পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বলেছেন, প্রতিবেশি ভারতের সঙ্গে কাশ্মির বিবাদের ‘শান্তিপূর্ণ’ নিষ্পত্তি ‘অপরিহার্য’। নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অভিনন্দনের জবাবে মঙ্গলবার দেওয়া এক বিবৃতিতে শেহবাজ শরিফ কাশ্মির সংকটের সমাধানের দাবি তোলেন।

শেহবাজ শরিফ বলেন, ভারতের সাথে ‘শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক চায়’ ইসলামাবাদ। তিনি নির্বাচিত হওয়ায় পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই প্রতিবেশির কূটনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে নতুন সুযোগের সম্ভাবনা দেখছেন পাক এই প্রধানমন্ত্রী।

সংসদে অনাস্থা ভোটে ইমরান হেরে যাওয়ার পর সোমবার পাকিস্তানের ২৩তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন শেহবাজ শরিফ। এক টুইট তিনি বলেছেন, ‌‘অভিনন্দন জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ। ভারতের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক চায় পাকিস্তান। জম্মু ও কাশ্মিরসহ অমীমাংসিত বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি অপরিহার্য।’

তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তানের আত্মত্যাগ সর্বজনবিদিত। আসুন শান্তি নিশ্চিত এবং জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মনোনিবেশ করি।’

উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ১৯৪৭ সাল থেকে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই প্রতিবেশির বিবাদের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে হিমালয় অঞ্চলের কাশ্মির। বিবাদপূর্ণ কাশ্মিরের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত ও পাকিস্তা। কিন্তু উভয় দেশই দুই কাশ্মিরকে নিজেদের বলে দাবি করে। কাশ্মির নামে ছোট একটি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চীনেরও।

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাওয়ার পর এ দুই প্রতিবেশি দেশ ১৯৪৮, ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালে তিনবার পুর্ণমাত্রার যুদ্ধে জড়িয়েছে। এরমধ্যে কেবল কাশ্মির ঘিরেই দুই দেশের মাঝে যুদ্ধ হয়েছে দু’বার।

ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো স্বাধীনতা অথবা প্রতিবেশি পাকিস্তানের সঙ্গে মিলিত হওয়ার দাবিতে সেখানে দশকের পর দশক ধরে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থার মতে, ১৯৮৯ সালে নয়াদিল্লির শাসনের বিরোধিতায় শুরু হওয়া সশস্ত্র বিদ্রোহে এখন পর্যন্ত এই অঞ্চলে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।

তবে হিমালয়ের কোল ঘেঁষে থাকা এই অঞ্চলটিতে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয় ২০১৯ সালে। ওই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন সরকার কাশ্মিরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত ভারতীয় সংবিধানের বিশেষ অনুচ্ছেদ বাতিল করে দেওয়ার পর নতুন করে সংঘাত শুরু হয়। মোদি সরকারের এই পদক্ষেপ পাকিস্তানকেও ক্ষুব্ধ করে তোলে।

শরিফের বিবৃতি নিয়ে যা বলছেন ভারতীয়রা

ভারত-অধিকৃত কাশ্মিরের ভারত-পন্থী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, তারা কাশ্মির সংকটের সমাধানের জন্য ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনায় সবসময় সমর্থন করে।

এই অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল জম্মু-কাশ্মির ন্যাশনাল কনফারেন্সের মুখপাত্র ইমরান নবী ধর আলজাজিরাকে বলেন, ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স বরাবরই ভারত ও পাকিস্তানের আলোচনার পক্ষে।

তবে কাশ্মিরের শিক্ষাবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিদ্দিক ওয়াহিদ মনে করেন, শেহবাজ শরিফের বক্তব্য ইসলামাবাদের নিয়মিত অবস্থানের বেশি নয়। তিনি বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে কাশ্মিরের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য পাকিস্তানে নতুন শরিফের কথিত দাবিকে ইসলামাবাদের নিয়মিত কৌশল হিসাবে বিবেচনা করছি। কারণ ইসলামাবাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে নয়াদিল্লির আলোচনার বিষয়টি কল্পনা করাও কঠিন। নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত এটি স্তিমিত থাকবে।

তবে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ও ফোর্স ম্যাগাজিনের সম্পাদক প্রবীণ সাহনি বলেন, পাকিস্তানের নেতার বক্তব্যে ভারতের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। ভারতের আলোচনা শুরু করা উচিত। সেখানে কিছুটা শান্তি আনা দরকার। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করা উচিত। আমি দেখছি উভয় পক্ষ আগ্রহী এবং তাদের মধ্যে আলোচনা শুরু করা উচিত। 

শরিফ ভাইদেরকে নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠ হিসেবে দেখা হয়

শেহবাজ শরিফের বড় ভাই নওয়াজ শরিফ; যিনি পাকিস্তানে তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন, তিনি ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং সামগ্রিক সম্পর্কের উন্নতি করতে চেয়েছিলেন।

২০১৪ সালে দুই দেশের মাঝে বিরল শান্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। ওই সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নওয়াজ শরিফ নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার এক বছর পর শরিফ পরিবারের এক সদস্যের বিয়েতে অংশ নিতে ইসলামাবাদ সফরে যান হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা নরেন্দ্র মোদি।

পাকিস্তানের অভিজাত রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য শরিফ ভাইদ্বয়। যাদেরকে নয়াদিল্লির প্রতি সমঝোতামূলক এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে আগ্রহী হিসেবে দেখা হয়। যা শেহবাজ শরিফের পূর্বসূরী ইমরান খানের একেবারে বিপরীতমুখী।

২০১৯ সালে ভারত-অধিকৃত কাশ্মিরে নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিতর্কিত পদক্ষেপ ঘিরে ইমরান খানের সরকারের শাসনামলে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য স্থগিত হয়ে যায়।

নরেন্দ্র মোদি এবং তার হিন্দু-জাতীয়তাবাদী মতাদর্শেরও সমালোচক ছিলেন ইমরান খান। ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে অভিযোগ করে তা বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।

ইসলামাবাদের সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের ইমতিয়াজ গুল বলেন, সাধারণত ভারতীয় নেতাদের সাথে ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক’ ছিল শরিফ ভ্রাতৃদ্বয়ের। এটি মূলত ভারতের জন্য সংলাপ পুনরায় শুরু করার একটি ভাল পয়েন্ট। 

২০১৩ সালে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালীন ভারত সফর করেছিলেন শেহবাজ শরিফ। যা একজন প্রবীণ পাকিস্তানি রাজনীতিকের জন্য প্রায় অস্বাভাবিক।

সূত্র: আলজাজিরা।

এসএস