যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে ওয়াশিংটনের সঙ্গে রিয়াদের সম্পর্ক ছিল অনন্য উচ্চতায়। তবে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ট্রাম্পের বিদায়ের পর বিদায় নিয়েছে ওয়াশিংটনের সেই নীতিও। গত মাসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া জো বাইডেন সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন নতুন করে শুরু করতে আগ্রহী। এ বিষয়ে সৌদি নেতৃত্বকে পরিষ্কার বার্তা দিয়েছেন তিনি।

তবে নিজস্ব লক্ষ্য আছে সৌদি আরবেরও। আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেদের দেখতে চায় তারা। আর তাই সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যা, ইয়েমেন যুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পরও বাইডেন প্রশাসনের কড়া মনোভাবের কারণে কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ তুলে নিয়ে পুনরায় মিত্র দেশ হিসেবে স্বীকৃতি, বিচার ব্যবস্থায় সংস্কার এবং মানবাধিকার কর্মীদের মুক্তির মাধ্যমে ওয়াশিংটনের নতুন প্রশাসনের মন জয়ের চেষ্টা করছে সৌদি আরব। কারণ আঞ্চলিক শক্তি হতে চাইলে বাইডেন প্রশাসনের স্বীকৃতি সৌদি রাজপরিবারের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। তবে সেটা কি সৌদি আরব খুব সহজে পাবে?

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে ২০১৯ সালে প্রার্থিতা নিশ্চিত হওয়ার পর জো বাইডেনকে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। সেসময় তিনি সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছিলেন, ‘আমি বেশ স্পষ্টভাবেই বলে দিতে চাই, আমরা তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করবো না। (সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যা কারণে) সৌদি আরবকে মূল্য পরিশোধ করতে হবে।’

আর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সপ্তাহখানেকের মাথায় সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) কাছে অস্ত্র বিক্রি স্থগিত করেছেন বাইডেন। সেসময় সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেন, ‘আমাদের পররাষ্ট্রনীতির কৌশলগত কিছু লক্ষ্য পূরণ করতেই অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে। আমরা এই মুহূর্তে সেই কাজটিই করছি।’

সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত গত ২৭ জানুয়ারি প্রথম প্রকাশ করে মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। বিলিয়ন ডলারের এসব অস্ত্রের মধ্যে ছিল বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল আঘাত হানতে সক্ষম সমরাস্ত্র। এমনকি অত্যাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানও হাতে পাওয়ার কথা ছিল আমিরাতের; কিন্তু বাইডেন প্রশাসনের ওই সিদ্ধান্তে তা অনিশ্চিত হয়ে যায়।

ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। ট্রাম্পের অধীনে ওয়াশিংটনের নীতি ছিল ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃস্থানীয় এই দুই দেশকে সঙ্গে নিয়ে ইরানের ওপর ‘সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ’ নিশ্চিত করা। ইরানের সঙ্গে উত্তেজনার কারণে ২০১৯ সালের মে মাসে জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। একইসঙ্গে কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং জর্ডানের কাছে ৮০০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত অনুমোদন দিয়েছিলেন তিনি।

হাস্যকরভাবে বিশ্ব মঞ্চে নেতৃস্থানীয় একটা অবস্থান চায় সৌদি আরব। দেশটি ২০২০ সালে জি-২০ সম্মেলন আয়োজন করে। এছাড়া আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে স্বীকৃতির পাশাপাশি সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে- আন্তর্জাতিক পর্যটন ও বিনিয়োগের আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে সারা বিশ্বের কাছ থেকে সম্মান আর বৈধতা আদায় করে নেওয়া। যদিও স্বল্পমেয়াদে এটা বেশ কঠিন। বিশেষ করে যখন ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিতে ওয়াশিংটনের ফেরার সুযোগ ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে। সফল ইরান নীতি অর্জনের জন্যই সৌদি আরবের সঙ্গে ওয়াশিংটনের কার্যকর এবং সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রয়োজন।

বাইডেনের জন্য চ্যালেঞ্জ আরও আছে। ট্রাম্পের মতো সৌদিকে বন্ধু হিসেবে পেতে গেলে দেশে ও দেশের বাইরে সৌদি রাজতন্ত্রের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং এই কাজে মার্কিন ভূমিকাকেও স্বীকার করে নিতে হবে বাইডেন প্রশাসনকে। এরপরই নতুনভাবে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক শুরু করতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটি। মার্কিন কংগ্রেসের উভয়কক্ষের সদস্য এবং অনেক মার্কিন নাগরিকই মনে করেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে বাইডেন প্রশাসনের সীমিত যে লক্ষ্য রয়েছে, সেটা অর্জনে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ সুসম্পর্ক প্রয়োজন।

দশকের পর দশক ধরে সৌদি আরবকে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ সমর্থন দিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি সৌদির বিতর্কিত অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিজেও অজুহাত দেখিয়ে এসেছে। এছাড়া সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সৌদি আরবে বিশ্বের অন্যতম সেরা ‘অস্ত্র সজ্জিত’ এবং ‘সবচেয়ে অদক্ষ’ সেনাবাহিনী তৈরিতে সাহায্য করেছে ওয়াশিংটন। ইয়েমেনজুড়ে যেখানে-সেখানে সৌদি সামরিক বাহিনীর বিমান হামলার মাধ্যমেই তাদের অযোগ্যতা আর অদক্ষতা ফুটে উঠেছে। ২০১৫ সালে ওবামা প্রশাসনের সাহায্যে এবং অধীনে আরব উপদ্বীপের সবচেয়ে দরিদ্র দেশটিতে হামলা শুরু করে সৌদি আরব। সেই হামলার কারণে দেশটিতে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। আমেরিকান বোমা এখনও ইয়েমেনের সাধারণ নাগরিকদের ওপর পড়ছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি সম্পর্ক বেড়েছে স্রোতের গতিতে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়া সর্বশেষ ওই প্রশাসনের আমলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে বাদ দিয়ে জামাতা জ্যারেড কুশনারের মাধ্যমে সরাসরি সৌদি নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন ট্রাম্প। এই সময়ে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যা, একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অপহরণসহ সৌদি নেতৃত্ব বিভিন্ন বিতর্কিত কাজ করলেও আসলে কোনও জবাবদিহিতাই করতে হয়নি তাদের। আগের মতোই সৌদি আরবের এসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিষয়ে চোখ বন্ধ রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এটার অবসান হতে হবে।

আশার কথা হচ্ছে- ঠিক এই সময়েই বড় বড় পরিবর্তন বা সংস্কারের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছিল সৌদি আরব। ২০১৫ সাল থেকে দেশটি তার নাগরিকদের ওপর থেকে ধর্মীয় বিভিন্ন বিধি-নিষেধ কমানোর পাশাপাশি নারীদের জন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ, বিদেশি পর্যটক ও বিনিয়োগকারীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক মানদণ্ডের সঙ্গে মিল রেখে অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা করে আসছে। দেশটির তরুণ নেতা ও ক্রউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান আঞ্চলিকভাবে নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে দেখতে চান। একইসঙ্গে সৌদি আরবকে বানাতে চান মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র।

বিশ্লেষকরা লক্ষ্য করেছেন যে, সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি কিছু তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় প্রতিষ্ঠা অন্যতম। ২০১৭ সালের জুনে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও বাহরাইন হঠাৎ করে কাতারের ওপর সর্বাত্মক অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল। সৌদি আরব ও তার মিত্রদের দাবি ছিল আলজাজিরা টিভি নেটওয়ার্ক বন্ধ, ইরানের সাথে সম্পর্কে রাশ টানা এবং সেদেশে তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করাসহ ১৩টি দাবি কাতারকে ১০ দিনের মধ্যে মানতে হবে। কিন্তু গত মাসে আল-উলা শহরের উপসাগরীয় জোটের বৈঠকে কাতারের যোগদানের মধ্যে দিয়ে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে। কাতারকে একটি মামলা প্রত্যাহার ছাড়া আর কোনও দাবিই মানতে হয়নি।

এছাড়া কিছুদিন আগে সৌদি আরবের বিচার ব্যবস্থায় সংস্কারের কথা ঘোষণা করেছেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। এতদিন দেশটিতে ইসলামী আইন বা শরিয়া ছাড়া কোনও লিখিত আইনি ব্যবস্থা ছিল না। এর ফলে বিভিন্ন মামলায় জটিলতা এবং রায়ে অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন চারটি নতুন আইন তৈরির পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে সৌদি কর্মকর্তারা বলছেন, এর ফলে দেশটি সকল আইন লিপিবদ্ধ করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

এছাড়া সম্প্রতি মানবাধিকারকর্মীদের মুক্তি দিতে শুরু করেছে সৌদি আরব। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, তাদের অনেককেই সন্ত্রাসবাদ-সম্পর্কিত মামলায় আটকে রাখা হয়েছিল। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত এই বন্দিদের একজন হলেন লুজাইন আল-হাথলুল। গত কয়েক সপ্তাহে সৌদি-মার্কিন দ্বৈত নাগরিক এমন কয়েকজন আটক ব্যক্তিকেও মুক্তি কিংবা সাজার মেয়াদ কমানো হয়েছে।

জো বাইডেনে পরিবর্তনের সূচনা?

লুজাইন আল-হাথলুল মুক্তি পাওয়ার পরই সৌদি আরবের এই সিদ্ধান্তে স্বাগত জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেছেন, ‘আল-হাথলুল নারী অধিকারের একজন জোরালো প্রবক্তা এবং তাকে মুক্তি দেওয়াটা সঠিক কাজই হয়েছে।’

মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ওয়াশিংটনে সৌদি আরবকে সংশয়ের চোখে দেখা হচ্ছিল। মানবাধিকারের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে আশ্বস্ত করতে সৌদি আরব যে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে, লুজাইন আল-হাথলুলের মুক্তি তার সবচেয়ে স্পষ্ট লক্ষণ।

সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার জামাতা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ছিল উষ্ণ সম্পর্ক। এই সুসম্পর্কের কারণে যুবরাজ মোহাম্মদ ইচ্ছেমত কাজ করতে পেরেছিলেন বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট শিবির মনে করে, ট্রাম্প প্রশাসন যুবরাজ সালমানকে ‘ব্ল্যাংক চেক’ দিয়ে দিয়েছিল। ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাসোগি ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ বলেছিল- যুবরাজ সালমানই ওই অপারেশনের আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুক্তি ছিল, এ হত্যাকাণ্ডের কারণে সৌদি-মার্কিন বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ব্যাহত হওয়াটা ঠিক হবে না। কিন্তু ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-পূর্ব বিতর্কে জো বাইডেন বলেছিলেন, সৌদি আরবকে এ জন্য ‘মূল্য দিতে হবে’ এবং তিনি সেখানে ‘অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দেবেন।’

বাইডেনের জয় বদলে দিয়েছে সবকিছু

জো বাইডেন এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা এখন নিয়ন্ত্রণ করছে কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট। বিবিসির বিশ্লেষক লিজ ডুসেট বলছেন, সৌদি কর্মকর্তারা দাবি করে থাকেন যে, তারা বাইরের কোনও চাপের কাছে নতি স্বীকার করছেন না। কিন্তু হোয়াইট হাউসে নতুন দল আসার পর তারা মানবাধিকারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং এটা স্পষ্ট যে সৌদি আরব চাইছে— মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অ্যাজেন্ডা থেকে মুছে যাক।

মানবাধিকার কর্মী আল-হাথলুলের মুক্তি, বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তনের ঘোষণা- এর সবই এসেছে চলতি সপ্তাহেই। এছাড়া সৌদি কর্মকর্তারা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে তাদের কৌশলগত গুরুত্বের কাছে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার মতো অন্য সব ইস্যু চাপা পড়ে যাবে। তবে গত বেশ কিছুদিন ধরেই সৌদি আরব তার ‘ব্র্যান্ড ইমেজ’ উন্নত করতে চেষ্টায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এমনকি দেশটিতে সম্প্রতি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যাও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

পরিবর্তন কতটা স্থায়ী হবে?

জো বাইডেনের প্রশাসন সৌদি-মার্কিন সম্পর্কের খোল-নলচে পুরো বদলে ফেলার অঙ্গীকার করেছে। তাদের ধারণা, মানবাধিকার এই কাজে একটা বড় ভূমিকা পালন করবে। জো বাইডেন কয়েকদিন আগেই ঘোষণা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র আর ইয়েমেনে সৌদি-নেতৃত্বাধীন যুদ্ধকে সমর্থন করবে না। যদিও এর বাস্তব প্রয়োগ ঠিক কীভাবে হবে তা খুব স্পষ্ট হয়নি এখনও। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংবাদ বিশ্লেষকরা বলেছেন, এটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সৌদি আরবের জন্য এক বড় আঘাত। কারণ ইয়েমেনের রক্তাক্ত যুদ্ধে হুথি বিদ্রোহী-বিরোধী অভিযানে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে সৌদি আরব এবং এই নীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হচ্ছেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান।

জো বাইডেন প্রশাসন আরেকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। আর সেটি হচ্ছে- সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে শত শত কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি স্থগিত করা - যদিও এর একটা পুনর্বিবেচনার কথা আছে।

পরিবর্তন কি দীর্ঘমেয়াদী হবে?

বিবিসির বিশ্লেষক ফ্র্যাংক গার্ডনার বলছেন, আরব বিশ্বে আমেরিকার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তাবিষয়ক সহযোগী হলো সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের সম্প্রসারণ মোকাবিলা করতে সৌদি আরব গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের এক বড় ক্রেতা।

স্টকহোম ইনস্টিটিউট অব পিস রিসার্চ বলছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সৌদি আরব ছিল সবচেয়ে বড় অস্ত্র আমদানিকারক। ইয়েমেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মত পশ্চিমা দেশগুলো থেকে যাওয়া অস্ত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই অস্ত্র আমদানির বড় অংশই শুরু হয়েছিল বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকার সময়। তখন জো বাইডেন ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট।

অস্ত্র বিক্রির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান সিএএটির অ্যান্ড্রু স্মিথ বলেন, এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হলে বাইডেনকে অনেক বেশি শক্ত অবস্থান নিতে হবে। ফ্র্যাংক গার্ডনার বলছেন, রিয়াদের সাথে রাশিয়া ও চীনও অস্ত্র ব্যবসা করতে আগ্রহী হবে, আর তাদের সুবিধা হলো তারা মানবাধিকার নিয়ে কোন ‘অস্বস্তিকর প্রশ্ন’ তুলবে না। সৌদি আরব কার্যত এখন চালাচ্ছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানই। তার আশপাশে যারা আছেন তারা নিশ্চয়ই দেশটির নেতিবাচক ভাবমূর্তির ব্যাপারে সচেতন।

প্রশ্ন হচ্ছে, সৌদি আরবের মানবাধিকার পরিস্থিতির কতটা উন্নতি ঘটাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র? এটা নির্ভর করবে, হোয়াইট হাউস এ নিয়ে কতটা চাপ প্রয়োগ করতে চায় তার ওপর। সেখানে পারস্পরিক স্বার্থের হিসেবটা গুরুত্বপূর্ণ।

সৌদি রাজপরিবারের ভেতরের খবর রাখেন এমন একটি সূত্র বলেছে, সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কৌশলগত অংশীদারই থাকবে। তবে মানবাধিকারের ওপর অনেক বেশি আলোকপাত করবে বাইডেন প্রশাসন। এখন সব কিছুকে ছাপিয়ে সৌদি আরবকে যদি অন্য সব দেশের মতো স্বাভাবিক দেশ হিসেবে বা প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হলে রিয়াদেরও কূটনৈতিক কার্যক্রম উন্নত করতে হবে।

দেশটির সামরিকবাহিনী ইয়েমেনে যা করছে, সে বিষয়ে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকতে হবে। পাশাপাশি দেশটির বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে বাকি বিশ্বকে জানার সুযোগ দিতে হবে। এরপরই নতুন সেই সৌদি আরবকে গ্রহণ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানও ক্ষমতায় থেকে যেতে পারেন। এরপর বাইডেন প্রশাসন হয়তো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সৌদি আরবকে কিছু গাইডলাইন দিতে পারে এবং একইসঙ্গে সেটাও, যা সৌদি আরব চায়। অর্থ্যাৎ— সৌদি আরবকে হয়তো আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে মেনে নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের।

টিএম