দেশে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে চাষাবাদের কারণে পরিবেশ ও জলবায়ুর মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, বর্তমান সময়ে উচ্চ ফলন ও অতিরিক্ত লাভের আশায় ফলমূল, শাকসবজি থেকে শুরু করে মাছ-মাংসসহ সবকিছুতে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব একদিকে মানুষের শরীরের প্রবেশ করছে অন্যদিকে পানি-মাটির সঙ্গে মিশে পরিবেশ বিষাক্ত হচ্ছে। যার ফলে চোখের সামনেই ক্যান্সার, কিডনি থেকে শুরু করে নানা ভয়াবহ রোগ হচ্ছে। আবার বিষাক্ত প্রকৃতিতে একের পর এক নেমে আসছে ঘূর্ণিঝড়-খরাসহ নানা বিপর্যয়।

এ অবস্থায় জলবায়ুর ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি জাতীয়ভাবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কর্মকৌশল প্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সোমবার (২৭ মে) বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম (বিসিজেএফ) ও জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের (নিমকো) যৌথ আয়োজনে ‘জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় গণমাধ্যম’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক সচিব সত্যব্রত সাহা। এসময় তিনি বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। দুর্যোগ হলো জলবায়ু পরিবর্তনের অনেকগুলো অনুষঙ্গের ফলাফল। বিভিন্ন কারণে দুর্যোগের পৌনঃপুনিকতা বেড়েছে। দেশে বাণিজ্যিক চাষাবাদ জলবায়ু পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখছে। বর্তমান সময়ে ফলমূল শাকসবজি থেকে শুরু করে সবকিছুতেই ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে।

সাবেক এ সচিব বলেন, আমাদের সমাজে এমন কোনো খাবার নেই যেগুলোতে ভেজাল নেই। মাছ, গরু, মুরগিসহ সব ধরনের ফার্মে নিয়ন্ত্রণহীন অ্যান্টিবায়োটিক ও ক্ষতিকর খাদ্য মেশানো হচ্ছে। এতে করে আমাদের পুরো প্রজন্মটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আপনার আমার সন্তানরা আমাদের চোখের সামনেই এসব ক্ষতিকর খাবারের ভয়াবহতার মুখোমুখি হচ্ছে।

সত্যব্রত সাহা বলেন, পলিটিক্যাল লিডারশিপ মডিফাই করতে না পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। আমাদের পার্লামেন্টের দিকে তাকালে সেখানে পলিটিক্যাল লোকজন খুবই কম পাবেন, যারা আছে তাদের অধিকাংশই বিজনেসম্যান। যে কারণে ব্যবসায়িক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের এবং দেশের মানুষের জন্য ভালো কোনো পদক্ষেপ তারা নিতে পারেন না। সবমিলিয়ে আমি মনে করি পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি থেকে বাঁচতে হলে আমাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কমিটমেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব তন্ময় সাহা। তিনি বলেন, উন্নয়নে যেতে হলে জলবায়ুর ক্ষতি হবেই। উন্নত দেশগুলো পরিবেশ নষ্ট করেই উন্নত হয়েছে। কিন্তু আমরা যদি উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে যেতে চাই আমাদেরকে পরিবেশের ক্ষতির কথা বলে থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি দেখি আমাদের বঙ্গোপসাগরকে একটি বিশ্ব ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে। উন্নত বিশ্বের যতসব ময়লা আবর্জনা বঙ্গোপসাগরে এনে ফেলা হচ্ছে।

সুকান্ত ভট্টাচার্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে রেখে যেতে হবে, আগামী প্রজন্মের কাছে এই হোক অঙ্গীকার।’ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে উন্নয়নের একটি সংযোগ রয়েছে। যেসব দেশ উন্নতি করেছে, তারা জলবায়ুর ক্ষতি করেই উন্নয়ন কাজ পরিচালনা করেছে, সুতরাং সেসব দেশের এখন দায়বদ্ধতা খুব বেশি।

তন্ময় সাহা বলেন, আগে গ্রামের কৃষকরা বাংলা সনের তারিখ দেখে ফসল বুনত, এখন ঋতু পরিবর্তন হয়ে গেছে, কৃষকরা এখন আর আকাশের দিকে তাকিয়ে চাষাবাদ করে না। তিনি এসময় ডেল্টা প্ল্যান নিয়ে সাংবাদিকদের স্টাডি করার আহ্বান জানান।

কর্মশালায় বক্তারা বলেন, এখন যেভাবে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হচ্ছে, সেভাবে চলতে থাকলে আগামী ১০ বছরের মধ্যেই আমাদের কার্বন বাজেট শেষ হয়ে যাবে। অর্থাৎ প্রাক-শিল্পায়ন সময়ের তুলনায় বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য আমাদের কাছে ১০ বছরেরও কম সময় আছে। তার মানে বিশ্বজুড়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন কমিয়ে আনার জন্য আগামী ১০ বছরের মধ্যেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদসহ পুরো সমাজকে।

তারা বলেন, আমরা ইতিহাসের এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে নির্ধারিত হবে আগামী ৫০ বছরে পৃথিবীর চেহারা কেমন হতে যাচ্ছে। আমাদের হাতে সময় নেই। আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। সাংবাদিকদের বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তাহলে এ বিষয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা সম্ভব।

কর্মশালায় আরও বক্তব্য দেন দৈনিক কালবেলার সম্পাদক ও প্রকাশক সন্তোষ শর্মা, ডিবিসি নিউজের সম্পাদক প্রণব সাহা। আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরামের (বিসিজেএফ) সভাপতি কাওসার রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন। কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) সুফী জাকির হোসেন।

অনুষ্ঠানে বিভিন্ন গণমাধ্যমের ৪০ জন সংবাদকর্মী অংশ নেন।

টিআই/এসএসএইচ