ছবি: ইউরোপিয়ান টাইমস

পাকিস্তান সরকারের দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে ইরানের সঙ্গে পাইপলাইনের মাধ্যমে দেশটির গ্যাস বিনিময় সংক্রান্ত একটি প্রকল্প গত ৯ বছর ধরে ঝুলে আছে। ২০১৩ সালে প্রকল্পের পাইপলাইন নির্মাণ শেষে ইরান থেকে পাকিস্তানে গ্যাস সরবরাহের চুক্তি হলেও এখন পর্যন্ত সেটি নির্মাণের কাজই শেষ হয়নি।

এবং এই প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ার দায়ও নেয়নি পাকিস্তান। দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এই প্রকল্পের কাজ।

তবে সরকারের অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, পাকিস্তানের বর্তমান সরকার ইরানের গ্যাস কেনার চেয়ে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানিতে অধিক আগ্রহী।

২০০৯ সালে গ্যাস এক্সচেঞ্জ পারচেজ এগ্রিমেন্ট (জিএসপিএ) নামের এই প্রকল্প চুক্তি স্বাক্ষর করেন দুই দেশের সরকারের প্রতিনিধিরা। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ২ হাজার ৭৭৫ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে ইরান থেকে সরাসরি গ্যাস সরবরাহ করা হবে পাকিস্তানে। পাইপলাইন নির্মাণবাবদ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭৫০ কোটি ডলার এবং দুই দেশের সরকারের যৌথ অর্থায়নে এই পাইপ লাইন নির্মাণের কথা ছিল।

২০১৩ সালের মধ্যে পাইপলাইন নির্মানের কাজ শেষে পাকিস্তানে গ্যাস সরবরাহের কথাও ছিল ইরানের; কিন্তু ইরান তার অংশের পাইপলাইনের কাজ ২০১১ সালের মধ্যে শেষ করলেও নিজের অংশের পাইপলাইন নির্মাণের কাজ এখনও শেষ করতে পারেনি পাকিস্তান।

কাজ এগিয়ে নিতে ২০১৩ সালে পাকিস্তানকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের প্রস্তাবও দিয়েছিল ইরানের সরকার। তবে পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার সেই প্রস্তাবে সায় না দিয়ে জানিয়েছে, ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় বাধা এবং যদি পাকিস্তান এই প্রকল্পের কাজে হাত দেয়, সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের রোষাণলে পড়তে হবে দেশটির সরকারকে।

এই পরিস্থিতি আর কোনো পথ না থাকায় ২০১৯ সালে পাকিস্তানের সরকারকে পর পর দু’টি ‘সেলার টারমিনেশন’ নোটিশ জারি করে পাকিস্তানের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করে ইরান। যদি ক্ষতিপূরণ না দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্কবার্তাও দেওয়া হয় পাকিস্তান সরকারকে।

তারপর ওই বছর এপ্রিল মাসে ইরান সফরে যান পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। সেই সফরে গিয়ে ইরান সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণের জন্য আরও সময় চান তিনি। ইমরানের অনুরোধে ইরানের জ্বালানি মন্ত্রনালয় পাকিস্তানকে ক্ষতিপূরণ দিতে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দেয়।

চলতি ২০২১ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে বিরোধী সদস্যদের অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারিয়ে ইমরান খান বর্তমানে দেশটির প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা; আর সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা শেহবাজ শেরিফ পাকিস্তানে বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী।

তবে সরকারের পরিবর্তন হলেও এই ইস্যুতে পাকিস্তানের গড়িমসিপূর্ণ অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। দেশটির সরকারি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার এই প্রকল্পকে ‘মেয়াদোত্তীর্ণ’ ও ‘ত্রুটিযুক্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করে ক্ষতিপূরণের দায় এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। এ বিষয়ে ইরানের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও দ্বারস্থ হয়েছে পাকিস্তানের জ্বালানি মন্ত্রণালয়।

পাকিস্তানের বড় দুশ্চিন্তার কারণ হলো জিএসপিএ চুক্তির গঠন। ফরাসি আইনের ভিত্তিতে লিখিত এই চুক্তিতে বলা হয়েছে, কোনো অংশীদার যদি অপর অংশীদারকে ‘সেলার টারমিনেশন’ নোটিশ জারি করে ক্ষতিপূরণ দাবি করে, সেক্ষেত্রে নোটিশদাতা অংশীদার মাত্র একবার অপর অংশীদারকে ক্ষতিপূরণ পরিশোধের জন্য বাড়তি সময় দিতে পারবে।

অর্থাৎ পাকিস্তান যদি ২০২৪ সালের মধ্যে ইরানকে ক্ষতিপূরণ দিতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী চাইলেও আর সময় বাড়াতে পারবে না ইরান এবং তখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না দেশটির।

চলতি বছর জুনে ইরান সফরে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। সেখানে ইরানের জ্বালানিসম্পদমন্ত্রী জাভেদ ওউজির সঙ্গে তার বৈঠক হয়। বৈঠকে জাভেদ ওউজি তিক্ত অতীত পেছনে ফেলে পুনরায় প্রকল্পের কাজ শুরুর অনুরোধ জানান এবং বিলাওয়াল তাতে সম্মতিও দেন।

কিন্তু বিলাওয়াল দেশে ফেরার পর আবার সেই আগের আচরণই শুরু করে দেশটির সরকার। এখন পর্যন্ত সেই পাইপলাইন নির্মাণের কাজ শুরু করেনি পাকিস্তান এবং এবারও বিলম্বের জন্য ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের জারি করা নিষেধাজ্ঞার ওপরই দায় চাপাচ্ছে পাকিস্তান সরকার; যদিও জ্যাকোপা চুক্তি সচল করার মাধ্যমে ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তোলার ঘোষণা ইতোমধ্যে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, তবে পাকিস্তান সরকার এখনও তার অবস্থান পরিবর্তন করেনি।

এদিকে, সরকারের একটি সূত্র জানিয়েছে— পাকিস্তানের বর্তমান সরকার রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি করতে বেশি আগ্রহী। ২০১৫ সালে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পাকিস্তান থেকে গ্যাস আমদানির প্রস্তাব দিয়েছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে। দুই দেশের সরকার প্রধানের মধ্যে পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে পাকিস্তানে গ্যাস সরবরাহের বিষয়ে মৌখিক কথাবার্তাও হয়েছিল।

পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ নওয়াজেরই আপন ছোট ভাই। সম্প্রতি উজবেকিস্তানে সাংহাই কো অপরেশেন অর্গানাইজেশন (এসসিও) বৈঠকে পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেছেন শেহবাজ। বৈঠকে দুই নেতার মধ্যে গ্যাস বাণিজ্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্র: ইউরোপিয়ান টাইমস

এসএমডব্লিউ