যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন (ফাইল ছবি)

তেলের উৎপাদন কমানো নিয়ে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে চলছে টানাপোড়েন। প্রায় আট মাস ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্তকে সংশ্লিষ্ট করা হচ্ছে এবং রাশিয়ার স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলেও পশ্চিমা দেশগুলোর সন্দেহ বাড়ছে।

এই পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক পুনঃমূল্যায়ন করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১১ অক্টোবর) এই তথ্য সামনে এনেছে হোয়াইট হাউস। বুধবার (১২ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এএফপি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় আট মাস ধরে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। পূর্ব ইউরোপের এই দেশটিতে রুশ আগ্রাসনের কারণে মস্কোর বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র তেল উৎপাদন বাড়ানোর চাহিদা জানালেও সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন তেল-উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

মার্কিন মিত্র হলেও রিয়াদের এই সিদ্ধান্ত কার্যত রাশিয়ার পাশে থাকার সমান। এতে করে বাইডেন প্রশাসনে ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং সর্বশেষ সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রেসিডেন্ট বাইডেন পুনঃমূল্যায়ন করছেন বলে জানাল হোয়াইট হাউস।

গত সপ্তাহের বুধবার তেল-উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশগুলোর জোট ওপেক প্লাস দৈনিক ২০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন কমানোর ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছায়। যা ২০২০ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ। এছাড়া ওপেক প্লাসের তেল উৎপাদান কমানোর এই হার বৈশ্বিক সরবরাহের প্রায় ২ শতাংশের সমান।

এদিকে নভেম্বর থেকে প্রতিদিন ২০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন কমানোর এই সিদ্ধান্ত হোয়াইট হাউস তথা জো বাইডেনকে ক্ষুব্ধ করে। এমনকি এতে করে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বাড়তে পারে এমন আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কিরবি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, ‘আমি মনে করি প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে খুবই স্পষ্ট আছেন যে, এটি (রিয়াদ-ওয়াশিংটন) এমন একটি সম্পর্ক যা আমাদের পুনঃমূল্যায়ন চালিয়ে যেতে হবে, সময়ে সময়ে আমাদের পুনরায় পর্যালোচনা করার প্রয়োজন পড়বে।’

তার ভাষায়, ‘(পুনঃমূল্যায়ন হবে) অবশ্যই ওপেকের সিদ্ধান্তের আলোকে এবং আমি মনে করি তিনি (বাইডেন) সেখানেই আছেন।’

সৌদি ভিন্ন মতাবলম্বী সাংবাদিক এবং রাজপরিবারের কঠোর সমালোচক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডের পর সৌদি আরবকে আন্তর্জাতিকভাবে ‘প্যারিয়াহ’ বা অস্পৃশ্য রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও চলতি বছরের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সৌদি সফর করেন। এমনকি সেসময় তিনি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথেও দেখা করেছিলেন।

এদিকে নভেম্বরের আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে পেট্রোলের দাম কম রাখার আশায় ওপেকের তেল উৎপাদন কমানোর এই সিদ্ধান্ত ঠেকাতে বেশ জোরেশোরে চেষ্টা করেছিল বাইডেন প্রশাসন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে তেলের দাম বাড়লে সেটির প্রভাব নভেম্বরের নির্বাচনের ওপর পড়তে পারে এবং এতে করে কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি।

অবশ্য ওয়াশিংটন নাখোশ হলেও প্রকাশ্যেই তেল উৎপাদন কমানোর পক্ষে কথা বলছে সৌদি আরব। দেশটির দাবি, ‘টেকসই তেলের বাজার বজায় রাখাই’ ওপেক প্লাসের অগ্রাধিকার। এছাড়া মঙ্গলবার সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল-আরাবিয়া চ্যানেলকে বলেন, তেল উৎপাদন কমানোর পদক্ষেপটি ‘পুরোপুরিভাবে অর্থনৈতিক এবং (সংগঠনের) সদস্য দেশগুলো সর্বসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওপেক প্লাস সদস্যরা দায়িত্বশীলভাবে কাজ করেছে এবং যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে’। এর একদিন আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতের জ্বালানি মন্ত্রী সুহেল আল-মাজরুই বলেন, তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত ছিল ‘প্রযুক্তিগত, রাজনৈতিক নয়’।

এই পরিস্থিতিতে মার্কিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কিরবি বলছেন, (সৌদি আরবের সাথে) ‘সম্পর্ক ঠিক কিভাবে এগিয়ে নেওয়া হবে তা নির্ধারণে কংগ্রেসের সাথে কাজ করতে ইচ্ছুক’ প্রেসিডেন্ট বাইডেন। অবশ্য এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়নি বলেও স্পষ্ট করেছেন তিনি।

রয়টার্স বলছে, মার্কিন সিনেটের প্রভাবশালী বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির ডেমোক্র্যাটিক চেয়ারম্যান বব মেনেনডেজ ওয়াশিংটনকে সৌদি আরবের সাথে সব ধরনের সহযোগিতা বন্ধ করার আহ্বান জানানোর একদিন পর জন কিরবির এই মন্তব্য সামনে এসেছে।

এছাড়া গত বৃহস্পতিবার মার্কিন কংগ্রেসের তিন সদস্য ডেমোক্র্যাট দলীয় সিন ক্যাস্টেন, টম ম্যালিনোস্কি এবং সুসান ওয়াইল্ড এক যৌথ বিবৃতি দেন। সেখানে তারা বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আহ্বান সত্ত্বেও সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেলের উৎপাদন ব্যাপক পরিমাণে হ্রাসের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি শত্রুতামূলক কাজ।

তাদের যুক্তি, সৌদি এবং আমিরাতের তেল উৎপাদন হ্রাসের এই সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এই দুই দেশ যে রাশিয়ার পাশে থাকার পথ বেছে নিয়েছে তা পরিষ্কার। মূলত ওপেক প্লাস তেলের উৎপাদন কমিয়ে মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত রাশিয়ার তেল রপ্তানির আয় বাড়ানোর জন্য করা হয়েছে বলেও অভিযোগ তাদের।

টিএম