দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। গত বছরের মার্চে দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর ভাইরাসটি থেকে রক্ষা পেতে লোকজনকে মাস্ক পরার পাশাপাশি নিয়মিত হাত ধোয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন চিকিৎসকরা। কমবেশি মানুষ এই নির্দেশনা মেনে চলেছেন। ফলে করোনা সংক্রমণ কমার পাশাপাশি দেশে ডায়রিয়া ও কলেরায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও অনেকটা কমে এসেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) তথ্য মতে, সোমবার (২৪ মে) বিকেল ৩টা পর্যন্ত তাদের হাসপাতালে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ১৪১ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর আগের দিন অর্থাৎ ২৩ মে হাসপাতালটিতে ২৩৭ জন এবং ২২ মে ২০৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছিলেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে হাসপাতালটিতে ডায়রিয়া-কলেরায় আক্রান্ত হয়ে একদিনে সর্বোচ্চ ৬৫০ রোগী ভর্তি হয়েছিলেন। স্বাভাবিক সময়ে (করোনা পরিস্থিতি ছাড়া) দিনে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১০০ থেকে ১২০০ পর্যন্ত।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে হাসপাতালটিতে ডায়রিয়া-কলেরায় আক্রান্ত হয়ে একদিনে সর্বোচ্চ ৬৫০ রোগী ভর্তি হয়েছিলেন। স্বাভাবিক সময়ে (করোনা পরিস্থিতি ছাড়া) দিনে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১০০ থেকে ১২০০ পর্যন্ত

আইসিডিডিআর,বির হাসপাতাল শাখার প্রধান ডা. বাহারুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কলেরা বা ডায়রিয়ার মূলত দুটি পিক রয়েছে। একটি হলো গরমের সময়, অপরটি শীতের সময়। গরমেরটা সাধারণত এপ্রিল-মে মাসের দিকে হয়ে থাকে। আবার যখন বৃষ্টি শুরু হয়, তখন পিকটা নিচের দিকে চলে যায় অর্থাৎ কমতে শুরু করে। চলতি বছরেও আমরা পিক পেয়েছি কিন্তু অন্যান্য বছরের মতো নয়। যেমন- ২০১৯ সালের এ সময়ে প্রতিদিন ১০০০ বা ১১০০ মতো রোগী পেয়েছি। এ বছরে আমাদের সর্বোচ্চ রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৫০ জন, যা এপ্রিল মাসের শুরুতে হয়েছিল। ২০২০ সালে রোগীর সংখ্যা আরও কম ছিল। ওই সময় দিনে ৩০০ এর ওপর রোগী হয়নি। গত বছর খুবই কম ছিল, এ বছর একটু বেড়েছে।

বড়দের পাশাপাশি শিশুদেরও খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যদি ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেখি; গরমের সময় দৈনিক ১১০০ থেকে শুরু করে ১২০০ পর্যন্ত রোগী এখানে ভর্তি হয়েছিলেন। এ বছর একদিনে সর্বোচ্চ ৬৫০ রোগী ভর্তি হয়েছিলেন এপ্রিলে। তাহলে বুঝতেই পারছেন, করোনার সময় রোগীর সংখ্যা কী পরিমাণ কমেছে। আরেকটা পিক হয় শীতের সময়। যা সাধারণত অক্টোবর, নভেম্বর বা ডিসেম্বরের দিকে হয়। তখন সংক্রমণটা ছড়ানোর জন্য দায়ী রোটাভাইরাস। আর গরমের সময়ে বেশি দায়ী হয় কলেরা।’

কলেরা-ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা কমার কারণ প্রসঙ্গে ডা. বাহারুল আলম বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে এখন মানুষ নিয়মিত হাত ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকছেন। তবে এটাই যে সংক্রমণ কমার কারণ তা বলছি না। আরও কিছু কারণ আছে। তবে সবগুলোই কোভিড সংক্রান্ত।’

তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ে আমরা রাস্তার পাশে অসংখ্য উন্মুক্ত খাবারের (স্ট্রিট ফুড) দোকান দেখি। কিন্তু গত বছর থেকে এসব দোকানের প্রায় সবই বন্ধ রয়েছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে বাইরের খাবার কম খেয়েছে। কলেরা সংক্রমণ কমার এটিও অন্যতম কারণ হতে পারে।

রাস্তার পাশের উন্মুক্ত খাবারের দোকান না থাকায় কলেরা-ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যাও এবার কম

এ প্রসঙ্গে আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতকাল আমাদের পুরো হাসপাতালে প্রায় ৩০০ রোগী ছিল। অন্য বছরের সঙ্গে যদি আমরা তুলনা করি তাহলে এ সংখ্যা অনেক কম। কম রোগী হওয়ার কারণ দুটি হতে পারে। প্রথমত, হতে পারে এ লকডাউনের কারণে মানুষ হাসপাতালে একটু কম আসছে। দ্বিতীয়ত, মানুষ করোনা থেকে বাঁচতে নিয়মিত হাত ধোয়ার চর্চা করছেন, এতে কলেরা-ডায়রিয়া কম হতে পারে।

হাত ধোয়া শুধু করোনা থেকে আমাদের বাঁচাবে না— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ডায়রিয়া, কলেরা, নিউমোনিয়াসহ আরও বিভিন্ন রোগ থেকে বাঁচিয়ে থাকে।

চিকিৎসকদের মতে, পরিপাকতন্ত্রে সাধারণত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা পরজীবী সংক্রমণের কারণে ডায়রিয়া বা কলেরা হয়। এর মধ্যে ডায়রিয়ার প্রধান কারণ রোটা ও নোরো ভাইরাস। পাতলা পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলে বা প্রচণ্ড জ্বর দেখা দিলে তা ভাইরাস নয়, ব্যাকটেরিয়া বা পরজীবী সংক্রমণের কারণে হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে।

গরমের এ সময় দৈনিক ১১০০-১২০০ রোগী ভর্তি হতেন আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে। কিন্তু এবার তেমনটি দেখা যায়নি

জাতিসংঘের শিশু সহায়তা তহবিল ইউনিসেফের গবেষণা অনুযায়ী, মলত্যাগের পর সাবান দিয়ে হাত ধুলে ডায়রিয়ার আশঙ্কা ৪০ শতাংশ কমে যায়। বড়দের পাশাপাশি শিশুদেরও খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

এছাড়া নখ কেটে সবসময় ছোট রাখতে হবে। শিশুদের প্রতি বেশি যত্নবান হতে হবে। তারা বাইরে খেলাধুলা করে, ঘরের ছোট ছোট জিনিস হাতে নিয়ে মুখে দেয়। এ কারণে খাবার সবসময় ঢেকে পরিষ্কার স্থানে রাখতে হবে। ডায়রিয়া-কলেরা থেকে বাঁচতে সবসময় ঘরে স্যালাইন ও জিঙ্ক ট্যাবলেট রাখা উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শে জিঙ্ক ট্যাবলেট খেলে ভবিষ্যতে ডায়রিয়া হওয়ার ঝুঁকিও কমে যায়।

টিআই/জেডএস/এমএআর/