মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বকে কীভাবে বর্ণনা করা যায়? তারা কী পুরোপুরি জনবিচ্ছিন্ন? সত্য হচ্ছে- তাদের জন্য কিছু মানুষের ভালোবাসা আছে।

তবে সারা বিশ্ব যখন মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা এবং এই জনগোষ্ঠীকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করলো, তার এক বছর পর ২০১৮ সালে অং সান সু চি তার মন্ত্রণালয়ে জেনারেলদের থাকার বিষয়টি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা ভালো একটা ব্যাপার।’

এর তিন বছর পর, সামরিক এক অভ্যুত্থানে তাকে যখন আবার খুব দ্রুত গৃহবন্দি করা হলো, তখন মনে হবে, সেনাবাহিনীর পক্ষে তার বক্তব্য দেওয়া, সেটা ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক কিংবা দেশপ্রেম যে কারণেই হোক না কেন, সেই সিদ্ধান্ত খুব খারাপ ছিল। অং সান সু চির সমর্থকরা বলবেন, তিনি হয়তো খুব কঠিন এক অবস্থায় ছিলেন এবং তিনি যদি কঠোর ব্যবস্থা নিতেন তাহলে তাকে আরও আগেই জেলে যেতে হতো।

কিন্তু সু চির সমালোচকরা বলছেন, যে পরিস্থিতিতেই তিনি থাকুন না কেন, নির্যাতিত মুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতি সামান্য পরিমাণে হলেও তিনি সহানুভূতি দেখাতে পারতেন। তবে সব বিবেচনাতেই অং সান সু চি এবং মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন বলেই মনে হয়।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অং সান সু চির যে বলয় রয়েছে সেটা হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু মিয়ানমারের লাখ লাখ মানুষ এখনও তাকে ভালোবাসে। তার এই জনপ্রিয়তা অতিরঞ্জিত কিছু নয়। নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছে।

ইয়াঙ্গুন শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কোন বাড়ির দরজা দিয়ে উঁকি দেওয়া হয়, তাহলে সেখানে হয়তো একটি মুখই দেখা যায়। আর সেটা হচ্ছে অং সান সু চি। এসব বাড়িতে লাগানো পোস্টার, আঁকা ছবি কিংবা ক্যালেন্ডারে ‘মা সু’র ছবি দেখা যাবে।

এখন রাতের বেলায় এই একই রাস্তায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ও বিনাবিচারে আটক তাদের এই নেত্রীর সমর্থনে হাড়ি পাতিল পেটানোর আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়। মা খিন নামে এক ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, ‘সাধারণত অশুভ শক্তিকে তাড়াতে আমরা এধরনের শব্দ করে থাকি। এখন আমরা সামরিক বাহিনীকে তাড়াতে চাই যাতে করে অং সান সু চি মুক্তি পেতে পারেন।’

রাতের বাতাসে এখন এই হাড়ি পাতিলের শব্দের পাশাপাশি কিছু গানও শোনা যায়। এসব গান শোনা যেত ১৯৮৮ সালে সামরিক শাসনবিরোধী উত্তাল আন্দোলনের সময়েও। সেসময় দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অং সান সু চির উত্থান ঘটে।

রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন ওয়ে ওয়ে নু। তিনি রাজপথে এরকম এক বিক্ষোভের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেছেন। তার ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘এরকম দেখতে পাওয়া খুব দুঃখজনক।’

তিনি বলেছেন, অন্য রাজনৈতিক বন্দীদের সঙ্গে তিনি যখন কারাগারে বন্দী ছিলেন তখন তারা এধরনের বিপ্লবী গান গাইতেন।

অং সান সু চির পিতা জেনারেল অং সান। মিয়ানমারে তিনি এখনও একজন শ্রদ্ধেয় নেতা হিসেব বিবেচিত। বার্মাকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করার পথে পরিচালিত করার আগে ১৯৪৭ সালে তাকে হত্যা করা হয়। আধুনিক বর্মী সেনাবাহিনীরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। এই বাহিনী তাতামাডো নামে পরিচিত ছিল। সেই একই বাহিনী এখন তার কন্যাকে স্বাধীনতা থেকে এবং তার দেশকে তাদের নেতা থেকে আবারও বঞ্চিত করেছে।

মিয়ানমারে এর আগে ১৯৮৮ ও ২০০৭ সালে আন্দোলন হয়েছে (জাফরান বিপ্লব) মূলত রাজপথে। আর এবারের আন্দোলন হচ্ছে অনলাইনে। মূলত ফেসবুকে, যা মিয়ানমারের লাখ লাখ মানুষ সংবাদ ও তাদের মতামত আদান-প্রদানে ব্যবহার করে থাকে। তবে এটা নির্ভর করে সেনাবাহিনী এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে রাখার ব্যাপারে কতটা অটল থাকে তার ওপর। সামাজিক মাধ্যমগুলোর শক্তি সম্পর্কে সামরিক বাহিনী জানে। তাদের অনেক শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার ফেসবুকে নিষিদ্ধ কারণ তারা জাতীয়তাবাদী চেতনা উস্কে দিতে ফেসবুকের মাধ্যমে জাতিবিদ্বেষ প্রসূত ঘৃণা ছড়িয়েছেন। তাই সামাজিক এসব মাধ্যমকে তারা এখন ভয়ও পান।

আর কারও পক্ষে বর্মী সেনাবাহিনী তাতমাডোর বর্বরতা ছাড়িয়ে যাওয়া কঠিন। স্বাধীনতা দাবি করায় তারা তাদের নিজেদের লোক, শিক্ষার্থী এবং ভিক্ষুদেরও হত্যা করেছে। অং সান সু চি এবং তার সমর্থকদের জন্য সমস্যা হলো- এই ডিজিটাল শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা।

অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানিয়ে সু চি যে খোলামেলা চিঠি লিখে গেছেন, তাতেও অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। কেউ কেউ ভয় পেয়েছেন, এটা হয়তো প্রতিবাদকারীদের গ্রেপ্তার করার জন্য সামরিক বাহিনীরই পাতা কোনো ফাঁদ।

অং সান সু চির নামে রাজপথে নেমে আসার ঘটনা হয়তো সারা বিশ্বের সোশ্যাল মিডিয়া এবং টেলিভিশন সংবাদের কাছে পরিষ্কার ছবি ও শক্তিশালী বার্তা পাঠাতে পারে। কিন্তু ১৯৮৮ সালের বিভিন্ন চিত্র মনে করিয়ে দেয়- স্বাধীনতাকামী আন্দোলন দমন করতে সেনাবাহিনী সেসময় যে দমন-পীড়ন চালিয়েছিল তাতে এসব রাজপথ রক্তে ভেসে গিয়েছিল। এখন এমন নতুন কিছু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, যার ফলে মিয়ানমারের বড় বড় শহরে তাতমাডো এধরনের হত্যাকাণ্ড চালানো থেকে বিরত থাকতে পারে।

দেশটির সর্বশেষ পরিস্থিতিতে আরেকটি বিষয় আছে যা আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও সত্য-বর্জিত নয়। অং সান সু চির মুক্তি পাওয়ার সুযোগ এবং ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা নির্ভর করছে ‘আন্তর্জাতিক সমাজ’ কী করে, না করে তার ওপর। পশ্চিমা বিশ্বের কাছে সু চি ছিলেন আজীবনের প্রেসিডেন্ট। নির্বাচিত নেতারা যেসব মূল্যবোধের কথা বলে থাকেন। তিনি যেন ছিলেন তাদের কাছে সেরকমই এক আলোক-বর্তিকার মতো।

তবে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করা অথবা তাদেরকে সমর্থন দিতেও অস্বীকৃতি জানানোর কারণে পরে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে তীব্র সমালোচনার শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান তাকে দেওয়া সম্মান, পুরস্কার, উপাধি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরেও সু চি বিচলিত হননি। এই সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যাওয়ার একটি উদাহরণ হিসেবে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সাথে তার সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরা যেতে পারে।

অং সান সু চির ১৫ বছরের গৃহবন্দী থাকার সময়ে বিবিসি ছিল তার বিশ্বস্ত সঙ্গী। তবে ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে বর্বরতার পর সবকিছু বদলে গেছে। অন্য পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর মতো বিবিসি তার সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য অনুরোধ করে বারবার চিঠি পাঠিয়েও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।

অং সান সু চির মতে- যারা তার দেশের জটিল পরিস্থিতি কখনো উপলব্ধি করতে পারবে না, তাদের সঙ্গে কথা বলার কী দরকার! সু চি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মিয়ানমারে জবাবদিহিতাবিহীন সেনাবাহিনী যেসব অপরাধ করছে তিনি সেগুলোর যৌক্তিকতা তুলে ধরবেন।

সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষ বিরাগ থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা গণহত্যার পরও দেশের ভেতরে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের সম্মান রক্ষা করার কারণে তিনি প্রশংসিতও হয়েছেন। কিন্তু এখন অনেকেই বিশ্বাস করেন, সামরিক স্বৈরশাসনের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য যে আন্দোলন শুরু হতে যাচ্ছে তাতে অং সান সু চির প্রতীক হয়ে ওঠার কোনো কারণ নেই।

ইয়াঙ্গুনভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক রিচার্ড হর্সি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষ যেভাবে সাড়া দিচ্ছে, সেটাকে কেবল সু চির জন্য- এরকম সরুভাবে দেখা উচিত নয়। এটা হচ্ছে নির্বাচিত ও একইসঙ্গে জনপ্রিয় একটি সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরোধিতা এবং মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ, তাদের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি সমর্থন।’

অন্যরা আরো স্পষ্টবাদী। জাতিসংঘের যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন বিল রিচার্ডসন। অং সান সু চির একজন বন্ধুও ছিলেন তিনি। কিন্তু তাদের সেই সম্পর্ক পরে টিকে থাকেনি। তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে কিছু করার জন্য তিনি অং সান সু চিকে ব্যর্থ অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি সু চির অনেক বড় ভক্ত ছিলাম।’

রিচার্ডসন বিশ্বাস করেন, ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির এখন নতুন নেতৃত্ব তৈরি করা উচিত।

অং সান সু চির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তাতে তার কারাদণ্ড হতে পারে। এর ফলে তিনি হয়তো নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না। সামরিক কর্মকর্তারার বলছেন, জরুরি অবস্থা শেষ হওয়ার পর দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে তারা নির্বাচনী ব্যবস্থায় একটা ক্ষতিসাধন করতে চায়। কিন্তু অং সান সু চি যদি মাসের পর মাস কিংবা বছরের পর বছর কারাবন্দী থাকেন তাহলে কী হবে?

তার ২০ বছরের সাবেক বন্ধু রিচার্ডসন বলছেন, ‘আমার মনে হয় তিনি অনুধাবন করতে পারবেন যে সামরিক বাহিনী, যাদেরকে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন, তারা তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তার অবস্থা খুব অন্ধকারাচ্ছন্ন। তবে আমি আশা করি তারা তার ক্ষতি করবে না অথবা তাকে চিরকালের জন্য চুপ করিয়ে দেবে না।’

আর অং সান সু চিকে যদি আবার কথা বলার অনুমতি দেওয়া হয় তখন? তিনি বলেন, ‘তিনি যদি আবার কথা বলতে পারেন এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যেসব অপরাধ করা হয়েছে সেগুলো স্বীকার করে নেন, তাহলে আন্তর্জাতিক সমাজ তাকে বিশ্বাসযোগ্য ও সৎ বলে মনে করবে। এখনও খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি। তখনই বিশ্ব সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াবে।’

তার মতে, ‘এটা ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তবে আগেও তিনি ঝুঁকি নিয়েছেন।’

টিএম