স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানে কোনো প্রধানমন্ত্রীই পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারনেনি। তবে দেশটির ২২তম প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রথম প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে যার পতন হলো। 

৯ এপ্রিল রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে পদত্যাগ করেন জাতীয় সংসদের প্রথম স্পিকার আসাদ কায়সার। আর তার কিছু সময় পরই প্রধানমন্ত্রী পদ হারান ইমরান খান। 

ইমরান খান ক্ষমতায় এসেছিলেন ২০১৮ সালের জুলাইয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে। দেশটির সেনাবাহিনীর ভূমিকা তার বিজয়ের পথ তৈরি করে দিয়েছে- এমন কথা তখন প্রচলিত ছিল। তবে এর সাড়ে তিন বছরের মাথায় ইমরান খানকে এ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে সেটা কেউ ভাবেননি, ইমরানের শপথের দিনে। 

আবার পাকিস্তানের বিপুল সংখ্যক মানুষের আশা ছিল যে, ক্ষমতায় আসার আগে যেসব প্রতিশ্রুতি ইমরান খান দিয়েছিলেন সেগুলো তিনি পূরণ করবেন। পাকিস্তান থেকে দুর্নীতি দূর হবে, জবাবদিহিতা আসবে, বিদেশে পাচার হওয়া দুর্নীতির অর্থ ফেরত আসবে, বৈদেশিক ঋণ কমবে, প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার হবে, ১ কোটি মানুষ চাকরি পাবে, পাঁচ লাখ মানুষ বাড়ি পাবেসহ সব মিলিয়ে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে- ইমরান খানকে নিয়ে এমন স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেকে। 

এসবের অনেক কিছুই হয়নি। ইমরান খান নিজে এবং তার মন্ত্রীরাও অনেকবার স্বীকার করেছেন যে, সব প্রতিশ্রুতি পূরণ করা যায়নি। ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া ইমরান খানের মেয়াদ কেমন ছিল এবং তাকে কেন মনে রাখবে মানুষ?
 
যেসব ক্ষেত্রে ব্যর্থতা রয়েছে ইমরান খান সরকারের 
জবাবদিহিতা
২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রচারণায় নেমে ইমরান খানের দিক থেকে যত প্রতিশ্রুতি এসেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল দেশে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা। ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদে প্রথম ভাষণেও ইমরান খান ঘোষণা করেন, যারা দেশের সম্পদ লুট করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। তবে এই বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ ছিল না এবং বিষয়টিকে রাজনৈতিক হিসেবে মনে করা হয়। মামলা ও গ্রেপ্তার শুরু হওয়ার পর বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে পাল্টা অভিযোগ তোলা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মামলাগুলো যৌক্তিন কোনো সমাপ্তি হয়নি। 

এ বিষয়ে নিজের ব্যর্থতার কথা স্বীকারও করেছেন ইমরান খান। ২ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে নিজেদের এ ব্যর্থতার কথা বলেন ইমরান খান। তার আগে ১ এপ্রিলও প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দেন ইমরান খান। মামলাগুলো কেন শেষ করা যায়নি তার একটা জবাব দেওয়ারও চেষ্টা করেন ইমরান। 

সংসদে আরও সংখ্যাগরিষ্ঠতা চেয়ে তিনি বলেন, এখন আমি জনগণকে বলব, আমাকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিতে, কারণ  দুর্বল থাকলে আমাকে আপস করতে হবে। 

একইদিনে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন বিরোধী দলনেতা শাহবাজ শরিফও। এ ধরনের মামলাগুলোর বিষয়ে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন তিনি। যার মধ্যে ছিল   

বিরোধীদলীয় নেতা আরও অভিযোগ করেন, এই সরকারের আমলে কয়েক বিলিয়ন টাকার চিনি, গম, ওষুধ, গ্যাস কেলেঙ্কারি রয়েছে, সেগুলো কোথায় গেল। 

পাকিস্তানের সাংবাদিক আরিফা নূর এ বিষয়ে বলছেন,জাস্টিস মুভমেন্ট শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যারা অতীতে জবাবদিহিতার প্রক্রিয়াকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা জানেন যে এটাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া যে দেশে দুর্নীতি হ্রাস পায়নি। 

মোশাররফ জাইদি নামে আরেক বিশ্লেষক বলছেন, চিনি বা গম কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এ সরকারের আমলে। 

অর্থনীতি
ইমরান খানের সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অর্থনৈতিক সংকট এবং তিনি দাবি করেছিলেন যে তিনি দেশের অর্থনীতিকে বদলে দেবেন। আইএমএফের কাছে যাবেন না, ঋণ হ্রাস করবেন, মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনবেন। 

সেখানে তার আমলেই মুদ্রাস্ফীতি থেকে শুরু করে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, রেকর্ড পতনে পাকিস্তানি মূদ্রার মূল্য ধাক্কা খায়, যার মধ্যে অর্থমন্ত্রীও তিনবার পরিবর্তন করেন।

প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মতে, অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলেও তখন করোনা মহামারি দেখা দেয় এবং বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়।

গত ১ এপ্রিল একটি বেসরকারি টিভি সাক্ষাৎকারে সরকারের অর্থনৈতিক নীতির পক্ষে সাফাই দিয়ে উল্টো প্রশ্ন রাখেন- মুদ্রাস্ফীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, শাহবাজ শরিফ এলে কী করবেন? আমরা পুরো অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে সস্তায় পেট্রোল বিক্রি করছি, আমরা রেকর্ড ট্যাক্স সংগ্রহ করেছি। আমাদের সময়ে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে ও রেমিট্যান্স এসেছে। 

অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে যে, ইমরানের আমলে রেকর্ড কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানের পরিসংখ্যান ব্যুরোর লেবার ফোর্স সার্ভের দাবি, গত তিন বছরে ৫৫ লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে অর্থাৎ প্রতি বছর ১৮ লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে।

কিন্তু পাকিস্তানের সাবেক অর্থমন্ত্রী ড. হাফিজ পাশা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, যখন সরকারের সমাপ্তি ঘনিয়ে আসে, তখন এ ধরনের দাবি রাজনৈতিকভাবে লাভজনক হতে পারে, কিন্তু এই মুহূর্তে এর সঙ্গে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই।

তিনি বলেন, সরকার যেহেতু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারকে অতিরঞ্জিত করছে এবং মুদ্রাস্ফীতিকে নিম্নস্তরে দেখাচ্ছে, তাহলে সরকার আরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে তার নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করবে। 

আরেক অর্থনীতিবিদ ড. কায়সার অর্থনৈতিক সূচকের উন্নতি হয়েছে বলে সরকারের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন।

তিনি বলেন, তেহরিক-ই-ইনসাফ সরকারের অর্থনৈতিক নীতি সার্বিক প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও অদক্ষতার শিকার। মৌলিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো  ৪০ বছর ধরে যেভাবে চলছে, সেগুলোর কোনো উন্নতি হয়নি। 

প্রশাসনিক ব্যর্থতার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, যখন চাহিদা বাড়ল, তখন বলা হলো যে, বাইরে থেকে যে কার্গো আসার কথা ছিল তা আসছে না। এটা সংকট আরও বাড়িয়ে তোলে। এমন নয় যে, আগের কোনো সরকারে পরিস্থিতি খুব ভালো ছিল। কিন্তু এই সরকারের সময় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।  

ঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগের যেকোনো সরকারের চেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে এই সরকার। এখানেও তাদের কিছু করার ছিল না, কারণ ইতোমধ্যে নেওয়া ঋণ পরিশোধের জন্য আরও অর্থের প্রয়োজন এবং নতুন সরকারকে তাদের চেয়ে আরও বেশি ঋণ নিতে হবে।  

রাজনৈতিক বিষয়
মিত্রদের সরকারে রাখতে ব্যর্থতা, পাঞ্জাবে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে উসমান বাজদারের নির্বাচন, জাহাঙ্গির তারিন ও আলিম খানের ক্ষোভ, মন্ত্রিসভা ও ফেডারেল মন্ত্রীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য, বিরোধী দলের সঙ্গে সংঘাতের ফলে আইন প্রণয়নে অসুবিধাসহ কয়েকটি রাজনৈতিক ইস্যু ছিল, যা প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সরকারের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে।

এছাড়া বিরোধীদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করাটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল। উসমান বাজদারকে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগকেও ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলে মনে করেন অনেকে। 

সাংবাদিক ফাহাদ হোসেনের মতে, ইমরান খানের মন্ত্রিসভা সম্ভবত এ যাবৎকালের সবচেয়ে দুর্বল মন্ত্রিসভা ছিল, যেখানে ড. ফয়সাল সুলতান ও সানিয়া নিশতারের মতো কয়েকজন মন্ত্রী ছাড়া অধিকাংশ মন্ত্রীই তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।

ইমরান খানের দলের সদস্য সাবেক সহকারী বিশেষ সহকারী ড. জাফর মির্জা বলেন, আপনি যখন রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী নন, তখন আপনাকে আপস করতে হবে। 

পররাষ্ট্রনীতি
ক্ষমতায় এসে ইমরান খান ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশের সাথে আরও ভালো সম্পর্ক গড়তে চান। কিন্তু শেষের দিকে এসে, তার কণ্ঠে তার সরকারকে উৎখাতে মার্কিন ষড়যন্ত্রের অভিযোগের প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়।

তেহরিক-ই-ইনসাফ সরকারের শুরুতে ইমরান খান পররাষ্ট্রনীতিতে ভালো করছিলেন। ২০১৯ সালের শুরুতে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথিরের পাকিস্তান সফর, কাশ্মির ইস্যুতে মার্কিন মধ্যস্থতার প্রস্তাব, আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের চেষ্টার সময়ও পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

কিন্তু অন্যদিকে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সফল হতে পারেননি ইমরান খান। দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন নিয়ে ইমরানে খানের যেমন ভাবনা ছিল কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপের পর তা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনাকর বেশ কিছু পরিস্থিতি তৈরি হয়।  

চীন, সৌদি আরব এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের অবনতির জন্যও সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে বিরোধীরা। 

বিশ্লেষক মোশাররফ জাইদি বলেন, ইমরান খানের পররাষ্ট্রনীতি আলাদা কিছু ছিল না। পাকিস্তানের স্বার্থে সর্বোত্তম সম্পর্ক এবং ভারসাম্য বজায় রাখা, অর্থাৎ, চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরও ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা এবং রাশিয়ার সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নত করা। 

তিনি আরও বলেন, তারপরও মন্ত্রীদের বক্তব্য এ সম্পর্ক আরও খারাপ করে। চীন ও সি-প্যাক নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা রাজ্জাক দাউদের বিতর্কিত বক্তব্য সৌদি আরব সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশির বক্তব্য, সরকারের মন্ত্রীরা এমন সব বিবৃতি দিয়েছেন, যা সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে। 

মিডিয়া এবং সীমাবদ্ধতা
পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ সরকারের সময়কাল গণমাধ্যমের দিক থেকে বিতর্কিত ছিল। কখনও সোশ্যাল মিডিয়ায় অবাঞ্ছিত সাংবাদিকদের তালিকা, আবার কখনও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অনলাইনে ট্রোলিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। এমন আইন প্রবর্তনের চেষ্টাও করা হয়েছে যার জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোকে প্রতিবাদ করতে হয়েছিল। এসবের যার মধ্যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

করাচির সেন্টার ফর এক্সিলেন্স ইন জার্নালিজমের পরিচালক সাংবাদিক অ্যাম্বার শামসি বলেন, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের সময় গণমাধ্যমে যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, তা পারভেজ মুশাররফ যুগসহ আগের যে কোনো সরকারের চেয়ে বেশি ছিল এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও বলেছে, পাকিস্তানে গণমাধ্যমের কমেছে।

আম্বার শামসি বলেন, বেশ কয়েকটি কারণে আসিফ জারদারি, মরিয়ম নওয়াজের মতো বেশ ক’জন বিরোধী নেতার সাক্ষাৎকার নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ সরাসরি নিষিদ্ধ করেছিল। যদিও সংবিধান বা আইনে বলা নেই যে, কোনো দণ্ডিত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেওয়া যাবে না। 

তিনি বলেন,  এটাও লক্ষ্য করা গেছে যে, সরকারের সমালোচনাকারী কিছু সাংবাদিককে ধীরে ধীরে মিডিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে হামিদ মীর, তালাতের মতো বড় নামও রয়েছে।  আমি নিজেই এর শিকার হয়েছিলাম।

আম্বর শামসি বলেন, মতিউল্লাহ জান, আবসার আলম, আসাদ আলী তুরের মতো সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি। এসব ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ থাকলেও এখনও কারো বিচার হয়নি। 

সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টাও করা হয়েছে। তবে সে চেষ্টায় সফল হয়নি ইমরান সরকার।  

আম্বর শামসি আরও বলেন, যদিও প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বহুবার বলেছেন যে, পাকিস্তানের গণমাধ্যম যুক্তরাজ্যের চেয়ে বেশি স্বাধীন, কিন্তু বাস্তবে এমন কিছু পাওয়া যায়নি।  

অর্জন
করোনা মহামারি, সরকারি কৌশল এবং অর্থনীতিতে প্রভাব
করোনা মহামারি মোকাবিলার সর্বোত্তম উপায় কী হতে পারে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। শুরুতে পাকিস্তান লকডাউনের পথ বেছে নিলেও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে দীর্ঘ লকডাউনের পরিবর্তে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে ধীরে ধীরে বিভিন্ন খাত খোলার কৌশল নেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।

স্মার্ট লকডাউনের কৌশলটি কতটা কার্যকর ছিল এবং পাকিস্তানে তুলনামূলকভাবে কম সংখ্যক করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণ কী ছিল? এই প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর কেবল গবেষণার পরেই পাওয়া যেতে পারে, তবে পাকিস্তানের সঙ্কুচিত অর্থনীতির সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলি কেবল এড়ানোই যায়নি বরং এই নীতির দ্বারা উপকৃত হয়েছে।

একদিকে যখন ভারত ও বাংলাদেশে লকডাউনের ফলে রফতানির সাপ্লাই চেইনে বিঘ্ন ঘটে, তখন বিদেশে থাকা ক্রেতারা পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়েন।

সাংবাদিক তানভীর মালিকের মতে, উচ্চ রপ্তানি আদেশের কারণে ২০০০ সালে  পাকিস্তানের টেক্সটাইল রপ্তানি ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এতে দেশের মোট রপ্তানি বৃদ্ধি পায় এবং অন্যদিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করে।

ভারতের তুলনায় পাকিস্তানে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যাও কম ছিল। ওয়ার্ল্ডোমিটার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানে যেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ লাখের কিছু বেশি এবং মৃত্যু ৩০ হাজারের কিছু বেশি, সেখানে ভারতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪ কোটি ছাড়িয়েছে আর মৃত্যু হয়েছে ৫ লাখ ২১ হাজারের বেশি মানুষের। 

তেহরিক-ই-ইনসাফ সরকারের অংশ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা স্বাস্থ্য বিষয়ক সাবেক সহকারী ড. জাফর মির্জা বলেন, করোনা মোকাবিলায় সরকার সফল হয়েছে।  সে কারণে পাকিস্তানে মহামারি ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিপজ্জনক হয়নি। 

জাফর মির্জার মতে, ডব্লিউএইচও বলেছে যে সাতটি দেশ মহামারি প্রতিরোধে  দুর্দান্ত কাজ করেছে, তার মধ্যে পাকিস্তান দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে লকডাউন আমাদের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। এমন একটি ব্যবস্থা করা উচিত যাতে দরিদ্ররা কাচ করতে পারে। 

ড. জাফর মির্জার আরও বলেন, পাকিস্তানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী না হওয়ার পরও ভালোভাবে করোনা মোকাবিলা করা গেছে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতের জন্য এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশকে প্রস্তুত থাকতে হলে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিনিয়োগ করতে হবে। 

স্বাস্থ্য কার্ড
তেহরিক-ই-ইনসাফ ২০১৬ সালে খাইবার পাখতুনখোয়াতে স্বাস্থ্য কার্ড চালু করেছিল। আর্থিক পরিস্থিতির কারণে হাসপাতালে যেতে অক্ষম নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সুবিধা দিতে এ কার্ড চালু করা হয়। 

ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই প্রকল্প আরও সম্প্রসারিত হয় এবং ইমরান খান ৮ কোটি নাগরিকের জন্য এই কার্ড প্রদানের ঘোষণা দেন।

পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ সরকারের মতে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণ নিচের সুবিধাগুলো পাবেন- 

• কার্ডধারীদের বছরে ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা সুবিধা পাবেন। 
• দেড় কোটি পরিবারকে অর্থাৎ ৮ কোটি নাগরিককে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া হবে।
• অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি, ব্রেন সার্জারি এবং ক্যান্সারসহ অন্যান্য রোগের জন্য বিনামূল্যে চিকিত্সা।

প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সহকারী বিশেষ সহকারী ড. জাফর মির্জা বিবিসিকে বলেন, স্বাস্থ্য কার্ড একটি বড় কর্মসূচি, যাদের আর্থিক সুরক্ষা প্রয়োজন সেই সব দরিদ্র মানুষের জন্য।

তবে ড. জাফর মির্জার মতে, ব্যাপক হারে এই স্বাস্থ্য কার্ড চালু করার সিদ্ধান্ত নিলে তারও সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক ফল হবে।

হাউজিং
ইমরান খান ক্ষমতায় আসার আগে নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীর জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

এই প্রকল্পের জন্য একটি পৃথক ‘নিউ পাকিস্তান হাউজিং অথরিটি’ গঠন করা হয়েছিল এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সাতটি শহরে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছিল।

সরকার ব্যাংকগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের জন্য উত্সাহিত করে, যার মধ্যে বিভিন্ন সময়ের জন্য ২০ লাখ থেকে ১ কোটি পর্যন্ত ঋণ প্রদান অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

একই সঙ্গে সরকার নির্মাণ খাতের উন্নয়নে এবং দেশে বাড়ি নির্মাণের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য নির্মাণ খাতের জন্য দুটি আলাদা স্কিম চালু করে।

সাবেক চেয়ারম্যান আবাদ আরিফ জিওয়া বলেন, পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্মাণ খাতের জন্য একটি প্যাকেজ দেওয়া হয়, যা নির্মাণখাতকে ব্যাপকভাবে উপকৃত করেছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের ইতিহাসে গত দুই বছরে বিশেষ করে ইসলামবাদ ও লাহোরে যত প্রকল্প শুরু হয়েছে তা অভূতপূর্ব। 

তিনি আরও বলেন, কিন্তু সাধারণ মানুষকে যেভাবে অর্থ সাহায্য করা প্রয়োজন ছিল, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে ব্যাংকগুলো যেভাবে সহায়তা দিতে পারেনি। 

আরিফ জিভার মতে, করোনার ঢেউয়ের পর ইস্পাত ও সিমেন্টসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে এবং নির্মাণ ব্যয় ৭০ থেকে বেড়ে ৮০ শতাংশ বাড়ে, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমে যায়। তার মতে, প্রবাসী পাকিস্তানিরা নির্মাণ খাতে বড় বিনিয়োগ করেছিলেন।   

একশ কোটি গাছের চারা রোপন প্রকল্প
২০১৪ সালে খাইবার পাখতুনখোয়া সরকার একশ কোটি গাছের চারা রোপনের প্রকল্প হাতে নেয়। ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর ইমরান খান প্রকল্পটিকে এক হাজার কোটিতে উন্নীত করেন, যা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল।

জাতিসংঘ এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো পাকিস্তানের এই পরিকল্পনার প্রশংসা করে এবং দক্ষিণ আফ্রিকা, বাংলাদেশ এবং সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে পরবর্তীতে একই ধরনের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। 

পরিবেশবিদ ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী রাফি-উল-হক বলেন, এই প্রকল্টপি দেশীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে এতটাই গুরুত্ব অর্জন করেছে যে, পরবর্তীতে এই ইমরান খানের সরকার ক্ষমতায় না এলেও প্রকল্পটি শেষ করার জন্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটি শেষ করার জন্য যে সরকারই থাকুক না কেন তার ওপর বিশ্বব্যাপী একটা চাপ থাকবে। 

আশ্রয়ন প্রকল্প
দারিদ্র্য বিমোচনের পদক্ষেপের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আবাস কর্মসূচির আওতায় ৩১ দফা এজেন্ডার মাধ্যমে ১১৫টি নীতি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন।

এই প্রকল্পের আওতায় আশ্রয় কেন্দ্রে থাকার পাশাপাশি বিনামূল্যে তিন বেলা খাবারও দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুরাদ সাঈদ বলেন, আমাদের সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন আমাদের প্রচেষ্টা ছিল পাকিস্তানকে মদিনা রাষ্ট্রের আদলে গড়ে তোলা এবং এ ব্যাপারে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে পাকিস্তানের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে ‘আশ্রয়ন’ কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাথায় ছাদ দেওয়া, যেন খোলা আকাশের নিচে কাউকে ঘুমাতে না হয়। 

এছাড়াও, নারীদের জন্য নেওয়া কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ব্যাংক অ্যাকাউনেন্টর মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতা, রেশন কার্ড চালু ইত্যাদি। 

এনএফ