ইরবিলে হামলা: রুশ আগ্রাসনে উদ্বুদ্ধ ইরান?
এক ডজন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইরাকের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল কুর্দিস্তানের ইরবিলে ইরানের হামলা ওই অঞ্চলের উত্তেজনা ব্যাপক বৃদ্ধি করেছে। ইরানের ছোড়া সব ক্ষেপণাস্ত্র ইরবিলের প্রধান প্রধান কয়েকটি এলাকাকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। এর মধ্যে নবনির্মিত মার্কিন কনস্যুলেট ভবনও রয়েছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বার্তা দিয়েছে ইরান। আর সেটি হল ইরান চাইলে আরও প্রচুর ক্ষতি করতে পারে। বিমানবন্দরের রানওয়ে অথবা বেসামরিক এলাকাও লক্ষ্যবস্তু করতে পারে। শুধু ধ্বংসযজ্ঞের বাইরেও ইরান যে কিছু করতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সেই সম্ভাবনাও দেখিয়ে দিয়েছে।
ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার আলোচনা নিয়ে টানাপোড়েনের সঙ্গেও এটির সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আমেরিকার কাছ থেকে আরও ছাড় পেতে ইরানের আলোচনাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে মস্কো। এটিও ইরানকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। কারণ ইরান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চায় এবং শেষ মুহূর্তে রাশিয়ার কৌশলে নিজেকে খুঁজে নিয়েছে তেহরান।
বিজ্ঞাপন
ইরান পশ্চিমাদের সাথে কীভাবে আলোচনায় জড়াবে সে বিষয়ে শিক্ষা নেওয়ার জন্য রাশিয়ার দিকেও তাকিয়ে আছে। রাশিয়া আগ্রাসনকে ব্যবহার করেছে এই সত্যটি দেখানোর জন্য যে, হামলা এবং উত্তেজনা বৃদ্ধির পরও আন্তর্জাতিক দায়মুক্তির সুযোগ রয়েছে তাদের।
ইরবিলে এবারই প্রথম ইরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের বহর নিক্ষেপ করেনি। এর আগে ২০১৮ সালে ইরাকের উত্তরাঞ্চলের কুর্দিস্তানের কোয়া এলাকায় ভিন্নমতাবলম্বীদের লক্ষ্য করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল ইরান। এছাড়া ২০২০ সালে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর অভিজাত শাখা কুদস ফোর্সের মেজর জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় আল-আসাদ ঘাঁটিতে মার্কিন স্থাপনায় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছিল তেহরান। অর্থাৎ এই ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার নতুন অথবা নজিরবিহীন নয়।
বিজ্ঞাপন
এমনকি সৌদি আরবকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করেছে ইরান। সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ব্যবহারের লক্ষ্যে ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের কাছেও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিও সরবরাহ করেছে দেশটি।
ইরবিলে হামলার তাৎপর্য কী?
ইরবিলে হামলায় বিপুল সংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার সম্ভবত বড় ধরনের আক্রমণের প্রস্তুতি। ইরান এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাধ্যমে তার নিখুঁত নিশানা এবং শক্তি প্রদর্শন করতে চায়। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র জবাব দেবে কি না, সেটিও দেখতে চায় ইরান।
ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনায় না জড়ানোর পক্ষে মার্কিন প্রশাসনে ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। বাইডেন প্রশাসন প্রকাশ্যে বলেছে, তারা রাশিয়া অথবা ইরানের সাথে যুদ্ধ চায় না। রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থানের সুযোগ গ্রহণ করেছে এবং ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার পরও আন্তর্জাতিক দায়মুক্তি চায় দেশটি।
রাশিয়া পশ্চিমাদের যুদ্ধের ভয় দেখাচ্ছে; বিশেষ করে মার্কিন প্রশাসনের পূর্বানুমান ‘রাশিয়ার সাথে যেকোনো সংঘর্ষ মানেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।’ যদিও পশ্চিমের সাথে এত বড় আকারের সংঘর্ষের ব্যয় রাশিয়া চালিয়ে যেতে পারবে, তেমন কোনো প্রমাণ নেই। যে কারণে এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, রাশিয়া বর্তমানে যুদ্ধের জুজু বিক্রি করে পশ্চিমকে নিবৃত্ত রাখছে, যেমন ইরান ২০১৫ সালে ‘পারমাণবিক চুক্তি অথবা যুদ্ধ’র জুজু দেখিয়েছিল।
ইরবিলে হামলার মাধ্যমে রুশ আখ্যানের চালক হিসাবে জায়গা করে নিতে চাচ্ছে ইরান। তারাও হয়তো বলতে চায়, যদি যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশোধ নেওয়ার মাধ্যমে উত্তেজনা বৃদ্ধি করে, তাহলে সেখানে যুদ্ধ হতে পারে।
অতীতে ইরাক ও সিরিয়ায় ইরানপন্থি মিলিশিয়ারা মার্কিন অথবা জোটের কোনো সদস্যকে হত্যা করলে যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা জবাব দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় প্রতিশোধ নিতে পারে, ইরান সেটি জানে। যেখানে সবকিছু করা যায়, সেই সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র কোনো ধরনের দায় ছাড়াই কাজ করতে পারে। কিন্তু ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি ইরান থেকে আসলেও তেহরানকে লক্ষ্যবস্তু করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক।
ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী এবং ইরাক-ভিত্তিক মিলিশিয়ারা ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। গত মার্চে ইরান থেকে ইসরায়েলি ভূখণ্ডেও ড্রোন হামলা চালানো হয়েছিল।
ছায়া থেকে বেরিয়ে আসছে ইরান?
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবসহ ওই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ লক্ষ্য করে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল ইরান। সেই সময় ইরানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জেরুজালেম পোস্টের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ইরান হয়তো ধারণা করছে, ইরাকের উত্তরাঞ্চলের ইরবিল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। পাশাপাশি রাশিয়া এবং ইউক্রেনে যা ঘটছে, তা খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছে দেশটি।
ইউক্রেনে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে কঠোর পরিণতির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করে দিয়েছে। এছাড়া রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি কোনো সংঘর্ষ চায় না বলেও বার্তা দিয়েছে হোয়াইট হাউস। এদিকে, রাশিয়া বলেছে, তারা ইউক্রেনে পশ্চিমাদের অস্ত্র সরবরাহকে লক্ষ্যবস্তু বানাবে।
একই সময়ে ইরান দেখছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার আলোচনা শুরু করেছে। সেই সুযোগে শর্ত মানতে ওয়াশিংটনকে চাপপ্রয়োগ করতে চায় তেহরান। ইউক্রেন সঙ্কটকে ব্যবহার করে ইরান চুক্তির বিষয়ে পশ্চিমাদের প্রতি রাশিয়ার চাপপ্রয়োগের কৌশলকেও কাজে লাগাতে চায়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার চেষ্টা করার জন্য আরও মারাত্মক হামলার হুমকি ব্যবহার করছে দেশটি। ইরবিলের হামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশোধ নেয় কি না অথবা চুপ থাকে কি না, সেটিও পরীক্ষা করে দেখতে চাইতে পারে ইরান।
যুক্তরাষ্ট্রে যারা ইউক্রেনে উত্তেজনার বিরোধিতা করে ‘ন্যাটো রাশিয়াকে উসকানি দিয়েছে’ অথবা ‘ইউক্রেন সংকটের জন্য পশ্চিম দায়ী’ বলে মতপ্রকাশ করছেন তাদের দিকেও খেয়াল রাখছে ইরান। ইরানের সাথে সরাসরি কোনো সংঘাত হলে যুক্তরাষ্ট্রে একই ধরনের জনমত দেখা যাবে কি না সেটিও পর্যবেক্ষণ করছে দেশটি।
আর এটাকে পুঁজি করছে পশ্চিমা গণমাধ্যম। যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাবিদ জন মিয়ার্শেইমার নিউ ইয়র্কারে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। সেই নিবন্ধের শিরোনামে ইউক্রেন সংকটের জন্য ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমকে দায়ী’ করেছেন তিনি। দ্য ইকোনমিস্টে লেখা এক নিবন্ধেও যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমের তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি। ইকোনমিস্টের শিরোনামে তিনি লিখেছেন, ‘জন মিয়ার্শেইমার কেন ইউক্রেন সংকটের জন্য প্রধানত পশ্চিমকে দায়ী করছেন।’
২০০৮ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রকল্যাণ দফতর এবং টেলিভিশন চ্যানেল পিবিএসে ওই শিক্ষাবিদের আরেকটি তত্ত্ব তুলে ধরা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জন মিয়ার্শেইমার বলেন, ‘পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত ইরান ওই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনবে।’ কিন্তু পেন্টাগনের সাবেক কর্মকর্তা ডভ জাখেইম বলেছেন, ‘ইরান ওই অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করবে।’
২০০৭ সালে জন মিয়ার্শেইমার এবং আরেক অধ্যাপক স্টিফেন ওয়াল্ট ‘ইসরায়েলি লবি এবং মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির’ তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।
এসব ঘটনা কীভাবে একটির সাথে আরেকটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত?
ন্যাটো ২০০০ দশকের গোড়ার দিকে জোটের সম্প্রসারণের দিকে নজর দেয়। সম্প্রতি ইউক্রেনকে এই জোটের সদস্য করা নিয়ে পশ্চিমাদের তোড়জোর শুরু হয়। যে কারণে ক্ষুব্ধ রাশিয়া ইউক্রেনকে থামাতে হামলার পথ বেছে নেয়। পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণকে নিজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসাবে দেখছে মস্কো।
ইরানের সাথে সংঘর্ষ হলে তার বলি হতে পারে ইসরায়েল। এখন ইসরায়েল যদি আগ বাড়িয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়, সেটি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে।
ইরান মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা আনতে পারে বলে যে যুক্তি দেখানো হয়েছিল, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সেটি ‘ইউক্রেন হামলায় রাশিয়াকে উস্কে দেওয়া হয়েছে’ ধারণার সাথে যুক্ত। ইউক্রেনে রাশিয়া যা করছে, ইরানও ইরাকে তেমন কিছু করতে চায়; যা ইরবিল হামলায় পরিষ্কার হয়েছে।
এসএস