত্নটা কতটা প্রয়োজন। আমরা এখনও এই জায়গাটিতে উন্নতি করতে পারিনি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে ১টি অ্যান্টিনেটাল কেয়ারের আওতায় আসে ৮৮ শতাংশ গর্ভবতী মা, ৪টি অ্যান্টিনেটাল কেয়ারের আওতায় আসে ৪১ শতাংশ গর্ভবতী মা। এর অধিক সময় অ্যান্টিনেটাল কেয়ারে আসতে আমরা খুব বেশি একটা দেখি না। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একজন গর্ভবতী মাকে প্রসব পূর্ব সময়ে অন্তত ৮ বার অ্যান্টিনেটাল কেয়ারের আওতায় আসতে হবে। অর্থাৎ এই জায়গাটায় আমরা অনেকটাই পিছিয়ে আছি।

ডা. সামিনা চৌধুরী বলেন, এই অ্যান্টিনেটাল কেয়ার কি শুধু আয়রন ট্যাবলেট আর টিটি ইনজেকশন? অবশ্যই না। কোয়ালিটি অ্যান্টিনেটাল কেয়ার বলতে আমরা বুঝি, অন্তত পক্ষে মেডিক্যালি ট্রেইনড একজন চিকিৎসক অন্তত একবার গর্ভবতী মাকে দেখবেন। এর পাশাপাশি তার ওজন ঠিক আছে কিনা, ব্লাড পেশার দেখা হয়েছে কিনা, ইউরিন টেস্ট করা হয়েছে কিনা, ব্লাড টেস্ট এবং প্রেগনেন্সি নিয়ে কাউন্সিলিং করা হয়েছে কিনা -এই পাঁচটি জিনিস অবশ্যই দেখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, একজন মায়ের শুধু গর্ভকালীন যত্ন নিলেই হয় না। গর্ভের পূর্বেই আমাদের তার যত্ন নিতে হবে। বিশেষ করে তার ডায়াবেটিস আছে কিনা, তার ব্লাডপেসার আছে কিনা, অর্থাৎ সে যদি হেলদি অবস্থায় গর্ভকালীন সময়টাতে না আসে, তাকে আপনি প্রেগন্যান্ট অবস্থায় সেবা দিয়ে কতটা কুলাতে পারবেন? কোনোভাবে যদি কোন প্রসূতি মায়ের একটা প্রিম্যাচিউর (এসভিএন টাইপ) শিশু জন্ম হয়, তাহলে সহজেই সে যেকোনো রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যতদিন সে বেঁচে থাকবে ততদিনই তার অনেক বড় বড় রোগে আক্রান্তের সম্ভাবনা থাকবে।

অনুষ্ঠানে গবেষণাপত্র তুলে ধরেন আইসিডিডিআর,বির মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী ডা. আহমেদ এহসানুর রহমান।

তিনি বলেন, ল্যানসেট সিরিজে ৮১টি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে গর্ভবতী নারীদের জন্য তৈরি করা ৮টি অ্যাক্সেসযোগ্য এবং সাশ্রয়ী ইন্টারভেনশনের পরিচয় দেয়। এই ইন্টারভেনশনগুলো বছরে আনুমানিক ৫ লাখ ৬৬ হাজার মৃত সন্তান প্রসব এবং অপরিণত বা কম ওজনের শিশুর জন্মের ৫২ লাখ ঘটনা, যেগুলো প্রতিরোধ করার সম্ভাবনা রাখে। এছাড়াও পরবর্তীতে এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং উন্নত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দিকে পরিচালিত করতে পারে।

ল্যানসেট সিরিজে দেখা গেছে, অপরিণত জন্ম এবং কম ওজনে জন্ম নেওয়া শিশুদের যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেটি মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও এর অগ্রগতি অপর্যাপ্ত। গ্লোবাল নিউট্রিশন টার্গেট, যারা ২০১২ সালের বেসলাইন থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে কম ওজনে জন্ম নেওয়া শিশুদের হার ৩০ শতাংশে নিয়ে আসার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। এখন পর্যন্ত প্রতি বছর হ্রাসের মাত্রা মাত্র ০.৫৯ শতাংশ। এই স্থবিরতা ল্যানসেট সিরিজকে গর্ভবতী মহিলাদের যত্ন এবং প্রসবের পদ্ধতি উন্নত করার জন্য প্রভাবিত করে।

অনুষ্ঠানে প্যানেলিস্ট হিসেবে অংশগ্রহণ করেন দ্য ল্যানসেট এসভিএন সিরিজের প্রধান লেখক, ফিনল্যান্ডের টাম্পেইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর চাইল্ড-অ্যাডোলোসেন্ট বিভাগের প্রফেসর ড. পার অ্যাশর্ন, বাংলাদেশ পেরিনেটাল সোসাইটির (বিপিএস) মহাসচিব ও ন্যাশনাল টেকনিকাল ওয়ার্কিং কমিটি- নিউবর্ন হেলথের (এনটিডব্লিউসি-এনবিএইচ) সদস্য প্রফেসর মো. আব্দুল মান্নানসহ আরও অনেকে।

টিআই/এসকেডি