গত ২০ জানুয়ারি জো বাইডেন আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব  গ্রহণ করেন। নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সম্ভাব্য যেসব বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সে বিষয়ে দু’দিন পর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিষেক অনুষ্ঠানের বক্তব্যে জো বাইডেন তার দল ডেমোক্র্যাট পার্টির সদস্য এবং নতুন মার্কিন প্রশাসনকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘বন্ধুগণ, এখন সময় পরীক্ষার।’- কথাটি সম্পূর্ণ যথার্থ এবং এ পরীক্ষার সবথেকে কঠিন প্রশ্নগুলো আসবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে।

এর কারণ হিসেবে ওই প্রতিবেদনে বিবিসি বলেছিল, বর্তমান বাইডেন প্রশাসনে যারা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি এবং এ বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের অনেকেই পূর্বে ওবামা প্রশাসনে ছিলেন।

সে সময় মধ্যপ্রাচ্যের যেসব সমস্যার সমাধান তারা দিয়ে যেতে পারেননি কিংবা দিলেও স্থায়ী হয়নি, সেগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে তারা দেখতে পাবেন, গত চার বছরে বাস্তবতা অনেক বদলে গেছে।

সবচেয়ে বড় ধাক্কা তারা খাবেন যখন দেখবেন ওবামা প্রশাসনে থাকার সময় যেসব নীতি তারা প্রণয়ন করেছিলেন, তার অনেকগুলো উধাও হয়ে গেছে বা জটিল চেহারা নিয়েছে। 

২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৬ স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্রের স্বাক্ষরিত পরমাণু  চুক্তি, যা জ্যাকোপা নামে পরিচিত, পুনরায় কার্যকর করা নিয়ে উদ্ভুত জটিল পরিস্থিতিতে বিবিসির ভবিষ্যৎবাণী অনেকটাই ফলে যাচ্ছে বলে ধারণা করে নিতে পারেন যে কেউ।

পরমাণু চুক্তি আবার সক্রিয় করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিমহলে ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠা বিতর্কের সারসংক্ষেপ টানা যায় মাত্র একটি প্রশ্নে — ‘কে প্রথম পদক্ষেপ নেবে, তেহরান নাকি ওয়াশিংটন?’

তেহরান চাইছে চুক্তি সক্রিয় ও কার্যকর করার প্রথম পদক্ষেপ আসুক যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে। এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে ইরান সরকারের বক্তব্য— ২০১৮ সালে ‘ত্রুটিপূর্ণ’, ‘একপেশে’, ‘এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই’ ইত্যাদি অজুহাত তুলে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে ইরানের ওপর একগুচ্ছ নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যে কারণে এখনো ভুগতে হচ্ছে ইরানের সাধারণ জনগণকে। ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞাগুলোর কারণে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্য, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতে সমস্যায় পড়েছে ইরান।

এসব কারণে যাবতীয় নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নিয়ে আবার জ্যাকোপাতে ফিরে আসা এখন সম্পূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে মনে করছে ইরান সরকার।গত দু’মাসে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন, চুক্তিতে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরতে হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র ফিরে আসার আগ পর্যন্ত ইরান পরমাণু চুক্তিতে ফিরবে না।

অন্যদিকে তেহরানের এই দাবি নাকচ করে দিয়েছে ওয়াশিংটন। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, জ্যাকোপাতে ইরানের ওপর যে শর্তগুলো আরোপ করা হয়েছিল, যেমন ইউরেনিয়ামের মজুত বাড়ানো, মজুত করা ইউরোনিয়াম পরিশোধন করে গুণগত মান বাড়ানো ইত্যাদি কর্মকাণ্ড থেকে ইরানের সরে আসা এবং ফার্ডো শহরসহ দেশটির যেসব এলাকায় পরমাণু প্রকল্পের কাজ চলছে সেগুলো বন্ধ করার আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তিতে ফিরবে না।

এছাড়া আর একটি বিষয় হলো সম্প্রতি স্বল্প, মাঝারি ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছে ইরান এবং দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডারও যথেষ্ট সমৃদ্ধ, যা উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলোর। ২০১৫ সালে যখন পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর হয়, তখন এই ব্যাপারটি ছিল না।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পরমাণু চুক্তিতে ফেরার পাশাপাশি ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্প নিয়ন্ত্রণেও ইরানের সঙ্গে একটি রফায় আসতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্রসহ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্রগুলো। এছাড়া পরমাণু চুক্তিকে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে ইতোমধ্যে এতে সৌদি আরবকে অন্তর্ভূক্ত করার প্রস্তাব রেখেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ।

এখানে একটি বিষয় স্মরণে রাখা প্রয়োজন ২০১৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন ইরানের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, তখন থেকেই এর শক্ত বিরোধিতা করে আসছিল মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের চিরবৈরী দুই আঞ্চলিক পরাশক্তি দেশ সৌদি আরব ও ইসরায়েল। ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বহু বছরের কিন্তু সৌদি আরবের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের হৃদ্যতার বিষয়টি শুরু হয় ২০১৭ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম বিদেশ সফরে ট্রাম্প সৌদি আরব গিয়েছিলেন।

ওই সফরে তিনি সৌদি আরব সরকারকে ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি করেন যা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অস্ত্র চুক্তি। মূলত তখন থেকেই মার্কিন প্রশাসন গ্রহণ করে সৌদি আরবের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুকূল্য এবং ইরানকে যতটা সম্ভব চাপে রাখার নীতি।

নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট অবশ্য তার পূর্বসূরী ট্রাম্পের পথে হাঁটেননি। ইয়েমেনে সংঘাত বন্ধে ইতোমধ্যে সৌদি আরবের সঙ্গে অস্ত্র বিক্রি ‍চুক্তি বাতিল করেছেন তিনি। ইসরায়েলের সঙ্গে দৃশ্যত ঘনিষ্টতাও এড়িয়ে চলছেন জো বাইডেন।

কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে, ইরান আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, ইরান সরকার ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিতে কোন প্রকার পরিবর্তন কিংবা নতুন কোনো দেশের অন্তর্র্ভক্তির তীব্রভাবে বিপক্ষে।

জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবশ্য চুক্তিতে ইরানের ফিরে আসার আগ্রহকে স্বাগত জানিয়েছে; পাশাপাশি এই মর্মে দেশটিকে সতর্কবার্তা দিয়েছে যে ইরান যদি জ্যাকোপার শর্ত লঙ্ঘণ করে তাহলে ধসে পড়বে এই চুক্তি।

তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ওবামা প্রশাসনের উদ্যোগে বহুপাক্ষিক যে ঐতিহাসিক চুক্তি হয়েছিল, ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প তা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নেওয়ার পর চুক্তিটি এখন সুতোয় ঝুলছে। ইরান যদি চুক্তি শর্ত মেনে চলার ব্যাপারে উদাসীনতা প্রদর্শন করে, তাহলে যে কোনো সময় তা ছিঁড়ে পড়তে পারে।

অর্থাৎ, ইসরায়েল এবং তার মিত্র তিন-চারটি দেশ ছাড়া কেউই চাইছে না জ্যাকোপা বা পরমাণু চুক্তি অকার্যকর হোক। আবার একে পূর্ণমাত্রায় সক্রিয় করতে এখন পর্যন্ত যে দু’টি পথ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে- (১) নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে আসা অথবা (২) বর্তমান নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়ে চুক্তির শর্তগুলো বিশ্বস্তভাবে ইরানের পালন করা এবং এরপর নিষেধাজ্ঞা তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেনদরবার করা – এ দু’য়ের মধ্যে কোনটি অধিক উপযোগী তা নিয়েও বিভ্রন্তিতে রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং এই বিভ্রান্তি একদিকে যেমন তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ককে সুতোয় ঝুলিয়ে দিয়েছে, পাশাপাশি পরিপুষ্ট করছে উভয় দেশের মৌলবাদী গোষ্ঠেীদেরও।

দুর্ভাগ্যবশত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান উভয়দেশই বর্তমানে নিজেদের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে নিরতিশয় ব্যস্ত। প্রথমত, করোনা মহামারিতে পর্যুদস্ত অবস্থায় রয়েছে দু’টি দেশ। গতবছর মহামারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর তালিকায় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে ইরান।

এছাড়া সামনে ইরানের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সে বিষয়ক রাজনৈতিক তৎপরতা চলছে দেশটিতে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনও আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থায় রয়েছে। 

উপরন্তু ২০১৫ সালে যখন চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল, তখন থেকেই এর তীব্র বিরোধী ইসরায়েল ওয়াশিংটনে তার ইহুদি লবির মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই তদবির শুরু করেছে, যেন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিতে না ফেরে। এ বিষয়টিও ইরানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। 

তবে এও সত্য যে, উভয় দেশই যদি গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় এবং জাতীয় নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের বিষয়ে মনযোগী হয়, তাহলে দু’পক্ষের কারোরই কোনো প্রকার ক্ষতিস্বীকার না করে এখনো এই চুক্তি পুনরুদ্ধার ও কার্যকর করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত রবার্ট ম্যালির নির্দেশনা চাইতে পারে ইরানের রুহানি ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন।

কারণ, ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন এই মার্কিন আইনজীবী। যেহেতু তিনি এ বিষয়টি সম্পর্কে বিশদভাবে জানেন, তাই গত ৫ বছরে দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্কে যে ফাঁকগুলো তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করতে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় এবং কিভাবে দু’দেশের মধ্যে আবার একটি আস্থাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপণ করা যায় সে বিষয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিতে পারবেন বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা।

এসএমডব্লিউ/