বাংলাদেশের নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে এক নীরব হুমকি ঘুরে বেড়াচ্ছে– ক্যান্ডিডা অরিস নামে এক ছত্রাক, যাকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন হাসপাতাল-সম্পর্কিত ‘সুপারবাগ’। আইসিডিডিআর,বির নতুন গবেষণা দেখাচ্ছে, এনআইসিইউতেই এই ছত্রাকের সংক্রমণ নিয়মিত ঘটছে এবং আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুঝুঁকিও উদ্বেগজনক। পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে গবেষকদের মতে, হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও পৃষ্ঠতলগুলোতে ক্লোরিনভিত্তিক জীবাণুনাশক ছাড়া কার্যকর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

সম্প্রতি মাইক্রোবায়োলজি স্পেকট্রাম জার্নালে প্রকাশিত আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। রোববার (৯ নভেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, হাসপাতাল-সম্পর্কিত সংক্রমণ (এইচএআই) বাংলাদেশসহ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে দীর্ঘদিনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এর মধ্যে দ্রুত ছড়ানোর ক্ষমতা এবং উচ্চ মৃত্যুহারের জন্য ক্যান্ডিডা অরিস এখন সবচেয়ে আলোচিত নাম। মানুষের ত্বকে কোনো লক্ষণ ছাড়াই অবস্থান করতে সক্ষম এই ছত্রাক প্রায়শই রক্তের মতো জীবাণুমুক্ত অংশে প্রবেশ করে প্রাণঘাতী সংক্রমণ তৈরি করে।

গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে এই ছত্রাক ছড়িয়ে পড়ছে। আইইডিসিআরের সহযোগিতায় এবং সিডিসির অর্থায়নে পরিচালিত এ গবেষণা ঢাকার দুটি টারশিয়ারি লেভেল হাসপাতালে সম্পন্ন হয়।

২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৭৪ জন নবজাতকের ওপর এ অনুসন্ধান চালান গবেষকরা। ফলাফলে দেখা যায়, ৩২ জন শিশুর (৯ শতাংশ) ত্বকে ক্যান্ডিডা অরিস পাওয়া গেছে। আর একজন শিশুর রক্তে ধরা পড়ে সক্রিয় সংক্রমণ। এই ৩২ জনের মধ্যে ১৪ জন ভর্তি হওয়ার সময়ই আক্রান্ত ছিল, বাকিরা হাসপাতালে থাকার সময় সংক্রমিত হয়– যা স্পষ্ট করে দেয়, এনআইসিইউতেই ছত্রাকটি সক্রিয়ভাবে ছড়াচ্ছে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক নজরে আনে গবেষণাটি। ভর্তি হওয়ার সময় আক্রান্ত ১৪ নবজাতকের মধ্যে ১৩ জন এসেছিল অন্য হাসপাতাল বা ওয়ার্ড থেকে– যা দেখায়, হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল সংক্রমণও একটি বড় উপাদান। আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ৭ জনের মৃত্যু হয়, তাদের মধ্যে রক্তে সংক্রমিত শিশুটিও ছিল।

আইসিডিডিআর,বির আরেকটি সাম্প্রতিক গবেষণার সঙ্গে এই ফলাফল মিলে যায়, হাসপাতালে নতুন ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে লোকালয় থেকে ক্যান্ডিডা অরিস পাওয়া যায়নি। এর মানে ছত্রাকটি মূলত হাসপাতালের পরিবেশেই টিকে থাকে ও ছড়ায়।

গবেষণায় আরও দেখা যায়, ক্যান্ডিডা অরিসের মাত্র ৯ শতাংশ আইসোলেট একাধিক অ্যান্টিফাঙ্গালে প্রতিরোধী হলেও ৮২ শতাংশ ছিল ফ্লুকোনাজোল-প্রতিরোধী, যে ওষুধটি সাধারণত রক্তে ছত্রাক সংক্রমণের প্রথম সারির চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে চিকিৎসার চ্যালেঞ্জ বাড়ছে।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, আক্রান্ত নবজাতকদের ৮১ শতাংশের জন্ম হয়েছে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে। গবেষকদের ধারণা, সিজারিয়ান ডেলিভারির পর দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থাকার কারণে এদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি।

আইসিডিডিআর,বির সংক্রামক রোগ বিভাগের সহযোগী বিজ্ঞানী ডা. ফাহমিদা চৌধুরী বলেন, এই গবেষণা এনআইসিইউতে গুরুতর অসুস্থ ও ঝুঁকিপূর্ণ নবজাতকদের মধ্যে ক্যান্ডিডা অরিস সংক্রমণের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ দিয়েছে। এটি প্রশাসনিক ও নীতিগতভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার এক অত্যাবশ্যক ধাপ।

গবেষকরা সতর্ক করেছেন, এই ছত্রাক হাসপাতালে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, বেড রেল, মনিটর, ইনকিউবেটরসহ নানা পৃষ্ঠতলে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারে। তাই ক্লোরিনভিত্তিক কার্যকর জীবাণুনাশক দিয়ে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ছাড়া বিকল্প নেই। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীদের হাত ধোয়ার অভ্যাস উন্নত করার ওপরও তারা জোর দিয়েছেন।

সবশেষে গবেষণা দল বলছে, এনআইসিইউতে ক্যান্ডিডা অরিস সংক্রমণের ধারাবাহিক নজরদারি এখন অত্যন্ত জরুরি। তবেই দ্রুত আক্রান্ত নবজাতকদের শনাক্ত ও আলাদা রাখা, সংক্রমণ ছড়ানো রোধ এবং প্রয়োজনীয় অ্যান্টিফাঙ্গাল চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

টিআই/এসএসএইচ