এক দশকের বেশি সময় আগে মার্কিন গোপন নথি ফাঁস করে বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দেওয়া উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের আনুষ্ঠানিক আদেশ জারি করেছেন ব্রিটেনের একটি আদালত। ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ সম্পর্কে লাখ লাখ গোপন নথি ফাঁস করে দেওয়ার দায়ে বিচারের মুখোমুখি করতে অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের আনুষ্ঠানিক এই আদেশ জারি করা হয়েছে।

বুধবার ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি ও ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান এই তথ্য জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আদালতের এই আদেশের পর অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর সিদ্ধান্ত এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেলের ওপর নির্ভর করছে। তবে প্রত্যর্পণের বিষয়ে প্রীতি প্যাটেলের যেকোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আগামী ১৪ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল করতে পারবেন অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা।

যুক্তরাজ্যের আদালতে গত কয়েক বছর ধরে বহুল আলোচিত অ্যাসাঞ্জের প্রত্যর্পণ মামলার শুনানি চলছে। বুধবার সেন্ট্রাল লন্ডনের ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আনুষ্ঠানিক রায় ঘোষণা করায় দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা এই আইনি লড়াই অবসান হতে চলেছে। পূর্ব লন্ডনের বেলমার্শ কারাগার থেকে অনলাইনে মামলার শুনানিতে অংশ নেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। প্রায় ৭ মিনিটের শুনানি শেষে আদালতের প্রধান ম্যাজিস্ট্রেট পল গোল্ড স্প্রিং প্রত্যর্পণের আদেশ জারি করেন।

অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তারা ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন এবং মামলার অন্যান্য বিষয়ে আপিল আবেদন করবেন।

গত মাসে তার আইনজীবী বার্নবার্গ পিয়ার্স এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, তিনি এর আগে আদালতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য যেসব ইস্যু তুলে ধরেছিলেন, সেসবের সমাধান না আসায় তিনি হাইকোর্টে এখন পর্যন্ত কোনো আপিল করেননি।

‘অবশ্য আপিলের সেই পৃথক প্রক্রিয়া এখন শুরু করা বাকি আছে।’

যদিও অ্যাসাঞ্জকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টে তার আইনজীবীদের আপিলের অনুমতি গত মাসে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।

অস্ট্রেলীয় বংশোদ্ভূত ৫০ বছর বয়সী জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে মার্কিন সেনাবাহিনীর বিপুল পরিমাণ গোপন নথি ও কূটনৈতিক বার্তা ফাঁস করে অনেকের জীবন বিপন্ন করাসহ ১৮টি অভিযোগ এনেছে যুক্তরাষ্ট্র। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে কয়েক দশক কারাগারে কাটাতে হতে পারে।

২০১০ সালের মাঝের দিকে আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন অভিযানের ৫ লাখ গোপনীয় নথি ফাঁস করে বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। ইরাক-আফগান যুদ্ধের এসব নথি ফাঁসের দায়ে অ্যাসাঞ্জকে বিচারের মুখোমুখি করতে চায় ওয়াশিংটন।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের পর যদি তাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বেষ্টিত কোনো কারাগারেও রাখা হয়, তাহলে সেখানেও তার আত্মহত্যার ঝুঁকি রয়েছে বলে ব্রিটেনের আদালতে প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় গত বছরের জানুয়ারিতে জয় পেয়েছিলেন উইকিলিকসের এই প্রতিষ্ঠাতা।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সরকার আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে এবং গত অক্টোবরে দু’দিনের শুনানি শেষে আইনজীবীরা কূটনৈতিক আশ্বাসের ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, অ্যাসাঞ্জকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ফেডারেল সুপারম্যাক্স কারাগারে বিচ্ছিন্ন রাখা হবে না, বরং তাকে যথাযথ সেবা দেওয়া হবে।

অ্যাসাঞ্জ এখন কোথায়?

২০১২ সালের জুন মাস থেকে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন অ্যাসাঞ্জ। ২০১৯ সালের এপ্রিলে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাহার করে তাকে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে তুলে দেয় ইকুয়েডর। এরপরই জামিনের শর্ত ভঙ্গের দায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ব্রিটিশ আদালত। সেই সময় থেকে লন্ডনের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত বেলমার্শ কারাগারে বন্দি আছেন তিনি।

বার্তাসংস্থা এপি জানিয়েছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ইকুয়েডরের নাগরিকত্ব দিয়েছিলেন দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লেনিন মোরেনো। লন্ডনে অবস্থিত ইকুয়েডরের দূতাবাস থেকে অ্যাসাঞ্জকে বের করে আনতেই এই নাগরিকত্ব দিয়েছিলেন তিনি। জন্মসূত্রে অ্যাসাঞ্জ অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক।

তবে এর এক বছর পরই জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের রাজনৈতিক আশ্রয় বাতিল করে ইকুয়েডর। একের পর এক ‘দৈনন্দিন প্রোটোকল ও আন্তর্জাতিক রীতিনীতির লঙ্ঘনের’ কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে সেসময় দেশটি জানিয়েছিল। এরপরই তাকে যুক্তরাজ্যের পুলিশ আটক করে এবং কারাগারে পাঠায়।

অ্যাসাঞ্জের বিয়ে কারাগারে

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ দীর্ঘদিনের সঙ্গী স্টেলা মরিসের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন গত ২৩ মার্চ। লন্ডনের বেলমার্শ কারাগারে ব্যাপক নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তাদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।

উচ্চ-নিরাপত্তার এই কারাগারে অনুষ্ঠিত বিয়েতে মাত্র চারজন অতিথি অংশ নেওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন। এর বাইরে উপস্থিত ছিলেন দু’জন সাক্ষী ও দু’জন নিরাপত্তাকর্মী।

২০২১ সালের নভেম্বরে অ্যাসাঞ্জকে বাগদত্তা স্টেলা মরিসকে বিয়ে করার অনুমতি দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাজ্যের বিবাহ আইন- ১৯৮৩ অনুযায়ী, কারাগারে বিয়ের জন্য আবেদনের সুযোগ পান বন্দিরা। আবেদন মঞ্জুর হলে সম্পূর্ণ খরচ মিটিয়ে নিজেদের বিয়ে সম্পন্ন করতে পারেন বন্দিরা।

ইকুয়েডর দূতাবাসে অবস্থানের সময় দুই সন্তানের বাবা-মা হন অ্যাসাঞ্জ-মরিস। ২০১১ সালে অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীর দলে যোগ দেন
মরিস, তাদের মধ্যে সম্পর্ক শুরু হয় ২০১৫ সালে। সেই সম্পর্ক পরিণতিতে রূপ নেয় চলতি বছরের মার্চে।

এসএস