প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশীয় প্রযুক্তিতে গ্লোব বায়োটেকের তৈরি বঙ্গভ্যাক্স টিকার অ্যানিমেল (বানরের ওপর) ট্রায়াল শুরু হয়েছে। গত ১ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এ ট্রায়াল চলবে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। এরপর মাসের শেষের দিকে ট্রায়ালের বিস্তারিত প্রতিবেদন বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) কাছে হস্তান্তর করা হবে।

শুক্রবার (৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ঢাকা পোস্টকে এসব বিষয় নিশ্চিত করেছেন গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের কোয়ালিটি অ্যান্ড রেগুলেটরি বিভাগের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন।

তিনি বলেন, গত ১ আগস্ট থেকে বানরের ওপর ট্রায়াল শুরু হয়েছে। আগামী মাসের মাঝামাঝি এ ট্রায়াল শেষ হবে। আগামী মাসের (অক্টোবর) মধ্যেই বিএমআরসিকে রিপোর্ট জমা দিতে পারবো বলে আশা করছি।

ড. মহিউদ্দিন বলেন, আমরা প্রথমে বানরে টিকার ট্রায়ালের জন্য বিদেশে চেষ্টা করেছি। ভারত বলছে জিটুজি পদ্ধতিতে আবেদন করার জন্য, তাই সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি দিয়েছি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। কিন্তু কোনো আশানুরূপ রেজাল্ট পাইনি। তবে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো বলছে, এমআরএনএ টিকার বানরে ওপর পরীক্ষার দরকার নাই। কিন্তু বিএমআরসি বলছে করা লাগবে। তাই বাধ্য হয়ে আন্তর্জাতিক প্রটোকল অনুসরণ করে বন বিভাগের অনুমোদন নিয়ে বানর সংগ্রহ করেছি।

ট্রায়াল প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম বানরের ওপর ট্রায়াল হচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে দেশের বিজ্ঞান গবেষণায় এক নতুন মাইলফলক। প্রাথমিক ফলাফলে ওই টিকাটি বানরে নিরাপদ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে একমাত্র বঙ্গভ্যাক্সই পরিত্রাণ: গ্লোব

বঙ্গভ্যাক্সের কার্যকারিতা প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, প্রাণঘাতী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টসহ করোনার প্রায় প্রতিটি ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেই বঙ্গভ্যাক্স কার্যকরি।

এবিষয়ে ড. মহিউদ্দিন বলেন, বিশ্বে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ডেল্টাসহ ১১টি ভেরিয়েন্ট বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় সক্রিয় ছিল। আমরা এ ১১টি ভেরিয়েন্টের সিকোয়েন্স অ্যানালাইজ করে আমাদের ভ্যাকসিনের সিকোয়েন্স মিলিয়ে দেখেছি প্রতিটি ভেরিয়েন্টের ক্ষেত্রেই বঙ্গভ্যাক্স কার্যকর। আমরা খুবই আত্মবিশ্বাসী যে এ টিকা যদি বাজারে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে সারা বিশ্বে ডেল্টা ধরনসহ করোনার যে মহামারি চলছে সেটা থেকে একমাত্র বঙ্গভ্যাক্সই পরিত্রাণ দিতে পারে।

গ্লোব বায়োটেকের গবেষণা আন্তর্জাতিক মানের উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড ২০১৫ সালে দুরারোগ্য রোগ যেমন ক্যান্সার, অটিজম, রক্তস্বল্পতা, আথ্রাইটিস ও আরও অনেক বিরল রোগ নিরাময়ের জন্য বায়োলজিক্স, নোভেল ড্রাগ এবং বায়োসিমিলার উৎপাদনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অত্যাধুনিক গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেছি। যার নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। ইতোমধ্যে আমাদের গবেষণাগারটি খ্যাতিসম্পন্ন বিদেশি বিজ্ঞানীরা পরিদর্শন করে আন্তর্জাতিক গবেষণাগার হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেছেন।

লিভার গবেষণায় আমাদের একটি আবিষ্কার হিউম্যান জেনোমিক্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রে পেটেন্ট করেছি এবং আরও বেশ কিছু যুগান্তকারী আবিষ্কার পেটেন্টের বিবেচনাধীন রয়েছে। এছাড়াও ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (সিকেডি), ব্লাড ক্যান্সার, আরথ্রাইটিস, অটো ইমিউনো ডিজিজ মোকাবেলায় গ্লোব বায়োটেকের নিজস্ব প্রযুক্তিতে প্রস্তুতকৃত মোট ৬ টি বায়োসিমিলার ড্রাগ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদনের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। গ্লোব বায়োটেকের অত্যাধুনিক গবেষণাগার যেকোনো মহামারীতে দেশের স্বার্থে কাজ করতে সদা প্রস্তুত আছে।

সারা বিশ্বে অধিক কার্যকরী হবে ‘বঙ্গভ্যাক্স’

করোনা মহামারির বিরুদ্ধে সারা বিশ্বেই অধিক কার্যকরী টিকা হবে বঙ্গভ্যাক্স, এমনটি জানিয়ে গ্লোব বায়োটেক জানায়, আমরা আমাদের গবেষণাগারে করোনাভাইরাসের সম্পূর্ণ জিনোম সিকুয়েন্স করেছি। এছাড়াও এনসিবিআই ভাইরাস ডেটাবেজে প্রাপ্ত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোভিড-১৯ এর সব সিকুয়েন্স বায়োইনফরমেটিক্স টুলসের মাধ্যমে বিশদ পর্যালোচনা করে আমাদের টিকার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি এবং ওই টিকা সারা বিশ্বে অধিক কার্যকরী হবে বলে যৌক্তিকভাবে আশা করছি।

আরও জানায়, আমরা আমাদের টিকার টার্গেটের সম্পূর্ণ কোডিং সিকুয়েন্স এনসিবিআই ডেটাবেজে জমা দিয়েছি, যা ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা আমাদের অত্যাধুনিক অ্যানিমেল সেন্টারে টিকার পূর্ণাঙ্গ প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন করেছি, যার ফলাফল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বায়ো-আর্কাইভে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের নিবন্ধটি ইতোমধ্যে ৮ হাজার ৫০০ জন বিজ্ঞানী পর্যালোচনা করে খুবই কার্যকরী ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেট হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেছেন।

শতভাগ হালাল এবং সংরক্ষণ জটিলতা নেই

বঙ্গভ্যাক্স টিকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, আমাদের টিকাটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর ১টি ডোজেই অ্যানিম্যাল ট্রায়ালে কার্যকর এন্টিবডি পাওয়া গেছে। আমরা আশা করছি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেও অনুরূপ ফলাফল পাওয়া যাবে। এটি +৪° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১ মাস এবং -২০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। এটি সিন্থেটিক্যালি তৈরি হওয়ায় তা ভাইরাসমুক্ত এবং শতভাগ হালাল।

‘আমরা যদি দ্রুততম সময়ে টিকাটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ করে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশবাসীর সেবায় বঙ্গভ্যাক্সকে উৎসর্গ করে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্ব-দরবারে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হবে', যোগ করেন তিনি।

ঝুঁকিমুক্ত প্রমাণ হলেই মানবদেহে ট্রায়ালের অনুমতি: বিএমআরসি

বঙ্গভ্যাক্সের অ্যানিমেল ট্রায়াল ও অনুমোদন প্রসঙ্গে বিএমআরসি বলছে, অ্যানিমেল ট্রায়ালে টিকাটি ঝুঁকিমুক্ত প্রমাণ হলেই মানবদেহে ট্রায়ালের অনুমতি দেওয়া হবে।

প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিএমআরসি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। আমরা আবেগ নিয়ে কাজ করতে পারি না। আমরা চাচ্ছি মানবদেহে ট্রায়ালের আগে যেন অন্য কোনো প্রাণীর দেহে ট্রায়াল হয়। সেখানে যদি প্রমাণিত হয় এটা ঝুঁকিমুক্ত, তাহলে আমরা মানবদেহে ট্রায়ালের অনুমতি দিতে এক মুহূর্তও দেরি করবো না।

এর আগে গত বছরের ২ জুলাই ওষুধ প্রস্তুতকারী গ্লোব ফার্মার সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক ‘বঙ্গভ্যাক্স’ টিকা তৈরির কাজ শুরুর কথা জানায়। এরই মধ্যে সেই টিকা খরগোশ ও ইঁদুরের ওপর প্রয়োগ করে ‘কার্যকর ও সম্পূর্ণ নিরাপদ’ প্রমাণিত হয়েছে বলে জানানো হয়।

গত বছরের ১৫ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গ্লোব বায়োটেক কর্তৃক আবিষ্কৃত বঙ্গভ্যাক্স টিকাকে কোভিড-১৯ টিকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এরপর গত ডিসেম্বরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষজ্ঞদল বঙ্গভ্যাক্সের গবেষণাগার পরিদর্শন করে সব তথ্য-উপাত্ত ও প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নথিপত্র পর্যালোচনা করে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অগ্রগতিতে সহযোগিতা করে। পরবর্তী সময়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর ওই গবেষণাগার ও উৎপাদনকেন্দ্র পরিদর্শন সাপেক্ষে গত ২৮ ডিসেম্বর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য ‘বঙ্গভ্যাক্স’ উৎপাদনের অনুমতি দেয়।

এরপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি চেয়ে গত জানুয়ারিতে বিএমআরসিতে আবেদন জমা দেয় গ্লোব বায়োটেক। কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ মাস পর গত ২২ জুন বিএমআরসি একটি চিঠি দিয়ে গ্লোব বায়োটেককে জানায়, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের আগে বানর বা শিম্পাঞ্জির শরীরে প্রয়োগ করে তার এ টিকা পরীক্ষা করতে হবে। তারপরই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নৈতিক অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

টিআই/এসএম