ছবি: গ্লোবাল টাইমস

পাকিস্তানে অবস্থানরত নাগরিকদের নিরাপত্তায় নিজেদের নিরাপত্তা কোম্পনিকে সেখানে নিয়োগ দিতে চাইছে চীন। চলতি বছর পাকিস্তানে বসবাসরত চীনা স্থাপনা ও নাগরিকদের ওপর কয়েক দফা হামলার পর এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম অর্থনীতির এ দেশটি।

এ বিষয়ে পাকিস্তানের সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও করছে চীনের দূতাবাস ও দেশটির সরকারে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

তবে পাকিস্তানের সরকার এতে আপত্তি জানিয়েছে। এমনকি গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পাক সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে চীনের দূতাবাস ও দেশটির কর্মকর্তাদের নিয়মিত যোগাযোগ ও দেন-দরবারেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।

বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানে নিযুক্ত চীনের দূতাবাস ও পাকিস্তান সরকারের উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল জাপানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নিক্কি এশিয়া। কিন্তু কোনো পক্ষই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে সম্মত হয়নি।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের সরকারের আশঙ্কা, চীনের এই অনুরোধ মেনে নিলে, অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরে কোনো চীনা নিরাপত্তা কোম্পানিকে অবাধ প্রবেশাধিকার দেওয়া হলে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারে।

তাছাড়া, চীনের এই অনুরোধ মেনে নিলে পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের মধ্যে চীনের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির শঙ্কাও রয়েছে। পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাধী ও কট্টরপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠী যদি জনগণের এই মনোভাবকে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উপায় হিসেবে ব্যবহার শুরু করে, তাহলে এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত পাকিস্তানের নাজুক রাজনীতি আরও টালমাটাল হয়ে উঠবে।  

তবে চীনের এই অনুরোধকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। কারণ গত বছর পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় শহর দাসুতে চীনের মেগা প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোডস ইনিশিয়েটিভসের আওতাধীন একটি স্থাপনায় সন্ত্রাসী হামলা হয়। ওই হামলায় নিহত হন ১০ জন চীনা নাগরিক।

চলতি বছর করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফুসিয়াস সেন্টারে হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বালুচ লিবারেশন আর্মি। সেই হামলায় নিহত হয়েছেন তিন চীনা নাগরিক।

এছাড়া পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় চীনের স্থাপনা ও নাগরিকদের ওপর হামলায় গত দুই বছরে ২০ জনেরও বেশি চীনা নাগরিক নিহত হয়েছেন।

২০১৩ সালে নিজেদের মেগা প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ শুরু করে চীন। এই প্রকল্পের আওতায় পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের কাজ চলছে। সড়ক নির্মাণের পাশপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাঁধ প্রভৃতি স্থাপনাও পাকিস্তানে নির্মাণ করা হচ্ছে এই প্রকল্পের আওতায়।

জাপানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নিক্কি এশিয়াকে পাকিস্তান সরকারের দুইজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সর্বশেষ গত জুন মাসের প্রথম দিকে চীনের সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে ফের চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য চীনভিত্তিক নিরাপত্তা সংস্থা নিয়োগের অনুমতি দিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে, কিন্তু পাক সরকার এখন পর্যন্ত তার উত্তর দেয়নি।

জার্মান থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান মের্কেটর ইনস্টিটিউট ফর চায়না স্টাডিজ সম্প্রতি ‘গার্ডিয়ান অব দ্য বেল্ট অ্যান্ড রোড’ নামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, চীনে ৫ হাজারেরও বেশি বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানি রয়েছে এবং এসব কোম্পানির মধ্যে অন্তত ২০টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করার জন্য উপযুক্ত।

গত মে মাসে চীন সফরে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। সেখানে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক হয় তার এবং বৈঠক শেষে চীনের পররাষ্টমন্ত্রী ওয়াং ই এবং বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘পাকিস্তানে অবস্থান রাত চীনা নাগরিকদের পূর্ণ নিরাপত্তা ও সুরক্ষা প্রদানের বিষয়ে দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তাকে চীন অভিনন্দন জানাচ্ছে।’

‘এবং উভয় দেশের মধ্যকার যে ঐকমত্য, তা দুই দেশের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান ও সামরিক সহযোগিতাকে আরও সুগম ও শক্তিশালী করবে।’

তবে একাধিক আন্তর্জাতিক থিঙ্কট্যাংক সংস্থা জানিয়েছেন, পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর ‘ভরসা’ নেই চীনের। সিঙ্গাপুরভিত্তিক থিংকট্যাংক সংস্থা এস. রাজারাত্নাম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ ফেলো জেমস ডরসি নিক্কি এশিয়াকে বলেন, ‘বিষয়টি বেশ জটিল। পাকিস্তানে চীনবিরোধী মনোভাব দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। বিশেষ করে বেলুচিস্তানের জনগণের আশঙ্কা, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভসের মাধ্যমে চীন আসলে পাকিস্তানের ভূখণ্ড দখল করতে যাচ্ছে এবং এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে নিজ ভূখণ্ডেই শরণার্থী হয়ে পড়বে তারা। তাছাড়া পাকিস্তানের বিভিন্ন কট্টরপন্থী গোষ্ঠীও দেশের ভেতরে চীনের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে।’

‘এই পরিস্থিতিতে তাই চীনের কোনো বেসরকারি কোম্পানিকে পাকিস্তানে অবাধ চলাচলের অনুমতি দিলে পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ বিষয়টিকে নিজেদের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হিসেবে দেখবে। পাকিস্তান সরকার এই ঝুঁকি নিতে চাইছে না।’

‘আবার চীনের এই চাহিদারও ভিত্তি রয়েছে। কারণ একদিকে পাকিস্তানের দক্ষিণে চীনের প্রকল্পকাজে বাধা দিচ্ছে বালুচ ন্যাশনাল আর্মি এবং উত্তরে বাধা দিচ্ছে কট্টরপন্থী ইসলামি দলগুলো। বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিকও নিহত হয়েছেন এর মধ্যে।

‘‍সুতরাং চীন যদি নিজের নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানে নিজেদের কোম্পানির ওপর আস্থা রাখতে চায়, সেটি অযৌক্তিক নয়।’

এদিকে, চরম আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে থাকা পাকিস্তানে দিন দিন এই সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে যদি চীনের আর্থিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আক্ষরিক অর্থেই ধ্বংসের চরম সীমায় পৌঁছে যাবে দেশটি।

নিজেদের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সচল রাখতে গত শুক্রবারও চীনের কাছ থেকে ২৩০ কোটি ডলার সহায়তা নিয়েছে পাকিস্তানের সরকার।

এসএমডব্লিউ