পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুল কাদির প্যাটেল পরামর্শ দিয়েছেন যে, যারা বেশি সন্তান নিতে চান তাদের মুসলিম সংখ্যালঘু দেশগুলোতে যাওয়া উচিত। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের একটি অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের জনসংখ্যা নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এমন পরামর্শ দেন আবদুল কাদির প্যাটেল । 

জনসংখ্যা নিয়ে প্রকাশিত জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড পপুলেশন প্রসপেক্টাস ২০২২-এ বলা হয়েছে, চলতি বছরের নভেম্বর মাস নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা হবে ৮০০ কোটি।  

একই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, ভারত আগামী বছর সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশের তালিকায় শীর্ষে থাকবে এবং চীন দ্বিতীয় স্থানে থাকবে। আর ২০৫০ সালে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ৩৬ কোটির বেশি হবে।   

এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তানে জনসংখ্যা ইস্যুতে এত উদ্বেগ কেন? 

পাকিস্তানের সংসদ সদস্য সামিনা মমতাজ জাহারি এক অনুষ্ঠানে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। সামিনা বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টির (বিএপি) সদস্য। 

তিনি বলছেন, পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আয়তনের দিক থেকে পাকিস্তান বিশ্বের ৩৩তম বৃহত্তম দেশ কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম দেশ। পাকিস্তানে সম্পদের বিশাল ঘাটতি রয়েছে। দেশের সব নাগরিক এ সম্পদ ব্যবহার করতে পারছেন না। 

আরও পড়ুন : বিয়ে হচ্ছে না মেয়েদের, ঝুপড়ি ঘরে ১০ সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা নিয়ে একই উদ্বেগ পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যেও দৃশ্যমান। 

আবদুল কাদির বলেন, পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে সাড়ে ২৮ কোটি হবে, যা উদ্বেগজনক। আমরা আল্লাহর সৃষ্টি মানুষ কমানোর চেষ্টা করছি না, আমরা মুসলমানদের কমানোর চেষ্টা করছি না। আমরা মুসলমানদের আরও ভালো করতে চাই। আমরা মুসলিমদের শিক্ষিত ও সুস্থ করতে চাই। 

তিনি আরও বলেন, কেউ কেউ আমাদের সাথে একমত নয়, যারা বলে যে আল্লাহ দিচ্ছেন এবং আমরা তা বাড়িয়ে দিচ্ছি... তাই আমি বলেছিলাম যে আপনি এমন একটি দেশে যান যেখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু। এখানে তো এমনিতেই মুসলমানের সংখ্যা অনেক। 

আরও পড়ুন : দুই সন্তানেই ‘ফুলস্টপ’ দিচ্ছেন ৭৯ শতাংশ মা

পাকিস্তানে ব্রিটিশ হাইকমিশনার ক্রিশ্চিয়ান টার্নারও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে আগামী ৩০ বছরে পাকিস্তানের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে, যা দেশের সম্পদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে।  

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ঠেকাতে তিনি পাকিস্তানে পরিবার পরিকল্পনা ইস্যুতে আরও সংলাপের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।  

পাকিস্তানের জনসংখ্যা
বিশ্বব্যাংকের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের জনসংখ্যা প্রায় ২২ কোটি ৫২ লাখ। এর মধ্যে ১১ কোটি ৫৮ লাখের বেশি পুরুষ আর ১০ কোটি ৯৩ লাখের বেশি নারী। 

আরও পড়ুন : জাপানে ১২১ বছরে সর্বনিম্ন জন্মহারের রেকর্ড

পাকিস্তানে প্রতি ১০০ নারীর অনুপাতে পুরুষের সংখ্যা ১০৫ জন। ১৯৫০ সালে  এই অনুপাত ছিল ১০০:১২০।  

একইসঙ্গে, চলতি বছর ভারতে প্রকাশিত ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটিতে লিঙ্গ অনুপাতের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ভারতে প্রতি ১০০ পুরুষের অনুপাতে নারীর সংখ্যা ১০২০-এ পৌঁছেছে। 

জাতিসংঘের প্রতিবেদন ‘ওয়ার্ল্ড পপুলেশন প্রসপেক্টস ২০২২’ অনুসারে, ২০৫০ সালের মধ্যে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ৫৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং ৩৬ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। 

পাকিস্তানে প্রথম আদমশুমারি হয় ১৯৯৮ সালে। সেই সময় থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের জনসংখ্যা ৫৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২১ কোটির কাছাকাছি পৌঁছেছে। 

শুধু তাই নয়, সেই সময় থেকেই ব্রাজিলকে পেছনে ফেলে বিশ্বের পঞ্চম জনবহুল দেশে পরিণত হয়েছে পাকিস্তান। জনসংখ্যা দেশটির আগে আছে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্দোনেশিয়া। 

আরও পড়ুন : জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়

ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৩.৩ কোটি এবং তখন জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ১৪তম স্থানে ছিল। 

পাকিস্তানে প্রজনন হার
উর্বরতার হার হল সেই গুরুত্বপূর্ণ পরামিতি যার দ্বারা একটি দেশ বা রাজ্যে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে কি না তা বোঝা যায়।  

পাকিস্তানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশটিতে একজন নারী গড়ে ৩.৬টি সন্তানের জন্ম দেন। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান দ্বিতীয় জনবহুল দেশ। জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, ভারতে মোট প্রজনন হার ২.০। 

বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ কোটি প্রবীণ নাগরিক, অর্থাৎ যাদের বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৪৯ লাখ নারী। 

পাকিস্তানে চিন্তা কেন?
পাকিস্তানে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী জনসংখ্যা প্রায় পৌনে ১৪ কোটি। ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে যারা কর্মক্ষম তাদের মধ্যে মাত্র ৪৯.৪ শতাংশ আয় রোজগার আছে। অর্থাৎ কর্মক্ষম জনসংখ্যা প্রায় ৫১ শতাংশে কাজ নেই।   

আরও পড়ুন : ঢাকায় জনসংখ্যা কমানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি : মেয়র তাপস

শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে পড়া দেশের তালিকায় পাকিস্তানের অবস্থান দ্বিতীয়। 

ইউনিসেফ পাকিস্তানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানে ৫-১৬ বছর বয়সী প্রায় দুই কোটি শিশু স্কুলে যাচ্ছে না। এই বয়সী শিশুরা দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ।  

দেশের জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্পর্কে পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞ শাহিদ জাভেদ বুরকি জানাচ্ছেন কিভাবে পাকিস্তানের তরুণের সংখ্যা এত বেশি। তিনি বলছেন যে, বিশ্বের জনসংখ্যার গড় বয়স প্রায় ৩১ বছর, যার মানে জনসংখ্যার অর্ধেক তার চেয়ে কম বয়সী। আর পাকিস্তানের জনসংখ্যা গড় বয়স প্রায় ২৪ বছর।

কিন্তু জীবিকার তাগিদে পাকিস্তানের কিছু শহরের জনসংখ্যা এখন ওই শহরের জনসংখ্যার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। 

আরও পড়ুন : সাত দশকে সর্বনিম্ন জনসংখ্যা বৃদ্ধি চীনে

ডিপ্লোম্যাট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে যে কীভাবে ২০ শতাংশের বেশি পাকিস্তানি দেশের মাত্র ১০টি বড় শহরে বাস করে। করাচি এবং লাহোরে জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি।  

এনএফ