স্ট্রোক ও হৃদরোগের মতো প্রাণঘাতী জটিল রোগের আধুনিক ও কার্যকর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশি চিকিৎসকদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন জাপানের অভিজ্ঞ নিউরো ও কার্ডিয়াক সার্জনরা। রাজধানীর শিপ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতাল আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিয়ে তারা হাইব্রিড সার্জারি, নিউরোভাসকুলার ও হার্ট সংশ্লিষ্ট জটিল অস্ত্রোপচারের উন্নত কৌশল তুলে ধরেন।

রোববার (২০ জুলাই) ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই দিনব্যাপী সিএমই (কন্টিনিউয়িং মেডিকেল এডুকেশন) সেমিনারে অংশ নেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অন্তত ১৫০ জন চিকিৎসক ও সার্জন। কর্মশালায় ফুজিতা হেলথ ইউনিভার্সিটি জাপানের খ্যাতনামা নিউরোসার্জন অধ্যাপক তাকাশি ওসানাই এবং সিজুওকা সিটি হাসপাতালে কর্মরত অভিজ্ঞ হার্ট সার্জন ডা. কুন্তারো ওয়াকানো নিজ নিজ খাতের ক্লিনিক্যাল অভিজ্ঞতা ও লাইভ সার্জারি ভিডিও উপস্থাপন করেন।

সেমিনারের উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী গিয়াস উদ্দিন। উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি নিউরোভাসকুলার চিকিৎসার জটিলতা ও চিকিৎসকদের ভূমিকার দিকটি বিশেষভাবে তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, নিউরোলোজি কোনো সাধারণ মেডিসিন সাবজেক্ট নয়, এটি অত্যন্ত টেকনিক্যাল ও দ্রুত পরিবর্তনশীল একটি শাখা। এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রতিনিয়ত প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে চিকিৎসকদের শুধু চিকিৎসা কার্যক্রমেই নয়, সার্বক্ষণিক গবেষণা ও প্রশিক্ষণে যুক্ত থাকতে হয়। নতুন নতুন ডিভাইস, এন্ডোভাসকুলার টেকনিক, হাইব্রিড অপারেশন—সব মিলিয়ে এ শাখায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কাজী গিয়াস উদ্দিন আরও বলেন, বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে স্ট্রোক ও ব্রেইন ব্লিডিংয়ের মতো রোগের প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। আমাদের চিকিৎসকদের মধ্যে যদি এই আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডের স্কিল না থাকে, তাহলে আমরা রোগীদের সঠিক সময়ে সেবা দিতে পারব না। সেজন্যই এই ধরনের সেমিনার শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং দেশের চিকিৎসা সক্ষমতা বৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, নিউরোলজি ও নিউরোসার্জারি এখন আর কেবল চিকিৎসার বিষয় নয়, এটি গবেষণাভিত্তিক এক বিশেষায়িত শাখা। যারা এই খাতে ক্যারিয়ার গড়বেন, তাদের নিয়মিত আধুনিক প্রযুক্তির সাথে নিজেদের আপডেট রাখতে হবে। 

তিনি তরুণ চিকিৎসকদের উদ্দেশে বলেন, বিশ্বমানের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে চাইলে নিজস্ব গবেষণা ও ক্লিনিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যেতে হবে।

শিপ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালের সিইও ও উপদেষ্টা নিউরোসার্জন অধ্যাপক ডা. এম আলী আখতারের সঞ্চালনায় সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. সোহেল মাহমুদ। স্বাগত বক্তব্যে তিনি বলেন, আমরা কেবল হাসপাতাল গড়িনি, চিকিৎসা শিক্ষার একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চাচ্ছি। তরুণ চিকিৎসকরা যেন আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তি ও পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেন, সেটিই আমাদের লক্ষ্য।

প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ‘নিউরোভাসকুলার হাইব্রিড সার্জারি’ বিষয়ে আলোচনায় অধ্যাপক ওসানাই বলেন, স্ট্রোকের ক্ষেত্রে সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জাপানে যেভাবে কেস ম্যানেজ করি, তা আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করতে পেরে আনন্দিত। আশা করি এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে চিকিৎসা মান উন্নয়নে কাজে আসবে।

অন্যদিকে, ‘মিনিমালি ইনভ্যাসিভ কার্ডিওভাসকুলার প্রসিডিউরস’ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেন ডা. কুন্তারো ওয়াকানো। তিনি বলেন, হৃদরোগ চিকিৎসায় এখন আর খোলা সার্জারির যুগ নেই। ক্যাথল্যাব, হাইব্রিড অপারেশন থিয়েটার ও কম ইনভেসিভ পদ্ধতির মাধ্যমে ঝুঁকি কমিয়ে দ্রুত আরোগ্য নিশ্চিত করা যায়।

সেমিনারে কার্ডিয়াক সার্জন, নিউরোলজিস্ট, রেডিওলজিস্ট, অ্যানেসথেসিওলজিস্টসহ বিভিন্ন বিভাগের তরুণ চিকিৎসকদের সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। দিনব্যাপী এই সিএমই কর্মশালার মাধ্যমে চিকিৎসা খাতে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও গবেষণাভিত্তিক পদ্ধতির সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপন হয়েছে বলে মতো দিয়েছেন অংশগ্রহণকারীরা।

উল্লেখ্য, শিপ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতাল নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা প্রশিক্ষণ ও সেমিনার আয়োজন করে থাকে। ভবিষ্যতে কার্ডিয়াক ও নিউরো সার্জারির পাশাপাশি ক্যান্সার, লিভার ও কিডনি চিকিৎসায়ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বে প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।

টিআই/এমএ