প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় নতুন দিগন্ত
শিশুদের এনসিডি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সেবা মডেল
বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে দ্রুত বাড়তে থাকা অসংক্রামক রোগ ব্যবস্থাপনায় একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে আইসিডিডিআর,বি। প্রতিষ্ঠানটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মধ্যে প্রথমবারের মতো শিশুদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ এনসিডি সেবা মডেল তৈরি ও পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়ন করেছে।
মঙ্গলবার (১ জুলাই) রাজধানীর মহাখালীতে আইসিডিডিআর,বির সাসাকাওয়া অডিটোরিয়ামে আয়োজিত সেমিনারে ‘ডিজাইনিং অ্যান্ড পাইলটিং পেডিয়াট্রিক এনসিডি সার্ভিস মডেল ফর চিলড্রেন অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্টস অ্যাট প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ফ্যাসিলিটিস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়।
বিজ্ঞাপন
সেমিনারে জানানো হয়, গবেষণায় দেশের বাস্তবতায় ছয়টি প্রধান এনসিডি চিহ্নিত করা হয়। সেগুলো হলো– ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা, জন্মগত হৃদরোগ, মৃগী (এপিলেপসি), থ্যালাসেমিয়া, কিডনি রোগ (নেফ্রোটিক সিনড্রোম), এবং টাইপ-১ ডায়াবেটিস। ২০২৪ সালে এসব রোগ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি জাতীয় চিকিৎসাসেবা নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়। এতে চিকিৎসকদের জন্য নির্দিষ্ট ক্লিনিক্যাল নির্দেশনা, ওষুধ ব্যবস্থাপনা এবং রেফারাল গাইডলাইন অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আরও বলা হয়, ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে কিশোরগঞ্জ জেলার ১২টি এবং বাগেরহাট জেলার ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও দুটি জেলা হাসপাতালে এই মডেল কার্যকর করা হয়। এ কার্যক্রমের আওতায় ০ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের জন্য একীভূত ও নিবেদিত এনসিডি সেবা চালু হয়।
বিজ্ঞাপন
ফলাফলে জানানো হয়, শুরুতেই সাত সপ্তাহে মোট ৩৮৫ জন শিশু এনসিডি সেবার আওতায় আসে। তাদের মধ্যে ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমায় আক্রান্ত শিশু ৩৬.৬ শতাংশ, থ্যালাসেমিয়া ও আয়রন ঘাটতিজনিত রক্তশূন্যতায় ২৭.৫ শতাংশ, জন্মগত হৃদরোগে ১৯.১ শতাংশ, মৃগী রোগে ১৩.৬ শতাংশ, কিডনি রোগে ২.২ শতাংশ এবং টাইপ-১ ডায়াবেটিসে ১ শতাংশ রোগী পাওয়া যায়। এ ছাড়া প্রায় ৮ শতাংশ রোগীকে বিশেষায়িত কেন্দ্রে রেফার করা হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য।
গবেষণায় ২০০ জন চিকিৎসক, নার্স ও সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট মেডিকেল অফিসার এবং ৫০০ জনের বেশি কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেবার ধারাবাহিকতা ও তথ্য সংরক্ষণের জন্য ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা চালু করা হয়, যার মাধ্যমে প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে মাসিক রিপোর্ট জমা দেওয়ার ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। সেইসঙ্গে কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতা তৈরির জন্য সামাজিক ও আচরণগত পরিবর্তন বিষয়ক যোগাযোগ উপকরণ তৈরির পাশাপাশি লিফলেট বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়।
সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখার প্রাক্তন পরিচালক ও হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম ও ই-হেলথ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ড. শাহ আলী আকবর আশরাফী এবং এনসিডিসি প্রোগ্রাম লাইন ডাইরেক্টর অধ্যাপক ড. সৈয়দ জাকির হোসেন।
এসময় অধ্যাপক ড. সৈয়দ জাকির হোসেন তার বক্তব্যে অসংক্রামক রোগের প্রতিরোধের ওপর জোর দেন এবং এই গবেষণার ফলাফল থেকে প্রাপ্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এর কার্যক্রমকে আরও প্রসারিত করার আহ্বান জানান।
সেইসঙ্গে অধ্যাপক ড. শাহ আলী আকবর আশরাফী অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রস্তুত করা লিফলেটগুলো কমিউনিটিতে মায়েদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ওপর জোর দেন।
এসময় ইউনিসেফ বাংলাদেশের ম্যাটারনাল নিউবর্ন চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলসেন্ট হেলথের হেলথ ম্যানেজার দেওয়ান মো. এমদাদুল হক শিশুদের অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা সেবার আরও উন্নয়নে সম্মিলিতভাবে কাজ করার বিষয়ে আশাবাদ জানান।
গবেষণা প্রসঙ্গে আইসিডিডিআর,বির সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ও গবেষণার প্রধান গবেষক ড. আলিয়া নাহিদ বলেন, এই গবেষণা বাংলাদেশে শিশুদের অসংক্রামক রোগের চিকিৎসায় একটি টেকসই ও সম্প্রসারণযোগ্য মডেল স্থাপনের ভিত্তি রচনা করেছে, যা শুধু শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করছে না, বরং তাদের ভবিষ্যতেও সুস্থ ও সক্ষম জীবনযাপনের সম্ভাবনা নিশ্চিত করছে।
আইসিডিডিআর,বির নিউট্রিশন রিসার্চ ডিভিশনের সিনিয়র ডিরেক্টর ড. থেডিয়াস ডেভিড মে সমাপনী বক্তব্যে এই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সফলভাবে সম্পন্ন করতে অবদান রাখার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
এসএসএইচ