গত ১ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা মিয়ানমারে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত এনএলডি সরকারকে আক্ষরিক অর্থেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লেইং এর নেতৃত্বে দেশটির সামরিক বাহিনী যখন ক্ষমতা দখল করল, তার পরদিন জার্মানিতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা অধিকার আন্দোলনকর্মী নায়ে সান লোইন নিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট লক্ষ্য করে চমকে ওঠেন।

তিনি দেখেন তার টুইটার অ্যাকাউন্ট ভরে উঠেছে মিয়ানমারে তার ফেলে আসা বন্ধু ও স্বজনদের টুইটে। সবাই বলছেন, কয়েকবছর আগে সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে নায়ে সান লোইনের পাশে আছেন তারা।

অবশ্য লোইনের চমকে ওঠা বা বিস্ময়াপন্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের আরাকান বা রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর যখন দেশটির সেনাবাহিনী হত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগসহ নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে, তখন এই নির্যাতন বন্ধের দাবিতে জনমত গঠন করা শুরু করেছিলেন লোইন। এ কাজে যুক্ত হওয়ার কারণে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মী সম্প্রদায় থেকে মারধোর- এমনকি হত্যার হুমকি পর্যন্ত পেয়েছিলেন লোইন, যার প্রেক্ষিতে জার্মানিতে আশ্রয় চান তিনি।

কিন্তু ২ ফেব্রুয়ারি লোইন লক্ষ্য করেন, যাদের হুমকির কারনে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, মিয়ানমারে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে তারাই এখন লোইনকে সমর্থন ও সহযোগিতা করতে চেয়ে টুইট করেছেন।

দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ দেশ মিয়ানমারের মোট জনসমষ্টির দুই তৃতীয়াংশই বর্মী জনগোষ্ঠীভুক্ত, বা বার্মিজ। প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী বর্মীরাই দেশের শাসনতান্ত্রিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর সবচেয়ে প্রভাবশালী অংশ। বাকি এক তৃতীয়াংশ হচ্ছেন দেশটিতে বসবাসকারী ১০০টিরও বেশি সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীভূক্ত মানুষ, যাদের একটি বড় অংশ কোনো না কোনো সময় দেশটির সেনাবাহিনী কিংবা বর্মী জনগোষ্ঠীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

এদের মধ্যে গত কয়েক দশকে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত নৃগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। জাতিসংঘের তদন্তকারী দল ইতোমধ্যে জানিয়েছে তাতমাদৌ নামে পরিচিত মিয়ানমার সেনাবাহিনী ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর যে নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে, তার মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশ থেকে তাদের সম্পূর্ণ নির্মূল করে ফেলা।

নির্যাতিত রোহিঙ্গারা তখন মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন বেসামরিক সরকারের কাছ থেকে কোনো প্রকার সমর্থন, সহযোগিতা পায়নি। উপরন্তু হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা নির্যাতন বিষয়ক মামলার যখন শুননি চলছিল, তখন অবিশ্বাস্য এবং ন্যাক্কারজনকভাবে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি তাতমাদৌকে সমর্থন করেছিলেন।

মামলায় গণহত্যার যে অভিযোগ তোলা হয়েছিল, তাতে প্রথমেই আপত্তি জানিয়েছিল সু চির নেতৃত্বাধীন এনএলডি সরকার। মিয়ানমারের সাধারণ জনগণের মধ্যেও রোহিঙ্গাদের প্রতি কোনো সহানুভূতি লক্ষ্য করা যায়নি; মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বসবাসের দীর্ঘ ইতিহাস থাকা স্বত্ত্বেও অনেক বার্মিজ বিশ্বাস করতেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা জনগোষ্ঠী।

কিন্তু ১ ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থান সবার না হলেও অন্তত কিছু বার্মিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এনেছে। নায়ে সান লোইন, যার টুইটার অ্যাকাউন্টে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন ৩ হাজারেরও বেশি নতুন অনুসারী, এ বিষয়ে বলেন, ‘তারা এখন বুঝতে পারছে যে আমাদের সবার সাধারণ শত্রু হচ্ছে সামরিক বাহিনী।’

নায়ে সান লোইনের মতো প্রায় একই অভিজ্ঞতা হয়েছে ইয়াংহি লিরও। মিয়ানমারে জাতিসংঘের সাবেক দূত ইয়াংহি লি ২০১৭ সালে যখন রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানান, তখন মিয়ানমারে তুমুল নিন্দা হয়েছিল তার। কিন্তু ৪ ফেব্রুয়ারি সু চির মুক্তি চেয়ে নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে টুইট করেন লি, তার সেই টুইটের কমেন্ট অপশনে অনেক বার্মিজ জানান, তারা নিজেদের পূর্বকার আচরণের জন্য অনুতপ্ত।

একজন লিখেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের বিষয়ে পূর্বে আপনাকে যেসব কথা বলেছিলাম, সেজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।’

আর একজন লিখেছেন, ‘আপনাকে ভুল বোঝার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা খুব সংকীর্ণ মানসিকতার পরিচয় দিয়েছি।’

মিয়ানমারের মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইতোমধ্যে তাকে ‘রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচারের জন্য লড়াকু বীর’ বলে উপাধিও দিয়ে ফেলেছে বলে জানিয়েছেন ইয়াংহি লি।

মিয়ানমারের প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনে বসবাসকারী কারেন নৃগোষ্ঠীভূক্ত লিলি(ছদ্মনাম) স্বীকার করেছেন, দেশের সাম্প্রতিক এই অভ্যুত্থান তাকে তার স্বভাবগত দ্বৈত নীতির বিষয়ে সচেতন করেছে। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে যখন আরাকানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী, তখন এ বিষয়ে চুপ ছিলেন তিনি।

পেশায় আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মী লিলি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি এই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান না নেয় এবং আমাদের সমর্থন না করে, সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় আমাদের নিয়তিও রোহিঙ্গাদের মতোই হবে।’

বার্মিজদের সমর্থন চান রোহিঙ্গা অধিকারকর্মীরা

এদিকে রোহিঙ্গা অধিকার কর্মীদের একাংশের বিশ্বাস, সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে সম্প্রতি মিয়ানমারে যে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে উঠছে, তাতে সংহতি ও সমর্থন জানালে বাংলাদেশ-ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়ার পথ সুগম হবে।

নায়ে সান লোইন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা বার্মিজ জনগণের সঙ্গে সংহতি স্থাপণের চেষ্টা করছি। অধিকাংশ রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী মিয়ানমারে চলমান আন্দোলনকে সমর্থন করছেন।’

শুধু অধিকারকর্মীরাই নন, সেনাবাহিনীর নির্যাতনে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া অনেক রোহিঙ্গাও আন্দোলনকে সমর্থন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এমনই একজন হলেন মোহাম্মদউল্লাহ(২৪)। সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন মোহাম্মদউল্লাহ, যা ইতোমধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরনার্থী শিবির হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর যখন সেখানে গণআন্দোলন শুরু হলো, তা সমর্থন করে তখন থেকে নিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে একের পর এক টুইট করে যাচ্ছেন মোহাম্মদউল্লাহ। এমনকি 

মিয়ানমারে সম্প্রতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠা আন্দোলনের প্রতীক তিন আঙ্গুলের স্যালুট বা অভিবাদনের ছবিও পোস্ট করেছেন তিনি, যার অর্থ ‘এবার তোমরা বিদায় হও।’

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমরা যদি এই আন্দোলনে তাদের(বার্মিজ) পাশে থাকি, তাহলে তারাও আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠবে।’ 

রোহিঙ্গাদের ওপর অভ্যুত্থানের প্রভাব

গণআন্দোলন বা বিক্ষোভ মিয়ানমারে নতুন কোনো ব্যাপার নয় এবং দেশটির সেনাবাহিনী বা তাতমাদৌ শক্তহাতে বিক্ষোভ দমনে বরাবরই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। তাই সম্প্রতি সেখানে শুরু হওয়া গণ আন্দোলন সামরিক বাহিনীকে তার পুরনো স্বভাব ভুলিয়ে দেবে এমন সম্ভাবনা খুব কম।

বরং এর ফলে এখনও দেশটির শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সাধারণ বার্মিজ জনগণের যতটুকু সম্পর্ক রয়েছে, তা ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে আন্দোলনের কয়েকজন সংগঠকের সঙ্গে কথা হয়েছে উল্লেখ করে নায়ে সান লোইন বলেন, তিনি ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানোর নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লেইংকে অভিযুক্ত করতে বার্মিজ লবিকে তদবিরের পরামর্শ দিয়েছেন। তার ভাষ্য, এ পদক্ষেপ নেওয়া হলে মিয়ানমারের জান্তা সরকারপ্রধানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। 

তবে বার্মিজ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে এই সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বা ‘মৈত্রীর’ স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয়ও রয়েছে অনেক রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী। ওয়াশিংটননিবাসী রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী ওয়াই ওয়াই নু এ বিষয়ে বলেন, ‘(বার্মিজদের সঙ্গে) সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক মানে এই নয় যে রোহিঙ্গারা ব্যক্তিগতভাবে অং সান সু চির সমর্থক হয়ে গেছে। এই আন্দোলনে সংহতি জানানোর মাধ্যমে আমরা শুধু এটাই স্পষ্ট করতে চাই যে আমরা মিয়ানমারে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে।’ 

এ বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞাদের একাংশেরও ধারণা, রোহিঙ্গা ও বার্মিজ জনগোষ্ঠীর মধ্যে মৈত্রী সহজে হবে না। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের মিয়ানমার বিষয়ক বিষেশজ্ঞ অধ্যাপক ইয়ান হলিডে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মিয়ানমারে বার্মিজ এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভেদ এবং বিভক্তির সীমারেখা অনেক অনেক গভীর। রোহিঙ্গাদের তারা(বার্মিজ) এখনো মিয়ানমার জাতির অংশ বলে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়।’

তবে নায়ে সান লোইনের মত অনেক অধিকারকর্মী রয়েছেন, যারা বর্তমান মিয়ানমারের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বার্মিজ জনগণের সঙ্গে নিজেদের বিবাদ বা মতপার্থক্য মীমাংসার জন্য কাজ করতে আগ্রহী।

এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি জানি, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বার্মিজদের সঙ্গে আমাদের মতপার্থক্য রয়েছে এবং সেগুলো অনেক গভীর; কিন্তু তারপরও আমি হাল ছাড়তে রাজি নই। আমরা শুধু এটাই তাদের বলতে চাই যে, মানবাধিকার কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সম্পদ নয়, এটা সবার জন্য প্রযোজ্য।’

এসএমডব্লিউ