মালয়েশিয়ার সীমিত প্রতিরোধ সক্ষমতা আর সীমান্ত নিরাপত্তায় ব্যাপক বিনিয়োগের অনাগ্রহের ফলে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা অনুপ্রবেশ প্রবল বৃদ্ধি পেয়েছে। বিতর্কিত সামুদ্রিক অঞ্চলে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার তেল অনুসন্ধান এবং উত্তোলনও বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে বেইজিং।

এস. রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ইন্দোনেশিয়া প্রোগ্রামের সহযোগী গবেষণা ফেলো ইমির্জা আদি সাইলেন্দ্র বলেন, কুয়ালালামপুর এবং জাকার্তা যতদিন বিশ্বাস করবে যে, বেইজিংকে মোকাবিলার সময় তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে, ততদিন তারা আরও সংযত পন্থা অবলম্বন করবে।

তাদের এই নৃত্যটি কিছুটা গতিশীল এবং এর নিয়মগুলো ধারাবাহিকভাবে আলোচিত হয়। চীন চাপ অব্যাহত রাখবে আর মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া প্রতিবাদ জানাবে। আর এটা এমন একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আপাতদৃষ্টিতে যা উভয় দেশ প্রতিবেশী এক দানবের পাশে বাস করার বাস্তবতা হিসাবে মেনে নিয়েছে।

চীনের সামুদ্রিক অনুপ্রবেশ মোকাবিলার বিকল্প উপায়ও মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার আছে। এসব বিকল্পের মধ্যে রয়েছে আইনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ থেকে শুরু করে বেইজিংয়ের ভারসাম্য রক্ষায় বাহ্যিক শক্তিকে কাজে লাগানো। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া ওই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়াকে এই দ্বন্দ্বে না জড়ানোর অনুরোধ করেছে। কারণ চীনের উপকূলরক্ষী বাহিনী (সিসিজি) এবং মালয়েশিয়ার রাজকীয় নৌবাহিনী (আরএমএন) ২০২০ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ চীন সাগরের পশ্চিম ক্যাপেলা এলাকায় সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল।

এখানে মূল সংকট যদি মালয়েশিয়া এবং চীনের শক্তির বৈষম্য হয়, তাহলে কুয়ালালামপুরকে অন্যান্য বহিরাগত শক্তির সাহায্য নিয়ে চীনের হয়রানি প্রতিরোধ করা উচিত।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ডিপ্লোম্যাট বলেছে, গত কয়েক বছরে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত এলাকায় চীনের উপকূলরক্ষী বাহিনীর জাহাজের বারবার অনুপ্রবেশ দেখেছে। মালয়েশিয়ার সাবাহ ও সারাওয়াক উপকূলে এবং ইন্দোনেশিয়ার নাতুনা দ্বীপপুঞ্জের উত্তরে চীনের সঙ্গে জলসীমা রয়েছে। আর এই দুটি অঞ্চলকে বেইজিং ‘নাইন-ড্যাশ লাইন’র মাধ্যমে বিভক্ত করেছে; যেটিকে ২০০৯ সাল থেকে জলসীমায় মালিকানাসহ একচেটিয়া সামুদ্রিক এখতিয়ারের দাবি করছে বেইজিং।

সিসিজির দখলদারিত্বের তীব্রতা সারাওয়াক উপকূলের সেন্ট্রাল লুসোনিয়ায় অবস্থিত কাসাওয়ারিতে (২০১১ সালে) এবং নাতুনার উত্তর অংশে অবস্থিত টুনা ব্লকে (২০১৪ সালে) তেলক্ষেত্র আবিষ্কার হওয়ার পর জোরাল হয়েছে।

মহাদেশীয় সমুদ্রের এই তলদেশে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া তেল অনুসন্ধান এবং উত্তোলন করতে পারবে না বলে দাবি জানিয়ে আসছে বেইজিং। মালয়েশিয়ার রাজকীয় নৌবাহিনী ও ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী (টিএনআই-এএল) চীনা জাহাজের অনুপ্রবেশ ঠেকানো এবং ওই এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করার পরিবর্তে ‘ছায়া দিয়ে’ জবাব দেওয়ার পন্থা বেছে নিয়েছে।

ডিপ্লোম্যাট বলছে, কুয়ালালামপুর এবং জাকার্তা কীভাবে বেইজিংয়ের শক্তির বিষয়ে ঝুঁকির হিসেব-নিকেশ করে তা এই নীতির চর্চার মাধ্যমে বোঝা যায়। ছায়াদানের নিয়মটি অনেকটা চক্রাকার নৃত্যের মতো: যখন চীনের জাহাজ এগিয়ে আসে, তখন মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার জাহাজ পিছিয়ে যায়। কখনও কখনও এর বিপরীত দিকে যায়।

এই ইঁদুর-বিড়াল দৌড়ের নীতিটি একেবারে সাধারণ: সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর অব স্ট্র্যাটেজি বলেছেন, ‘প্রথমে উত্তেজনা বাড়ানো যাবে না।’ প্রত্যেকের সংযত থাকা ও উত্তেজনা না বাড়ানোর নীতির ফলে চীনের উপকূলরক্ষী বাহিনীর জাহাজগুলো মালয়েশিয়া অথবা ইন্দোনেশিয়ার জাহাজের প্রতিরোধের মুখোমুখি না হওয়ার আশ্বাস পায়। আর সেই সুযোগে দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত এলাকায় অবস্থান করতে পারছে চীনারা।

মালয়েশিয়া আইনিভাবে নিজের অবস্থান রক্ষায় ব্যর্থ হলে দেশটির নীতি নির্ধারকদের চীনা আধিপত্যের ভয় প্রশমিত হবে না। এসব থেকে ধারণা করা যায়, দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের উপস্থিতি অবশ্যই সহ্য করা উচিত বলে মনে করে মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ার চূড়ান্তসীমা হলো সাগরের সম্পদ আহরণে শরীরী বাধা না পাওয়া পর্যন্ত সব সহ্য করে যাওয়া।

গত বছরের আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝে ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর কাছ থেকে রক্ষায় নিজেদের জরিপকারী জাহাজ হাইয়াং ডিঝিকে সামরিক এসকর্ট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় চীন। সেই সময় জাকার্তার অনেক নীতিনির্ধারক বেইজিংয়ের এই সিদ্ধান্তকে সংযত থাকার পদক্ষেপ বলে মনে করেন। যদিও সাগরে বেইজিংয়ের মালিকানার দাবির পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা চীনের কম। জাকার্তাও তার নিজের আইনি অবস্থান নিয়ে যথেষ্ট নিরাপদ রয়েছে।

দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, জাকার্তা এবং কুয়ালালামপুরের ধারণা— বেইজিং কেবল উসকানি পেলেই উত্তেজনা বাড়ায়। আর এই বিশ্বাস অনন্য এবং এটি ব্যাপকভাবে ভাগাভাগিও করা হয় না। কারণ অনেক হিসেব-নিকেশ থেকে এমন উপলব্ধি তৈরি হয়েছে যে, চীনের দৃঢ় পদক্ষেপ দক্ষিণ চীন সাগরে একটি দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারে।

বেইজিং মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার বেঁধে দেওয়া রেডলাইন অতিক্রম করলেও উভয় দেশ আত্মবিশ্বাসী, তাদের দাবির বৈধতা বিতর্কহীন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের পাশে আছে। সম্পর্কের বাজিতে কুয়ালালামপুর এবং জাকার্তার ধারণা, চীন গত কয়েক দশক ধরে তাদের দেশে এত বেশি বিনিয়োগ করেছে যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হয়তো নষ্ট করবে না বেইজিং।

সূত্র: দ্য ডিপ্লোম্যাট।

এসএস