রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রয়াণের পর যুক্তরাজ্যের অঘোষিত রাজা এখন প্রিন্স চার্লস। রাজপরিবারের ঐতিহ্য অনুযায়ী, রানির মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা বা তার কমবেশি কিছু সময়ের মধ্যে নতুন রাজা মনোনীত করতে হবে। সেই অনুযায়ী শনিবারই দেশের রাজা হিসেবে ঘোষণা করা হবে চার্লসের নাম।

শনিবার ব্রিটেনের রাজ সিংহাসনে আনুষ্ঠানিকভাবে আরোহনের পর রাজা তৃতীয় চার্লস হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পাশাপাশি  যুক্তরাজ্যে ও কমনওয়েলথভুক্ত ১৪টি দেশেরও রাষ্ট্রপ্রধান হবেন চার্লস।

কিন্তু মানুষ হিসেবে কেমন তিনি? ব্রিটেনের জনগণের কাছে তার জনপ্রিয়তা কতখানি? জাতির প্রত্যাশা কি পূরণ করতে পারবেন চার্লস?

ব্রিটেনের, সিংহাসনে আরোহনের পর যিনি দ্বিতীয় এলিজাবেথ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া রানি এলিজাবেথ আলেক্সান্দ্রা মেরি উইন্ডসর ও প্রিন্স ফিলিপ দম্পতির জেষ্ঠ্য সন্তান চার্লসের পুরো নাম চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জ উইন্ডসর। ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর জন্ম হয় চার্লসের। পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ায়, বিষয় ছিল প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব এবং ইতিহাস।

পড়াশোনা শেষে গত শতকের ষাটের দশকের শেষ দিকে রাজপরিবারের প্রথা অনুযায়ী যুক্তরাজ্যের সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন চার্লস এবং পাইলট হিসেবে দশ বছর দেশের বিমান বাহিনীতে কাজ করেন।

সামরিক দায়িত্ব থেকে অবসর নেওয়ার পর ১৯৮১ সালে লেডি ডায়ানা স্পেনসারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন চার্লস। ওই সময় চার্লসের বয়স ছিল ৩০ বছর, আর ১৯ বছর বয়সী ডায়ানা ছিলেন যুক্তরাজ্যের একটি নার্সারি স্কুলের শিক্ষিকা।

ডায়ানা-চার্লস দম্পতি

১৯৮১ সালে যখন তাদের বিয়ে হয়, সেই বিয়ের অনুষ্ঠান বিভিন্ন দেশের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল এবং তা দেখেছিল বিশ্বের প্রায় ৮০ কোটি মানুষ। বিয়ের পরের বছরই প্রথম সন্তান প্রিন্স উইলিয়ামের মুখ দেখেন এই দম্পতি, তার দু’বছর পর ১৯৮৪ সালে জন্ম নেয় তাদের দ্বিতীয় সন্তান প্রিন্স হ্যারি।

রাজপরিবার ও চার্লসের সঙ্গে ঘনিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, চার্লস বরাবরই স্পর্ষকাতর স্বভাবের মানুষ। ছবি আঁকা ও বাগান করা তার প্রিয় শখ। ওয়াটার কালার পেইন্টিংয়ে রীতিমতো দক্ষ তিনি। সেই সঙ্গে অর্গানিক বাগান করার দিকেও ঝোঁক আছে তার।

চার্লস যখন তরুণ ছিলেন, সে সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল না তার। পরে সময় অবশ্য ধীরে ধীরে বাবা-মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের উন্নতি হয়।

যুক্তরাজ্যের এই ৭৩ বছর বয়সী রাজা তার জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিতর্কের মুখে পড়েছেন। সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছে- প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক থাকা অবস্থায় বান্ধবী ক্যামিলা পার্কার বৌলসের সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত প্রেম এবং তার ফলে ডায়ানার সঙ্গে টানাপোড়েন, পৃথক বসবাস (সেপারেশন) এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে বিবাহবিচ্ছেদ।

রাজপরিবার ও যুক্তরাজ্যের জনগণের একটি বড় অংশ ডায়ানা-চার্লসের বিবাহবিচ্ছেদ এবং ক্যামিলার সঙ্গে চার্লসের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি। পরিস্থিতি আরও জটিল হয় ১৯৯৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ডায়ানার মৃত্যুর পর। ব্রিটেনের মিডিয়া ও জনগণের একাংশের দৃষ্টিতে রীতিমতো ‘ভিলেনে’ পরিণত হন চার্লস ও ক্যামিলা।

সার্বিক পরিস্থিতি ‘ঠাণ্ডা’ হওয়ার পর ২০০৫ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন চার্লস-ক্যামিলা দম্পতি।

শান্ত গৃহী ভাবমূর্তি

প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্কে টানাপোড়েন ও বিবাহবিচ্ছেদের জেরে চার্লসের যে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল, কাল পরিক্রমায় ইতোমধ্যে তা অনেকটাই কেটে গেছে। ব্রিটেনের সাধারণ জনগণের প্রত্যাশাও তৈরি হয়েছে তার প্রতি।

যুক্তরাজ্যের রাজ পরিবারের গবেষক ও লেখক আনা পাস্টারনাক আল জাজিরাকে বলেন, ‘চার্লসের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো— তার মধ্যে স্থিতিশীলতা, নিরপেক্ষতার অভাব রয়েছে। তবে তিনি রাজনৈতিকভাবে তার মায়ের চেয়ে খোলামেলা, অধিকতর আধুনিক এবং প্রগতিশীল।

আরেক বিশেষজ্ঞ ও ল্যাংকাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক লরা ক্ল্যানসি বলেন, ‘বর্তমানে তার ভাবমূর্তি পরিবারের বয়োজেষ্ঠ্য ব্যক্তির মতো, যিনি সবসময় তার সন্তান, নাতি-নাতনি ও প্রিয়জনদের সঙ্গে পরিবেষ্টিত থাকতে চান এবং বাগান করা, গৃহপালিত পশু-পাখির যত্ন নেওয়া যার শখ।’

‘এক কথায়, সত্তোরোর্ধ এই মানুষটি এখন দাদু, ঠিক তার মায়ের মতোই।’

সূত্র : আল জাজিরা

এসএমডব্লিউ