কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল

দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে সংক্রমণ পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। প্রতিদিনই আক্রান্তের পাশাপাশি মৃতেও রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। সবশেষ সোমবার (৫ এপ্রিল) ৭ হাজার ৭৫ জন আক্রান্তের পাশাপাশি ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর থেকে হাসপাতালগুলোতে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় চার থেকে পাঁচগুণ বেশি রোগী আসছে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) শয্যা ফাঁকা না থাকলেও প্রতিনিয়ত সিট পেতে আসছে অসংখ্য তদবির।

রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল করোনা আক্রান্ত রোগীদের প্রথম পছন্দ। সেবার মান ও চিকিৎসক-নার্সদের আন্তরিক সেবার কারণে অধিকাংশ রোগীই চায় এ হাসপাতালে ভর্তি হতে। ফলে হাসপাতালে নির্ধারিত বেড সংখ্যার বাইরেও প্রায় দ্বিগুণ রোগী এসে ভর্তি হয়েছে।

হাসপাতালটির পরিসংখ্যান কর্মকর্তা সালেহ আহমদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, কুর্মিটোলা হাসপাতাল করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে। সবগুলো সিটেই রোগী ভর্তি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো মাধ্যমে আমাদের কাছে তদবির আসছে, কিন্তু কিছুই করার নেই।

তিনি বলেন, যদিও আমাদের হাসপাতালে ২৭৫টি শয্যা কোভিডের জন্য ডেডিকেটেড, আজ (সোমবার) সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ৪০০ রোগী ভর্তি রয়েছে। এভাবে প্রতিনিয়তই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গতকাল ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৪২০ জন।

করোনা পরীক্ষার টিকিট কাউন্টার সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালটিতে প্রতিদিন ১২০ জনের করোনা পরীক্ষার কিট বরাদ্দ থাকলেও গত কয়েক সপ্তাহে দুই শতাধিক পর্যন্ত মানুষ পরীক্ষা করাতে আসছেন।

সংক্রমণের এ পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, এ অবস্থায় চিকিৎসা দিয়ে করোনা মোকাবিলা করা যাবে না। আমাদের অবশ্যই সংক্রমণ রোধে গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে মানুষকে বাধ্য করতে হবে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর’র উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে চলাচল নিয়ন্ত্রণসহ যেসব জায়গায় ভিড় আছে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া, অথবা সেগুলোর ক্যাপাসিটি অর্ধেক করে ফেলার জন্য বলা হয়েছে। এ অবস্থায় আমরা মানুষকে ঘরে থাকার জন্য উপদেশ দেই। কিন্তু লকডাউনের ঘোষণার পর দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।

তিনি বলেন, মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই এ লকডাউন। কিন্তু এর মধ্যে যদি যাতায়াত বেড়ে যায়, তাহলে তো হলো না। এতে আরও গ্রামে গ্রামে নতুন প্রজাতির সংক্রমণ ছড়াবে। যা আমাদের জন্য আরও ভয়ংকর হতে পারে। তাই যেকোনো মূল্যে এ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আবদুল হামিদ জানান, করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপ মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত নির্দেশনা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে কিছু কাজ করতে হবে। সরকার ঘোষিত এক সপ্তাহের লকডাউন ঠিক হয়েছে কী, হয়নি সে দিকে না গিয়ে তিনি বলেন, সরকার ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে জনগণকে সম্পৃক্ত করে মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দরিদ্র মানুষকে বিনামূল্যে মাস্ক সরবরাহ করতে হবে।

স্বাস্থ্যবিধি মানা, করোনার ঝুঁকি বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে কার্যকরভাবে প্রচারণা চালাতে হবে। প্রয়োজনে হেলথ কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিতে হবে। মানুষ যেন আরও বেশি করে টিকা নিতে আগ্রহী হয় সেজন্য সবাইকে সম্পৃক্ত করে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। টিকার কার্যকারিতা নিয়ে জনমনে বিদ্যমান সংশয় দূর করতে হবে।

জিনোম সিক্যুয়েন্সিং ও সেরো প্রেভিলেন্স স্টাডি নিয়মিত করে যেতে পরামর্শ দিয়ে সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, করোনা টেস্টের সরকারি ফি নেওয়া বন্ধ করতে হবে এবং টিকার নিবন্ধন অনস্পট চালু করতে হবে। করোনা পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এবং শহরাঞ্চলে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, লকডাউনের সময় দরিদ্র মানুষদের আর্থিক সহায়তা দিতে হবে যেন খাদ্য সংকট সৃষ্টি না হয়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ( হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, সারাদেশেই আশঙ্কাজনকভাবে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। হাসপাতালগুলোতে ইতোমধ্যেই ভিড় জমে গেছে। এ অবস্থায় সামান্য সর্দি-জ্বর আর অন্য সাধারণ রোগ নিয়ে রোগীদের হাসপাতালে এসে ভিড় না করার আহ্বান জানাচ্ছি। এ সময়ে তারা যেন ফোনেই চিকিৎসা সেবা নেন।

তিনি আরও বলেন, তবে যারা একেবারেই ইমার্জেন্সি রোগী, তারা আসবেই। তাদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে না বিশেষ করে করোনা রোগীরা, যাদের ভর্তি লাগবে তাদের আসতেই হবে। তাদের ঘরে বসে থাকা যাবে না।

সার্বক্ষণিক টেলিমেডিসিন সেবা চালু থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্য বাতায়ন চালু আছে। সব হাসপাতালেই টেলিমেডিসিন সেবা চালু আছে। এ সময়ে ইমার্জেন্সি না হলে হাসপাতালে না আসাই ভালো।’

ফরিদ মিয়া বলেন, ‘লকডাউন দেওয়াতে বরং ইমার্জেন্সি রোগী এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জন্যও সুবিধা হবে। কারণ রোগীদের সঙ্গে যে কুড়িখানেক উপস্থিতি থাকে, তা কম আসবে। এতে আমাদের চিকিৎসক-নার্সদের সেবা কার্যক্রমে সুবিধা হবে।’

কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্র:
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ১৬৯ সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ১৫২টিতে, ফাঁকা ১৭টি। ১৬টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে সবকটিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ২৭৫টি সাধারণ শয্যা থাকলেও অতিরিক্ত রোগীসহ মোট ভর্তি ৪২০ জন। করোনায় আক্রান্ত ১৪৫ রোগীর জন্য আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। ১০টি আইসিইউ শয্যার কোনোটিই ফাঁকা নেই।

সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ৯৪টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ৭৯টিতে, ফাঁকা আছে ১৫টি শয্যা। ছয়টি আইসিইউ শয্যার সবকটিতে রোগী ভর্তি রয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৮৮৩টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ৭০৫টিতে, ফাঁকা ১৭৮টি শয্যা। নতুন ১০টি আইসিইউসহ ২০টির মধ্যে শয্যা ফাঁকা আছে মাত্র ১টি।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩১০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ৩১১টিতে, ফাঁকা নেই, বরং শয্যার বাইরেও অতিরিক্ত একজন রোগী ভর্তি আছে। ১৯টি আইসিইউ শয্যার কোনোটি ফাঁকা নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের ২৩৪টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ১৮৬টিতে, ফাঁকা ৪৮টি। ১৬টি আইসিইউ শয্যার সবকটিতে রোগী ভর্তি রয়েছে।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালের ২৫০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ২৯৩টিতে, ফাঁকা নেই, বরং শয্যার বাইরেও আরও ৪৩ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। ১৫টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১৪টিতে রোগী ভর্তি আছে। ফাঁকা আছে মাত্র একটি আইসিইউ।

শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৪০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ১২৪টিতে, ফাঁকা ১৬টি। ১৬টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে সবকটিতে রোগী ভর্তি।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড ইউনিটে ১৫০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ১৩১টিতে, ফাঁকা ১৯টি শয্যা। হাসপাতালটিতে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই।

মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের ১০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি আছে মাত্র একজন। ফাঁকা রয়েছে ৯টি শয্যা। এখানে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। সবমিলিয়ে ১০টি সরকারি হাসপাতালে দুই হাজার ৫১৫টি সাধারণ শয্যার মধ্যে দুই হাজার ৪০২টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। ফাঁকা আছে ১১৩টি শয্যা। মোট ১১৮টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১১৬টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। মাত্র দুটি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা আছে।

কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্র
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৮৩টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ৮৩টিতেই, কোনো শয্যা ফাঁকা নেই। এছাড়া ২২টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ২২টিতেই রোগী ভর্তি।

আসগর আলী হাসপাতালের ৬১টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ৬০টিতে, ফাঁকা ১টি শয্যা। এছাড়া ২৩টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১৭টিতে রোগী ভর্তি, ফাঁকা ৬টি শয্যা।

স্কয়ার হাসপাতালের ৬৫টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ৫৯টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে, মাত্র ৬টি শয্যা ফাঁকা। এ হাসপাতালের ১৯টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১৬টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে, মাত্র তিনটি শয্যা ফাঁকা।

ইবনে সিনা হাসপাতালের ৪৪টি সাধারণ শয্যার সবকটিতেই রোগী ভর্তি। পাঁচটি আইসিইউ শয্যার সবই পরিপূর্ণ।

ইউনাইটেড হাসপাতালের ৮০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ৬২টিতেই রোগী ভর্তি, মাত্র ১৮টি শয্যা ফাঁকা। ২২টি আইসিইউ শয্যার ১৪টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। আটটি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা।

এভারকেয়ার হাসপাতালের ২৮টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ২৭টিতেই রোগী ভর্তি। মাত্র একটি বেড খালি। ২১টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১৮টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। খালি তিনটি একটি আইসিইউ শয্যা।

ইমপালস হাসপাতালের ২৫০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ১৫০টিতে রোগী ভর্তি, ফাঁকা ১০০টি শয্যা। ৪০টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ৩৭টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। ৩টি আইসিইউ শয্যা খালি আছে।

এএমজেড হাসপাতালের ৯০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ৮৬টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে, ফাঁকা ৪টি শয্যা। ১০টি আইসিইউ শয্যার সবকটিতে রোগী ভর্তি রয়েছে।

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটালের ৬২টি সাধারণ শয্যার মধ্যে অতিরিক্ত রোগীসহ মোট ভর্তি ৬০ জন। দুটি শয্যা খালি। ৯টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে চারটিতে রোগী ভর্তি রয়েছে। আইসিইউ শয্যা খালি রয়েছে পাঁচটি।

সবমিলিয়ে রাজধানীর নয়টি বেসরকারি হাসপাতালের মোট ৭৬৩টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ৬৩১টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে। ফাঁকা ১৩২টি সাধারণ শয্যা। ১৭১টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১৪৩টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে। ফাঁকা ২৮টি আইসিইউ শয্যা। রাজধানী ঢাকায় সরকারি-বেসকারি মিলিয়ে মোট তিন হাজার ২৭৮টি সাধারণ শয্যার মধ্যে মোট রোগী ভর্তি তিন হাজার ৩৩ জন। খালি আছে ২৪৫টি সাধারণ শয্যা। ২৮৯টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ২৫৯টিতেই রোগী ভর্তি। ফাঁকা রয়েছে ৩০টি আইসিইউ শয্যা।

সারাদেশের হাসপাতালগুলোর চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নয় হাজার ৫৩২টি সাধারণ শয্যার মধ্যে মোট রোগী ভর্তি চার হাজার ৪৯৬ জন। খালি আছে পাঁচ হাজার ৩৬টি সাধারণ শয্যা। মোট ৫৭৯টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ৩৮৪টিতেই রোগী ভর্তি। ফাঁকা রয়েছে ১৯৫টি আইসিইউ শয্যা।

টিআই/এসএম