গত মাসে একটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর সিঙ্গাপুরে মানুষের মধ্যে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়েছে

তান মেই কিয়ানের ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে একটিই ছবি আছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি ও তার দুই বন্ধু সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্টের হাতে একটি চিঠি তুলে দিচ্ছেন। 

সাত বছর আগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত দাচিনামূর্তি দারিয়াহ নামে ৩৬ বছর বয়সী এক যুবকের দণ্ড মওকুফের আবেদন করা হয়েছে ওই চিঠিতে। তার অপরাধ ছিল সিঙ্গাপুরে ৪৪ গ্রাম হেরোইন পাচার করা।

তান বলেছেন, এখানে মিডিয়া ব্যাপকভাবে সেন্সর করা হয়। তাই, আমাদের মতামত প্রকাশ করার সুযোগ সীমিত। 

কিন্তু মালয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুরে মাদক চোরাচালানের দায়ে নাগেন্থরান কে ধর্মলিংহাম নামে এক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড গত মাসে কার্যকর হওয়ার পর পরিস্থিতি বদলে গেছে।  

আন্দোলনের শুরু
নাগেন্থরানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর সিঙ্গাপুরের সচেতন তরুণ প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়াতে কথা বলা শুরু করেছে। সিঙ্গাপুরের জন্য এটা খুব একটা স্বাভাবিক বিষয় নয়। রাজনৈতিকভাবে এ ধরনের বিরোধিতার খুব একটা সুযোগ নেই সেখানে।   

নাগেন্থরানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগের দিনগুলোতে হং লিম পার্কে প্রায় ৪০০ জন জড়ো হয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে এটা ঠেকানোর চেষ্টা করেন। এই হং লিম পার্ক হলো সিঙ্গাপুরের একমাত্র জায়গা যেখানে পুলিশের পূর্বানুমতি ছাড়াই বিক্ষোভের অনুমতি রয়েছে।

এর আগে সেখানে এই মৃত্যুদণ্ড ইস্যুতে যেসব র‌্যালি হয়েছে সেগুলোতে ৫০ জনও থাকতেন না। তবে এবারে যে প্রতিবাদটা হয়েছে সেটা যুগান্তকারী বলে মনে করছেন অ্যাক্টিভিস্টরা। 

এই প্রতিবাদের আয়োজক জুলোভান হোয়াম বিবিসিকে বলেছেন, নাগেন্থরানের ঘটনা সিঙ্গাপুরের অনেক মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে এবং সবাই এটা উপলব্ধি করেছে যে আমাদের বিচার ব্যবস্থা কতটা নির্মম। 

৪৩ গ্রাম হেরোইন উরুতে বেঁধে রাখা অভিযোগে তাকে এই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

নাগেন্থরানকে ফাঁসি দেওয়ার কয়েক মাস আগে, তার আইনজীবী এবং পরিবার তার বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা ছিল উল্লেখ করে ক্ষমা চেয়ে ও দণ্ড কমানোর জন্য আপিল করেছিলেন। দেখা গেছে, তার আইকিউ ছিল ৬৯, যা আন্তর্জাতিকভাবে ‘লার্নিং ডিজ্যাবিলিটি’র স্বীকৃতি দেয়। 

কিন্তু আদালত ওই আবেদন খারিজ করে দিয়ে বলে, অপরাধ করার সময় তিনি জেনে বুঝেই করেছেন যে তিনি কী করছেন।

সিঙ্গাপুরের জন্য এটা খুব একটা স্বাভাবিক বিষয় নয়। রাজনৈতিকভাবে এ ধরনের বিরোধিতার খুব একটা সুযোগ নেই সেখানে। 

করোনা মহামারির কারণে দু’বছর কোনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল না সিঙ্গাপুর। তখন মনে করা হয়েছিল যে নাগেন্থরানের ভাগ্য হয়তো বদলাতে পারে। 

কিন্তু ২৭ এপ্রিল তার দণ্ড কার্যকর করা হয়। 

ব্যাপক সমর্থন
সিঙ্গাপুরের বেশিরভাগ মানুষ মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে থাকলেও নাগেন্থরানের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। 
    
সিঙ্গাপুরের সরকার বলেছে যে দেশটির কঠোর মাদকবিরোধী আইন ও মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেশটিকে এশিয়ার অন্যতম নিরাপদ স্থানে পরিণত করেছে। 

নাগেন্থরানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মাত্র এক মাস আগে সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শানমুগাম সংসদে বলেছিলেন যে সিঙ্গাপুরের বেশিরভাগ মানুষ এখনও মাদক পাচারের উপযুক্ত শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন করেন। ২০২১ সালের একটি জরিপের কথা উল্লেখ করে কথাগুলো বলছিলেন মন্ত্রী। 

তবে তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে সিঙ্গাপুরের তরুণদের মধ্যে মাদক ব্যবসায়ীদের মৃত্যুদণ্ডের সমর্থন, পুরো দেশের গড় সমর্থনের থেকে কম।

তান মেই কিয়ানের পোস্টের নিচে একজন মন্তব্য করেছেন, হাস্যকর। একজন মাদকাসক্ত তার নিজের এবং কাছের মানুষদের কতটা ক্ষতি করে, আশা করবো, আপনাকে যেন বাস্তবে সে অভিজ্ঞতা নিতে না হয়।  

অন্য একজন মন্তব্য করেছেন: ‘মেয়েরা, অ এই অযৌক্তিক প্রচারণায় জড়িয়ে পড়ো না। মাদকে আক্রান্ত দেশ দেখতে কেমন হবে, তা তোমারা জানো না।’

তবে তান আশাবাদী। তিনি বলছেন, আমি মনে করি আমরা ভালো কিছুর দিকে এগোচ্ছি। কারণ এটা নিয়ে আগের চেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। 

এদিকে যেসব পরিবারের কোনো সদস্য মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে কারাগারে আছেন, মানুষের ক্রমবর্ধমান এই সচেতনতায় তারা একটা আশা দেখছেন। 

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সিঙ্গাপুরে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে আসছেন কার্স্টেন হান। তিনি বলেন, হং লিম পার্কে আন্দোলন দেখার পর দাচিনার পরিবার পুরো বিষয়টাতে নতুন করে শক্তি পেয়েছেন।  

নাগেন্থরানের মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে বিক্ষোভ হয়েছে

নাগেন্থরানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর এর নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ, ইইউ প্রতিনিধি এবং ধনকুবের রিচার্ড ব্র্যানসন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো এটাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে।

পননির সেলভাম প্রান্থমান নামে আরও এক যুবক মৃত্যুদণ্ডের রায় মাথায় নিয়ে দণ্ড কার্যকরের শঙ্কায় আছেন। তবে তার বোন অ্যাঞ্জেলিয়া প্রন্থমান বলেন, প্রথমবারের মতো আমি মানুষকে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলতে দেখেছি৷ নাগেন্থরানের ঘটনার পর সোশ্যাল মিডিয়াতে সর্বস্তরের মানুষ এর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। 

সিঙ্গাপুরে বর্তমানে ৬০ জনের মাথায় মৃত্যুদণ্ডের বোঝা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। 

মৃত্যুদণ্ডের কোনো কোনো রায় নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, যে মহামারি চলাকালে সিঙ্গাপুরে ১০টি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে একটি জুমের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল এবং আটটি ছিল মাদক অপরাধের জন্য।

সিঙ্গাপুর বিশ্বের কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি যেখানে মাদক সংক্রান্ত অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আইন রয়েছে এবং  কেউ ১৫ গ্রামের বেশি হেরোইনসহ ধরা পড়লে তার সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড।  

বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর ব্যতিক্রম।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে এশিয়ার অবস্থান সবার শীর্ষে।

চীন প্রতি বছর হাজারো মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেয় বলে মনে করা হয়। তবে সরকারি পরিসংখ্যানে এ সংখ্যা অনেক কম দেখানো হয়। 
 
মাদক চোরাচালানের অপরাধে ইন্দোনেশিয়ায় নিয়মিত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।  তবে ২০১৬ সাল থেকে তারা কোনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেনি।

সিঙ্গাপুরের প্রতিবেশী মালয়েশিয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে এবং আইন পরিবর্তন করেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ, ফিলিপাইন, মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডে আর মৃত্যুদণ্ড নেই। 

এনএফ