কলেরার টিকা নিয়ে গবেষণা ও সাশ্রয়ী দামে সেই টিকা সহজলভ্য করে লাখো মানুষের প্রাণ রক্ষার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন ড. ফেরদৌসী কাদরী। 

বিজ্ঞান গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সম্প্রতি সিঙ্গাপুরভিত্তিক সাময়িকী ‘এশিয়ান সায়েন্টিস্ট’ প্রকাশিত তালিকায় এশিয়ার শীর্ষ ১০০ জন বিজ্ঞানীর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অসামান্য কর্মদক্ষতায় বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে সম্মান এনে দিয়েছেন এ নারী। ফলে বর্তমানে দেশে চিকিৎসা গবেষণায় নারীদের ‘আইডলে’ পরিণত হয়েছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) এই জ্যেষ্ঠ এ বিজ্ঞানী।

নারী দিবস উপলক্ষ্যে মুখোমুখি হয়েছিলেন ঢাকা পোস্টের। আলাপচারিতায় উঠে এসেছে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নারীদের অংশগ্রহণ ও নানা প্রতিকূলতার প্রসঙ্গ।

চিকিৎসায় খাতে বড় ভূমিকা রাখছেন নারীরা
ড. কাদরী বলেন, অন্যান্য পেশার পাশাপাশি চিকিৎসা বিজ্ঞানে নারীদের অংশগ্রহণ এক সময়ে খুব কম থাকলেও ক্রমেই পরিবর্তন হচ্ছে সেই চিত্র। বিশেষ করে গত দেড় যুগে এ পেশায় নারীদের এগিয়ে আসার হার তুলনামূলক সবচেয়ে বেশি হয়েছে। চিকিৎসা খাতে বড় ভূমিকা রাখছেন এখনকার নারীরা। পিছিয়ে নেই গবেষণাতেও। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে নারীরা আরও এগিয়ে যাবেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব জায়গায় নারীদের কাজ করা নিয়ে আগে অনেক বেশি প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হতো। কিন্তু আমার সৌভাগ্য যে, শিক্ষা অর্জন করতে গিয়ে তেমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি। কারণ, আমার পরিবারই মনে করত নারীদের এগিয়ে যেতে হবে। বরং শিক্ষায় তারা আরও বেশি জোর দিত। তারা মনে করতেন ছেলে-মেয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তবে আমাদের আশপাশে অনেক মানুষ চাইত না নারীরা শিক্ষিত হোক। ১৮-২০ বছরের মধ্যেই অধিকাংশ নারীর বিয়ে হয়ে যেত।

শাশুড়ি ও স্বামীর সহযোগিতায় এতদূর আসতে পেরেছি
চিকিৎসা বিজ্ঞানে নারীদের ‘আইডল’ হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি কাদের সহযোগিতা পেয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে আইসিডিডিআর,বির এই জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী বলেন, আমরা যখন শিক্ষাজীবন শুরু করি, তখন মেয়েদের কাজের প্রতি আজকের মতো জোর দেওয়া হতো না। নারীদের এগিয়ে যেতে হবে এমন ভাবনাই ছিল না। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সবখানে এই চিত্র ছিল। তবে আমার শাশুড়ি ও স্বামীর সহযোগিতায় এতদূর আসতে পেরিছে।

তিনি বলেন, চিকিৎসা ক্ষেত্রে নারীরা বর্তমানে অনেক এগিয়ে আছে। মেডিকেল কলেজে ভর্তি, চিকিৎসা পেশায় এবং বায়ো মেডিকেলে অনেক ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়েও এগিয়ে থাকছেন নারীরা। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকেও তাই দেখা যাচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে।

কাদরী আরও বলেন, বাংলাদেশের জন্য এটা অত্যন্ত সুখবর যে নারীরা সবক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে। তবে বেশকিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এখানে কাজ করতে যে ধরনের পরিবেশ দরকার সেটিতে ঘাটতি রয়েছে।

সব কর্মস্থলে ডে-কেয়ার চালু হওয়া দরকার
ড. ফেরদৌসি কাদরী বলেন, আমাদের সময় সন্তানকে কাছে রেখে কাজ করতে পারব এমনটা কল্পনাও করা যেত না। এখন সময় সময় পরিবর্তন হয়েছে। আগে যৌথ পরিবার থাকায় বাচ্চাদের দেখাশোনাটা দাদী-নানীরাই করতেন। এখন সেটি নেই। এখন স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরিজীবী হওয়ায় বাচ্চা লালন-পালন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তবে বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠানে ডে-কেয়ার চালু করেছে। নারীদের এগিয়ে যাওয়ার বড় ভূমিকা পালন করতে পারে এটি। সব কর্মস্থলে এটি নিশ্চিত হওয়া দরকার। 

গবেষণার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা উচিত
গবেষণা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, গবেষণার জন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা উচিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরা গবেষণায় কাজ করতে ইচ্ছুক। সেখানেও ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই বেশি এগিয়ে আসছে। তাদের নিয়ে আমাদের আলাদা পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।

ড. কাদরী আরও বলেন, আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয় হলো বিয়ে হলে, বাচ্চা নেওয়ার পর অনেক পরিবার থেকে আর মেয়েদের পড়াশোনায় খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। এটা তাদের জন্য অন্যতম একটা বড় বাধা। ফলে একই পেশায় থেকে স্বামীরা এগিয়ে গেলেও পিছিয়ে যায় নারীরা। তবে ৯০ ভাগ পরিবারের মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে।

আগামীদিনের নারী গবেষকদের উদ্দেশে এই বিজ্ঞানী বলেন, ভালো গবেষক হতে হলে নারী শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি পরিশ্রমের মানসিকতা ও আরও বেশি সাহসী হতে হবে। গবেষক হিসেবে তৈরি হতে নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। দৃঢ়ভাবে পরিবারকে বোঝাতে হবে যে, চেষ্টা করলে আমিও পারব। যেকোনো জায়গায় গিয়ে গবেষণা করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। তবে তরুণদের গবেষক হিসেবে তৈরি করার দায়িত্ব বড়দেরও নিতে হবে। তাদের জন্য দেশে জায়গা তৈরি করতে হবে।  

ফেরদৌসী কাদরীর সফলতার গল্প
ড. ফেরদৌসি কাদরী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকা বিষয়ক বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টামণ্ডলীর একজন সদস্য ছিলেন। তিনি ইতোমধ্যে এশিয়ার নোবেল খ্যাত ম্যাগসেসে পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার, ইউনেসকো ফর উইমেন ইন সায়েন্স পুরস্কার, বিল গেটস স্বীকৃত হিরো দ্য ফিল্ডের মতো অসংখ্য সম্মাননা অর্জন করেছেন।

ড. কাদরী বলেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশ থেকে আন্তর্জাতিক মানের গবেষক হওয়ার পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। বিশেষ করে যেখানে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের উঠে আসার পথ আরও কঠিন ও প্রতিবন্ধকতায় ভরা। তবে সবকিছুকে পেছনে ফেলে কঠোর পরিশ্রম আর আত্মনিবেদনের কারণেই আজকের ফেরদৌসী কাদরীতে নিজেকে পরিণত করতে পেরেছি।

এক নজরে ড. ফেরদৌসী কাদরী
ফেরদৌসী কাদরী ১৯৫১ সালের ৩১ মার্চ মাসে বাংলাদেশের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও আণবিক জীববিদ্যাবিভাগ থেকে ১৯৭৫ সালে বিএসসি ও ১৯৭৭ সালে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর চিকিৎসা গবেষণায় পারদর্শী হয়ে উঠতে তিনি যুক্তরাজ্যে যান জৈব রসায়ন নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করতে। ১৯৮০ সালে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন/প্রতিষেধকবিদ্যা বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

এরপর আইসিডিডিআর,বির প্রতিষেধক বিদ্যা বিভাগ থেকে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা শেষ করার পর তিনি একই প্রতিষ্ঠানে ১৯৮৮ সালে সহযোগী বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি একই প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী এবং মিউকোসাল ইমিউনলজি এবং ভ্যাকসিনোলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান।

ড. ফেরদৌসী কাদরী বাংলাদেশ আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজির আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশের বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির সদস্য। তার গবেষণার প্রধান বিষয় হলো অন্ত্রের রোগ। বিশেষ করে ইমিউনলজি, জিনোমিক্স,প্রোটোমিক প্রযুক্তি এবং ডায়াগনস্টিকস এবং ভ্যাকসিনে উন্নতি সাধন। তিনি বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের জন্য নতুন ধরনের সস্তা কলেরা টিকা উন্নয়নে কাজ করেছেন। তিনি ব্যয়বহুল ‘ডকোরাল’ টিকার পরিবর্তে ‘শানকল’ নামক একটি টিকা ঢাকায় ব্যবহার করে সফলতা লাভ করেন। পরবর্তীতে টিকাটি বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।

ড. কাদরীর নানা অর্জন
২০০৮ সালে ফিরদৌসী কাদরী বাংলাদেশ বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির গোল্ড মেডেল প্রাপ্ত হন। তিনি ২০০২ সালে উন্নয়নশীল দেশে সংক্রামক আন্ত্রিকরোগ গবেষণার জন্য ক্রিস্টোফ মেরিএউক্স পুরস্কার পান। ২০১৩ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য বিশ্ব বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির বার্ষিক সিএনরাও পুরস্কার পান। জাতিসংঘের প্রস্তাবিতএকটি প্রযুক্তি ব্যাংক এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের সাপোর্টিং ব্যবস্থাসমূহ সাংগঠনিকভাবে আরও কর্মক্ষম করে তুলতে ২০১৪ সালে তাকে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্যানেলের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

এরপর উন্নয়নশীল দেশে শিশুদের সংক্রামক রোগ চিহ্নিতকরণ ও বিশ্বব্যাপী এর বিস্তার রোধে প্রাথমিক চিকিৎসা কার্যক্রম এবং টিকাদান কর্মসূচি জোরদারে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ২০২০ সালে তিনি ‘লরিয়েল-ইউনেস্কো উইমেন ইন সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড’ (এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল) লাভ করেন। ২০১৩ সালে অনন্যা শীর্ষ ১০ পুরস্কার পান। এরপর তিনি র‌্যামোন ম্যাগসেসে পুরস্কারে ভূষিত হন ২০২১ সালে। এছাড়া ২০২১ সালে সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় তিনি অন্তর্ভুক্ত হন। সর্বশেষ ২০২৩ সালে সরকার তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করে।

টিআই/এসকেডি