জুলাই ২০২৪। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সেই উত্তাল-বিভিষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতি আজও সবার মনে তরতাজা। আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু শাহবাগ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ পুরো রাজধানীজুড়ে তখন অনেকটা ‘যুদ্ধাবস্থা’ বিরাজ করছিল। সেই ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ থেকে অনেকে আহত হয়ে, কেউবা গুলি খেয়ে বাঁচার শেষ আশ্রয় হিসেবে ছুটেছিলেন হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে পৌঁছেও তারা পাননি সেবা, পাননি সহানুভূতির হাত। উল্টো বিভিন্ন কারণে আহত রোগীদের করা হয়েছে গালিগালাজ আর মানসিক টর্চার।

এসব ঘৃণ্য কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন তৎকালীন বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত ‘আওয়ামী’ চিকিৎসকরা। অথচ তারাও ছিলেন মহান চিকিৎসা পেশার ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ নেওয়া একেকজন চিকিৎসক।

সম্প্রতি ঢাকা পোস্টকে দেওয়া একান্ত আলাপচারিতায় বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. রুহুল কুদ্দুস বিপ্লব সেই অন্ধকার সময়ের চিত্র তুলে ধরে এসব কথা বলছিলেন। সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে—কীভাবে হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো পরিণত হয়েছিল ‘নিষেধের দুর্গে’, কীভাবে আহতদের ব্যথার আর্তনাদ দমিয়ে রেখেছিল রাজনীতির বরফচাপা। আর সেই অন্ধকারের মধ্যেও কিছু আলোর দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন গুটি কয়েক সাহসী, মানবিক চিকিৎসক—যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিলেন অচেনা সেই মুখগুলোকে।

ডা. বিপ্লব বলেন, “জুলাই বিপ্লবের সময় আমরা দেখেছি—যেখানে মানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে পড়ে কাতরাচ্ছে, সেখানে কিছু চিকিৎসক নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই বলেছে, ‘ওদের চিকিৎসা দেওয়া যাবে না।’ হাসপাতালের গেটের সামনে নিজেদের দলীয় অস্ত্রধারী গুন্ডাদের দিয়ে পাহারা বসানো হয়েছিল, যেন রোগীরা হাসপাতালে এসে ঢুকতে না পারে। কিছু চিকিৎসক গিয়ে সেবা দিতে চাইলে তাদেরও নানাভাবে হয়রানি ও ভয় দেখানো হয়েছিল।”

তিনি বলেন, সেদিন বহু চিকিৎসক সহকর্মী চেয়েও সেবা দিতে পারেননি, বাধা পেয়েছেন রাজনৈতিক প্রভাবশালী চিকিৎসকদের কাছে। “বিশেষ করে স্বাচিপপন্থি চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ সেদিন মানবতা ভুলে গিয়েছিল। তারা ভুলে গিয়েছিল—চিকিৎসা কোনো রাজনৈতিক পেশা নয়, এটা একটি নৈতিক দায়িত্ব। তারা ভুলে গিয়েছিল—‘ওথ অব হিপোক্রেটস’।"

‘৪ আগস্ট ২০২৪ ছিল এক বিভীষিকাময় সকাল’

ডা. মো. রুহুল কুদ্দুস বিপ্লব সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আমার জীবনে ৪ আগস্ট ২০২৪ ছিল এক বিভীষিকাময় সকাল। আগুন জ্বলছিল আমার কর্মস্থল বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। আমি তখন প্রেসক্লাবে এক পেশাজীবী সংগঠনের প্রোগ্রামে ছিলাম। সেখানেই শুনতে পেলাম—আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আগুন! দ্রুত ফিরে যেতে চাইলাম, কিন্তু যেতে পারিনি। একদিকে আগুন, অন্যদিকে সন্ত্রাস। তারা কোনোভাবেই আমাদের হাসপাতালের ভেতর ঢুকতে দেবে না।’

এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা শুনেছি বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অ্যাম্বুলেন্সগুলো আহতদের বহন করছিল, সেগুলো যাতে এই সেবা কার্যক্রম চালাতে না পারে, সেজন্য অ্যাম্বুলেন্সগুলোতে আগুন দেওয়া হয়েছিল। শুনেছি সেদিন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রক্তাক্ত তরুণদের চিকিৎসা না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি কেউ পাঞ্জাবি পরা, মুখে দাড়ি আর মাথায় টুপি থাকলে তাকে ‘জামাতি’ বা ‘জঙ্গি’ বলে চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে। কেউ কেউ তো গালিগালাজ করে বলেছে—‘দেশটাকে শেষ করে দিচ্ছিস, যা গিয়ে রাস্তায় মর!’

তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “এটা যে কেবল অমানবিকতা নয়, এটা ছিল সরাসরি ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ ভঙ্গ করার শামিল। চিকিৎসক হিসেবে আমরা শপথ নেই—জাতি, ধর্ম, রাজনৈতিক পরিচয়, কিছুই দেখে না একজন প্রকৃত চিকিৎসক। কিন্তু সেই সময় তা ভুলে গিয়েছিল অনেকেই।”

জুলাইয়ের রক্তাক্ত হাসপাতাল করিডোর

ডা. বিপ্লব তখনকার হাসপাতালের মেঝে-বারান্দা ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে বলেন, “সেই সময়ে ঢাকার প্রায় প্রতিটি হাসপাতালের মেঝে-বারান্দাগুলোতে রক্তাক্ত অবস্থায় মানুষ পড়ে ছিল। তখন রোগী ও তাদের স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়লেও ঠিকমতো চিকিৎসা মিলছিল না। আমরা যেসব ছবি অন্য দেশের যুদ্ধক্ষেত্রের হাসপাতালে দেখি, সেই ছবি আমি বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে নিজের চোখে দেখেছি।”

তিনি বলেন, ‘অনেক চিকিৎসক তখন আতঙ্কে পালিয়ে গিয়েছিলেন। যাদের পাওয়া গিয়েছিল, তাদের কেউ ন্যূনতম প্রশিক্ষণ ছাড়াই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকতে বাধ্য হয়েছিলেন।’

‘আমরা যেখানে জেনারেল সার্জন দরকার, সেখানে নিউরোসার্জন কাজ করেছে। থোরাসিক সার্জনের জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল এমবিবিএস পাস করা নবীন চিকিৎসক। ওই সময় মানবতা রক্ষা করতে গিয়ে, পেশাগত কাঠামোও ভেঙে পড়েছিল। তবুও কিছু চিকিৎসক ছিলেন, যারা সত্যিকার অর্থেই ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ রক্ষা করেছিলেন।”

...তবু সেই অন্ধকারের মধ্যেও কিছু আলো ঠিকই জ্বলেছিল

যখন রাজনৈতিক পরিচয়ের দোহাই দিয়ে একদল চিকিৎসক মানুষকে ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন কিছু সাহসী চিকিৎসক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আহতদের পাশে। তাদের কেউ কেউ ছিলেন সরকারি প্রতিষ্ঠানে, আবার কেউ বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক, যারা গোপনে-লুকিয়ে সরকারি হাসপাতালে এসে আহতদের সেবা দিয়েছেন।

ডা. রুহুল কুদ্দুস বিপ্লব বলেন, “আমরা দেখেছি, অনেক চিকিৎসক সারাদিন সরকারি হাসপাতালে কাজ করে রাতে আবার বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এসে সম্পূর্ণ বিনা-পারিশ্রমিকে এসে কাজ করেছেন। অনেক চিকিৎসককে দেখেছি যারা বেসরকারিতে কাজ করেন, কিন্তু সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট থাকায় গোপনে সরকারি হাসপাতালে এসে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন।”

“অনেক সিনিয়র দিনের বেলায় আসতে পারেননি, কিন্তু রাতে এসে অপারেশনে সহযোগিতা করেছেন। কেউ ফোনে গাইড করেছেন।”

তিনি বলেন, “তাদের নাম হয়ত কেউ জানে না, তারা কোনো ব্যানার বা সংগঠনের আওতায় ছিলেন না—তবে তাদের এই নিঃশব্দ ভূমিকা ইতিহাসে লেখা থাকা উচিত। কারণ এই নৈতিক অবস্থানই প্রমাণ করে—সব চিকিৎসক অমানবিক ছিলেন না, বরং কিছু মানুষই সেদিন চিকিৎসকের আসল সংজ্ঞাকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন।”

এমন চিকিৎসকদের কেউ আবার সরাসরি হুমকিও পেয়েছেন। একজন সিনিয়র কনসালটেন্ট রাত ৩টায় এসে এক তরুণের ব্রেইন হেমোরেজের অস্ত্রপচারে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন—“মানুষ বাঁচাতে যদি আমার পদ যায়, যাক। অন্তত আমি চিকিৎসক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছি।”

‘চেতনার জায়গাটিই হোক মূল অস্ত্র’

ডা. বিপ্লব মনে করেন, জুলাইয়ের সেই বিপ্লব শুধু রাজনৈতিক বা সামাজিক নয়, এটা একটি ‘চেতনাগত বোধ’ গঠনের সূচনা করেছে। তিনি বলেন, ‘সেই সময় দেশের মানুষ বুঝে গেছে, কাদের বিরুদ্ধে তাদের এক হতে হবে। জুলাই আমাদের শিখিয়ে গেছে—বিদেশি আধিপত্য, সাম্রাজ্যবাদ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে পুরো জাতি একত্র হতে পারে। এর চেয়ে বড় চেতনার জায়গা আর কিছু হতে পারে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেই একতা যদি আমরা ধরে রাখতে পারি, রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে গিয়ে যদি আমরা এই মানবিক মূল্যবোধকে প্রধান করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশে আর কোনোদিন কেউ চিকিৎসা না পেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকবে না। তখন এই দেশ সত্যিকার অর্থেই পাবে তার মুক্তি।’

টিআই/এসএম