বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার। চীনের প্রযুক্তি এবং বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরিচালিত এই সেন্টারটি শুধু আধুনিক নয়, বরং পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা দুর্ঘটনায় শয্যাশায়ী রোগীদের জন্য জীবন পরিবর্তনকারী সেবা প্রদান করছে।

ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে সেবাপ্রাপ্তদের মধ্যে যারা বিছানা থেকে উঠতেও পারতেন না, তারা ধীরে ধীরে হাঁটার শক্তি ফিরে পাচ্ছেন। এমনকি এই অল্প কিছুদিনের আধুনিক ও উন্নতমানের সেবায় আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার নতুন ভোরের গল্প শোনাচ্ছেন রোগীদের অনেকেই।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশের প্রথম এআইভিত্তিক এই রোবটিক সেন্টারের অগ্রণী সেবা দেশের হাজার হাজার রোগীর জন্য নতুন আশা তৈরি করবে। এমনকি জটিল এসব রোগের চিকিৎসায় বিদেশ নির্ভরতা কমবে।

রোবটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে রয়েছে ৬২টি রোবট, যার মধ্যে ২২টি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নির্ভর। এই রোবটগুলো রোগীর শরীরের নড়াচড়া, পেশির প্রতিক্রিয়া, ব্যথার মাত্রা ও ভারসাম্য বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চিকিৎসা প্রক্রিয়া চালায়। এছাড়া প্রতিটি রোবটে সংযুক্ত রয়েছে সেন্সর-ভিত্তিক ফিডব্যাক সিস্টেম, যা চিকিৎসককে রিয়েল টাইম ডেটা দেয়। যেমন— কোনো স্ট্রোক রোগীর ডান হাতে কতটা শক্তি ফিরে এসেছে, পেশির স্পন্দন কীভাবে সাড়া দিচ্ছে, হাঁটার সময় ভারসাম্য কোথায় ভেঙে যাচ্ছে— সবকিছু তাৎক্ষণিকভাবে পরিমাপ করে রোবট নিজেই থেরাপির মাত্রা নির্ধারণ করতে পারে।

চিকিৎসকরা জানান, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে স্ট্রোক, পক্ষাঘাত, নার্ভ ইনজুরি, ফ্রোজেন শোল্ডার, দুর্ঘটনাজনিত জটিলতা বা দীর্ঘমেয়াদি ব্যথার মতো জটিল রোগে আক্রান্তদের জন্য ব্যক্তিনির্ভর ও নিখুঁত চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হবে।

আধুনিক প্রযুক্তির সম্মিলন : কী থাকছে এই সেন্টারে

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারটি মোট ৬২টি রোবোটিক ইউনিট দ্বারা সজ্জিত, যার মধ্যে ২২টি সরাসরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা চালিত। প্রতিটি যন্ত্র নির্দিষ্ট শারীরিক পুনর্বাসন চাহিদার ওপর ভিত্তি করে ডিজাইন করা হয়েছে। এর আওতায় থাকবে রোবোটিক গেইট ট্রেইনিং সিস্টেম, এক্সোস্কেলিটন থেরাপি, রোবোটিক আর্ম রিহ্যাবিলিটেশন ডিভাইস, এআই-বেইজড নিউরোফিডব্যাক সিস্টেম এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) থেরাপি সিস্টেমসহ আরও অসংখ্য রোবোটিক যন্ত্রপাতি।

রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে দায়িত্বরত এক ফিজিওথেরাপিস্ট ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে রোবোটিক আর্ম এক্সোস্কেলেটন, যা ব্যবহৃত হবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের হাঁটার ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে। রোগীর শরীরের বাইরের অংশে লাগানো হয় এই যন্ত্রটি, যা পায়ের চলাচলকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। এছাড়া আহতদের চিকিৎসায় মাল্টি-অ্যাংগেল মুভমেন্ট ট্রেইনার ব্যবহার করা হবে স্ট্রোক বা নার্ভ ইনজুরিতে আক্রান্তদের জন্য। এটি রোগীর হাত বা পা নড়াচড়ায় সহায়তা করে এবং থেরাপির মাধ্যমে নার্ভ সিস্টেমের পুনরুজ্জীবন ঘটায়।

তিনি বলেন, সেন্টারটিতে থাকছে ইন্টেলিজেন্ট ব্যালান্স সিমুলেটর নামের একটি যন্ত্র, যাদের মেরুদণ্ড বা ব্রেইন ইনজুরির ফলে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে সমস্যা হয়, এটি তাদের সাহায্য করবে। এই যন্ত্রটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ভিত্তিক, যেখানে রোগীরা ভার্চুয়াল ট্র্যাক অনুসরণ করে চলাফেরা শিখতে পারেন। এ ছাড়া, ফিঙ্গার মোবিলাইজার ও পাম-গ্লাভ থেরাপি ইউনিট ব্যবহার করে হাতের প্যারালাইসিস বা গিলিয়েন-ব্যারে সিনড্রোমে আক্রান্তদের হাতের শক্তি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করা হয়।

১৩ জন রোগীর সফল চিকিৎসা, দ্রুত হাঁটার আশা ফিরছে তাদের

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার ইতোমধ্যে ১৩ জন রোগীর চিকিৎসা সম্পন্ন করেছে। এদের মধ্যে ১১ জন পুরুষ এবং দুজন মহিলা, যাদের বয়স ১৭ থেকে ৬১ বছর পর্যন্ত। প্রতিটি রোগীকে দেওয়া হয়েছে ২০ থেকে ৪০ মিনিটের থেরাপি সেশন। চিকিৎসার সময়কাল ছিল দুই সপ্তাহ থেকে এক মাস পর্যন্ত। রোগীদের দৈনন্দিন কাজের ক্ষমতা ও চলাচলের উন্নতি ডাক্তাররা ফাংশনাল ইন্ডিপেনডেন্স মেজার (ফিম) স্কোরিং পদ্ধতি ব্যবহার করে নিয়মিত মূল্যায়ন করছেন।

জানা গেছে, এসব রোগীদের রোবোটিক থেরাপির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে এআই-১, এআই-৩, এআই-৪, এআই-৫, এআই-৬ প্লাস, এআই-৭, এআই-৯, এআই-১৭ হ্যান্ড টেবিল, এসজিআই-১, ডিকে-২, ২০০০-ডি এবং ২০০০-ইসহ বিভিন্ন অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি।

কর্তব্যরতরা জানিয়েছেন, এই রোবোটিক যন্ত্রগুলো রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী নিজেই প্রোটোকল নির্ধারণ করে, কতটা সাহায্য দরকার এবং কোন অংশে কতটা সহায়তা দিতে হবে, তা নিখুঁতভাবে ঠিক করে দেয়। থেরাপি চলাকালীন কোনো রোগীর শরীরে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এর ফলে ধীরে ধীরে শয্যাশায়ী রোগীরাও উঠতে, বসতে এবং কিছুটা হাঁটতেও পারছেন। বিশেষ করে যারা আগে সম্পূর্ণভাবে শুয়ে ছিলেন, তারা এখন রোবোটিক থেরাপির মাধ্যমে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সামর্থ্য অর্জন করেছেন। চিকিৎসার এই উন্নতি শুধু রোগীর শারীরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে না, মানসিকভাবে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আশা ফিরিয়ে আনছে।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই চিকিৎসা পদ্ধতি শুধু স্ট্রোক বা দুর্ঘটনার কারণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের জন্য নয়, বরং যারা দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক দুর্বলতায় ভুগছেন, তাদের জন্যও কার্যকর। তারা আশা করছেন, ধীরে ধীরে এই সেবা আরও বেশি রোগীর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে এবং দেশের স্বাস্থ্যখাতে রোবোটিক থেরাপির অবদান সুদৃঢ় হবে।

শয্যাশায়ী রিতা রানী আশা দেখছেন দ্রুত হাঁটার

সিলেটের হবিগঞ্জ থেকে এসে রোবটিক সেন্টারে প্রথম সেবা নেওয়া ১৩ জনের একজন রিতা রানী দেব। শয্যাশায়ী হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা এই রোগীর মা কিরণ রানী দেব ঢাকা পোস্টকে বলেন, রিতা পুকুর ঘাটে গোসল করতে গিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হয়েছিল। বাঁশের খুটিতে লাফ দেওয়ার সময় সামনের দাঁত ভেঙে যায় এবং ঘাড়ে আঘাত লাগে। এরপর ওসমানী মেডিকেল কলেজে প্রায় ছয় মাস চিকিৎসা চললেও দেশে আর কার্যকর কোনো সেবা পাওয়া যায়নি। করোনা পরিস্থিতির কারণে বাড়িতেই দীর্ঘ দুই বছর মেয়েটি শয্যাশায়ী অবস্থায় থাকেন।

এরপর ঢাকায় বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর পর দুই মাস চিকিৎসা চললেও রিতা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছিলেন না। অবশেষে রোবোটিক থেরাপি শুরু হলে তার জীবন বদলে যেতে শুরু করে।

কিরণ রানী দেব বলেন, রোবোটিক থেরাপির মাধ্যমে রিতা এখন উঠে বসতে পারছে এবং ধীরে ধীরে ভর দিয়ে হাঁটতে পারছে। বিছানা থেকে উঠতেও পারতো না আগে। আমরা খুব আশা করছি, কয়েকটি থেরাপির পর সে স্বাভাবিকভাবে হাটতে পারবে।

তিনি আরও বলেন, এত বড় উন্নতি আমরা কখনো ভাবিনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে পুরো চিকিৎসা বিনামূল্যে করেছে। আমাদের কাছে এটি শুধুই চিকিৎসা নয়, এক জীবনের আশা।

‘ভিটা-মাটি বিক্রি করলেও এই চিকিৎসাসেবা পাওয়া সম্ভব ছিল না’

রিতা রানী দেবের মতো আরেক সৌভাগ্যবান রোগী সুরমা আক্তার, যিনি দীর্ঘদিন পায়ের সমস্যা ও চলাচলের অক্ষমতার কারণে প্রতিদিনের জীবনযাপনে ভুগছিলেন।

তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, রোবটিক থেরাপি শুরু করার পর মাত্র সাত দিনের মধ্যে তার জীবনে বড় পরিবর্তন এসেছে। আগে পায়ের কারণে সবসময় কাত হয়ে থাকতে হতো, হাঁটতে গেলে ব্যথা ও অক্ষমতার কারণে প্রায় কোনো সান্ত্বনা ছিল না। কিন্তু এখন রোবটের সাহায্যে তিনি সোজা হয়ে বসতে পারছেন এবং লাঠি ব্যবহার করে কিছুটা হাঁটতে সক্ষম হচ্ছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া বিশেষ জুতার সাহায্যে আরও স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটাচলা করতে পারছেন।

তিনি আরও বলেন, এই চিকিৎসা পুরোপুরি বিনামূল্যে পেয়েছি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ফ্রি বেডের ব্যবস্থা করেছেন। শুধু তাই নয়, চীনের প্রযুক্তিগত সহায়তা ও বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্যও আমি কৃতজ্ঞ।

‘চীনের প্রযুক্তিগত সহায়তা ও প্রশিক্ষণ ছাড়া এই সেবা সম্ভব হতো না’

বিএমইউর ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জিয়াউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় আমরা একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছি। বিশেষ করে রিহ্যাবিলিটেশন ও রোবোটিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে এটি যুগান্তকারী। রোগীদের নির্দিষ্ট চাহিদা অনুযায়ী থেরাপি দেওয়া হচ্ছে, যা আগের যেকোনো পদ্ধতির তুলনায় নিখুঁত এবং কার্যকর। প্রচলিত ফিজিওথেরাপি পদ্ধতিতে রোগীরা সাধারণত একই প্রোটোকল অনুসরণ করেন, কিন্তু এখানে প্রতিটি রোগীর শারীরিক সক্ষমতা, দুর্বলতা এবং চলাফেরার সীমাবদ্ধতা অনুযায়ী রোবট নিজেই চিকিৎসার পরিমাণ এবং প্রোটোকল ঠিক করে দেয়।

তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের সেন্টারে ১৩ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। যারা আগে শুয়ে থাকত, তারা ধাপে ধাপে বসতে, দাঁড়াতে এবং কিছুটা হাঁটতেও সক্ষম হয়েছেন। রোগীদের মধ্যে যেমন কিরণ রানী দেবীর মেয়ের মতো শয্যাশায়ী অবস্থার মানুষ ধীরে ধীরে স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে, তেমনই সুরমা আক্তারের মতো রোগীরাও লাঠি নিয়ে হাঁটতে সক্ষম হয়েছে। রোগীদের এই উন্নতি আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় সাফল্য।

ডা. জিয়াউর রহমান বলেন, চীনের প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং প্রশিক্ষণ ছাড়া এই সেবা সম্ভব হতো না। চীনের বিশেষজ্ঞরা আমাদের ডাক্তার, নার্স ও ফিজিওথেরাপিস্টদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং প্রযুক্তি ব্যবহার শিখিয়েছেন। ভবিষ্যতেও তারা নিয়মিত সহায়তা দিয়ে যাবেন, যাতে এই আধুনিক সেবা পুরো দেশের রোগীদের কাছে পৌঁছাতে পারে। এটি শুধুই চিকিৎসা নয়, শিক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ— এখান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল দেশের অন্যান্য হাসপাতালে এই প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেবে।

সাশ্রয়ী খরচে বাংলাদেশে মিলবে রোবোটিক থেরাপি

বিএমইউর ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আব্দুস শাকুর জানিয়েছেন, রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারটি স্থাপন করা হয়েছিল জুলাই মাসের পরে। সেন্টারটি সাধারণ মানুষের জন্য পুরোপুরি চালু করতে বিলম্ব হয়েছে নানা প্রক্রিয়াগত কারণে, বিশেষ করে ডিজিডিএ-এর অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। এই অনুমোদন প্রক্রিয়ায় দেখাতে হয়েছিল প্রযুক্তির কার্যকারিতা এবং জটিলতা। এছাড়া আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার নৈতিকভাবে সঠিক কিনা— তাও বিবেচনার বিষয় ছিল।

ডা. শাকুর বলেন, এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল তৈরি করতেও সময় লেগেছে। এখন পর্যন্ত ২৯ জন রোবটিক রিহ্যাবিলিটেশন থেরাপিস্ট প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, সঙ্গে ১৫–১৬ জন ফিজিয়াট্রিস্ট এবং ১০–১৫ জন ফিজিওথেরাপিস্ট। জনবল উন্নয়নের এই ধাপ শেষ হওয়ার পর ডিজিডিএ-এর কাছে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) তৈরি করে হিউম্যান ইউজের জন্য আবেদন করা হয়েছে। এখন অনুমোদন পাওয়ায় সাধারণ মানুষও সুবিধা পাবে।

চিকিৎসা খরচ নিয়েও আশ্বস্ত করে ডা. শাকুর বলেন, বিদেশে প্রতি থেরাপি সেশনের খরচ প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা, কিন্তু বাংলাদেশে এই উচ্চ মূল্য ধার্য করা হবে না। জুলাই আন্দোলনের যোদ্ধাদের জন্য সেবা বিনামূল্যে থাকবে, দরিদ্রদের জন্যও বিনামূল্যে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে, এবং অন্যান্য রোগীদের জন্য হ্রাসকৃত মূল্যে সেবা দেওয়া হবে। বাইরের দেশের তুলনায় অন্তত ৫০ শতাংশ বা এক তৃতীয়াংশ থেকে দুই তৃতীয়াংশ কম খরচে রোগীরা এই আধুনিক থেরাপি পাবে।

সাশ্রয় হবে বিপুল অর্থ : ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ মনে করেন, রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার চালুর ফলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে এক ধরনের স্ট্রাকচারাল সেভিং তৈরি হবে। তার ভাষায়, এতদিন রিহ্যাবিলিটেশনমুখী অনেক রোগী—বিশেষ করে স্ট্রোক, স্পাইনাল ইনজুরি ও নিউরোমাসকুলার ডিজঅর্ডারের রোগী—বিদেশমুখী হতেন কেবল আধুনিক প্রযুক্তি না থাকা এবং সঠিক থেরাপি না পাওয়ার কারণে। এখন সেই রোগীরাই দেশে থেকে সেবা নিতে পারবেন। এতে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত মোট ব্যয়ের ওপর চাপ কমবে।

ড. হামিদ বলেন, বিদেশে রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন নিতে গেলে একজন রোগীর ৮ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এর মধ্যে চিকিৎসা ছাড়াও ভিসা, যাতায়াত, থাকা–খাওয়া এবং একজন অ্যাটেনডেন্টের ব্যয় যোগ হয়। বাংলাদেশে এই প্রযুক্তি সহজলভ্য হওয়ায় একই রোগীর চিকিৎসা এক–দুই লাখ টাকার মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ গড়ে একজন রোগী কমপক্ষে ৭ থেকে ১৮ লাখ টাকা সাশ্রয় করবেন। তার হিসেবে, প্রতিবছর প্রায় ১৫–১৮ হাজার রোগী রিহ্যাবিলিটেশনমুখী হয়ে বিদেশে যান। তাদের মাত্র এক-তৃতীয়াংশও যদি দেশে চিকিৎসা নেন, তাহলে বছরে ১,৫০০–২,২০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হওয়া বাস্তবসম্মত।

তার মতে, এটি শুধু সরাসরি চিকিৎসা খরচের সাশ্রয় নয়। রোগী দ্রুত হাঁটা-চলা ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারলে পরিবারের উৎপাদনশীলতা বাড়ে, কর্মজীবনে ফেরার সময় কমে, ফলে ইনডাইরেক্ট কস্ট—যা সাধারণত চিকিৎসা খরচের দ্বিগুণ পর্যন্ত হয়—তাও কমে যায়। ড. হামিদের মতে, রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার পুরোপুরি চালু হলে আগামী ৫–৭ বছরে দেশ ৪–৫ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক ব্যয় রোধ করতে পারবে। এটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে এক বড়ো অর্থনৈতিক গেইন হিসেবে কাজ করবে।

পুরোদমে চালু হলে স্বাস্থ্যসেবায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে : উপাচার্য

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম ঢাকা পোস্টকে জানান, রোবোটিক থেরাপি প্রচলিত ফিজিওথেরাপির তুলনায় গুণগত ও পরিমাণগতভাবে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রচলিত পদ্ধতিতে সব রোগীকে সাধারণ প্রোটোকল অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়, কিন্তু এই রোবোটিক মেশিন রোগীর শারীরিক অবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্যায়ন করে। মেশিনটি নির্ধারণ করে কতটুকু চিকিৎসা, কত সময় ধরে এবং কোন পরিমাণে সহায়তা প্রয়োজন। রোগীর উন্নতির হারের ভিত্তিতে পরবর্তী চিকিৎসার প্রোটোকলও স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠিক করে দেয়।

তিনি বলেন, সেরিব্রাল পালসি, গিলিয়েন-ব্যারে সিনড্রোম, ফ্রোজেন শোল্ডার, দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা অথবা শরীরের অস্বাভাবিক শক্ত হয়ে যাওয়া সমস্যার জন্য এই সেন্টারে থাকছে আলাদা সেশন এবং নিরীক্ষিত থেরাপি সিস্টেম। এই সেন্টার প্রতিদিন গড়ে ৩০০ জন রোগীকে সেবা দিতে পারবে।

শাহিনুল আলম বলেন, কেউ যদি ৫০ শতাংশ প্যারালাইসিসে ভুগে বা সম্পূর্ণ হাঁটতে না পারে, মেশিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠিক করে কোন অংশে সম্পূর্ণ সহায়তা, কোন অংশে আংশিক সহায়তা দিতে হবে। একই সঙ্গে এটি প্যাসিভ এবং অ্যাকটিভ মুভমেন্ট পরিচালনা করতে সক্ষম। প্যাসিভ মুভমেন্টের মাধ্যমে রোগী ধীরে ধীরে নিজের পা নাড়াতে সক্ষম হয় এবং প্রয়োজন অনুযায়ী মেশিন পরবর্তী চিকিৎসা প্রটোকলও ঠিক করে। এটি রোগীর ওজন বহন, ব্যায়ামের সময় ও শক্তি প্রয়োগের মাত্রা পর্যন্ত নির্ধারণ করে। এই প্রযুক্তি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে একেবারেই নতুন ও অনন্য।

উপাচার্য আরও বলেন, দেশে রোবোটিক থেরাপির ফলে রোগীদের বিদেশে চিকিৎসার চাহিদা দ্রুতই কমে আসবে। অতীতে জুলাই আহতদের যারা বিদেশে চিকিৎসার জন্য গিয়েছে, তাদের পেছনে সরকারি ব্যয় প্রায় অর্ধ কোটি টাকার কাছাকাছি হয়েছে। বাংলাদেশে এই পরিষেবা পুরোদমে চালু হলে পুরো মাসের চিকিৎসা খরচ ১৫–২৫ হাজার টাকার মধ্যে রাখা হবে। এর বাইরেও দরিদ্র ও বিশেষভাবে জুলাই আন্দোলনের আহতদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।

টিআই/এমজে