কোরীয় উপদ্বীপে উত্তর কোরিয়ার সাথে চিরবৈরী প্রতিদ্বন্দ্বীদের উত্তেজনার সময়কাল আসে এবং যায়। কিন্তু কোরীয় উপদ্বীপের পরিস্থিতি গত পাঁচ বছরের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে এবং এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে মনে হচ্ছে।

গত মাসে উত্তর কোরিয়া জাপানে একটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল; যা সেখানকার বাসিন্দাদের আশ্রয়ে যেতে বাধ্য করে। আর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের এই ঘটনা একেবারে ‘শত্রুতাপূর্ণ ও উসকানিমূলক।’

এর পাশাপাশি দেশটি আরও কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি যুদ্ধবিমান উড়িয়েছে এবং সমুদ্রে শত শত কামানের গোলা নিক্ষেপ করেছে। এসব গোলা ২০১৮ সালে দুই কোরিয়ার শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে তৈরি করা ‘সামরিক নিরাপদ অঞ্চলে’ অবতরণ করেছে। কোরীয় দ্বীপের এই দুই দেশ কৌশলগত দিক থেকে আসলে ‘যুদ্ধে লিপ্ত’ রয়েছে।

সোমবার উত্তর কোরিয়ার একটি বাণিজ্যিক জাহাজ দেশটির সমুদ্রসীমা অতিক্রম করে। এর ফলে উভয়পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। দক্ষিণ কোরিয়া বলছে, পিয়ংইয়ং ইচ্ছাকৃতভাবে অনুপ্রবেশের এই ঘটনা ঘটিয়েছে।

এসবের মাধ্যমে কিম জং উন আসলে কী করছেন? উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের প্রবণতার প্রধানত তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত— অস্ত্র প্রযুক্তির পরীক্ষা এবং উন্নয়ন, দ্বিতীয়ত— বিশ্বের (প্রাথমিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) কাছে রাজনৈতিক বার্তা প্রেরণ, তৃতীয়ত— দেশের জনগণকে প্রভাবিত এবং শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য করা।

পিয়ংইয়ংয়ের এসব পদক্ষেপের মধ্যে কোনটি ফলপ্রসূ তা বোঝা কঠিন হলেও এবার কিম জং উন কিছুটা পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়েছেন। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমের একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি যেসব ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ এবং সামরিক মহড়া চালানো হয়েছে, সেগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের যৌথ সামরিক মহড়ার প্রতিক্রিয়া মাত্র।

কোরীয় দ্বীপে উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য শত্রুদের দায়ী করে উত্তর কোরিয়া বলেছে, তাদের উৎক্ষেপণের পরিষ্কার সতর্কবার্তা হচ্ছে, শত্রুদের থামতে হবে।

উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হামলার জন্য ওয়াশিংটন, সিউল এবং টোকিও যে প্রস্তুত রয়েছে তা দেখাতেই তারা গত দুই মাস ধরে পৃথক এবং যৌথভাবে বড় আকারের সামরিক মহড়া চালিয়েছে। আর এসব মহড়া যে কিম জং উনকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে, সেটি নিয়ে সন্দেহ নেই। কারণ তিনি এ ধরনের মহড়াকে সবসময়ই শত্রুদের আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে দেখে থাকেন।

শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষার লক্ষ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি শুরু করেছিল উত্তর কোরিয়া। কিন্তু কিম জং উন যে এখন চাপ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এটি করছেন তা সামান্য হলেও পরিষ্কার। কেউ কেউ ধারণা করছেন, আরও বেশি উসকানিমূলক পরীক্ষা— আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণ অথবা দক্ষিণ কোরিয়ায় ছোট আকারের আক্রমণ চালানোর জন্যও ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হতে পারে।

গত বছর উত্তর কোরিয়ার এই নেতা আগামী পাঁচ বছরের একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিলেন। এর মধ্যে তিনি যেসব নতুন অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করছেন তার বিশদ বিবরণ ছিল। এই পরিকল্পনায় তুলনামূলক ছোট যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য পারমাণবিক বোমা এবং সেগুলো বহন করার জন্য স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

উত্তর কোরিয়ার সাম্প্রতিক অস্ত্রের পরীক্ষায় কিম যে শুধুমাত্র অস্ত্র তৈরির ইচ্ছার তালিকা বাস্তবায়নে কাজ করছেন না, বরং সৈন্যদের সেসব অস্ত্র ব্যবহারেরও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, তা প্রমাণ করে। দক্ষিণ কোরিয়ায় পারমাণবিক হামলার আদলে সম্প্রতি কয়েকটি মহড়াও করেছে উত্তর কোরিয়া।

এখন বিশ্বের মনোযোগ দরকার কিমের। আন্তর্জাতিক কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তিনি যে অগ্রগতি করেছেন তা বিশ্বকে দেখানো দরকার তার। আর এসব নিষেধাজ্ঞা উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র তৈরি রোধ করতে পারেনি। অস্ত্র তৈরির লাগাম টানার লক্ষ্যে যেভাবে নিষেধাজ্ঞার ছক আঁকা হয়েছিল, সেভাবে কাজ করেনি। তবে নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশটির অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পিয়ংইয়ংয়ের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা হ্রাসের লক্ষ্যে শুরু হওয়া আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে থমকে আছে এবং বৈশ্বিক এজেন্ডা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে উত্তর কোরিয়া। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং কর্তৃত্ববাদী চীনের উত্থানে বিশ্ব অনেক বেশি উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অবস্থান হল, উত্তর কোরিয়া তার সব পারমাণবিক অস্ত্র পরিত্যাগ করতে রাজি হলেই কেবল নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হতে পারে।

ওয়াশিংটন এবং সিউল সামরিক মহড়ার মাধ্যমে কোরীয় দ্বীপের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারে রাজি হয়েছে। যা পিয়ংইয়ং ঘৃণা করে এবং শক্তিপ্রদর্শনের মাধ্যমে উসকানির জবাব দিচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার সর্বশেষ কয়েক দফার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ও সামরিক মহড়ার পর দক্ষিণ কোরিয়া যুদ্ধবিমান মোতায়েন এবং কামানের গুলি ছুড়েছে।

এখন কিম জং উন যদি নিজের অনুকূল শর্তে যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনায় ব্সাতে বাধ্য করতে চান, তাহলে উত্তর কোরিয়া আসলে কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে সেটি তাকে অবশ্যই প্রমাণ করে দেখাতে হবে। গত মাসে উত্তর কোরিয়াকে ‘পারমাণবিক অস্ত্রধারী’ দেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন কিম জং উন। আর রাষ্ট্রীয় এই তকমা একেবারে ‌‘অপরিবর্তনীয়’ বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপদেষ্টা কিম জং ডায়ে বলেছেন, উত্তর কোরিয়া কতটা দৃঢ়চিত্তের হয়ে উঠেছে তা নিয়ে আমাদের চিন্তিত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, অতীতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর মহড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বিরত থাকতো উত্তর কোরিয়া। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্রের মহড়া চলাকালীন সাগরে গোলাবারুদ নিক্ষেপ করছে দেশটি।

তিনি বলেন, উত্তর কোরিয়ার এমন স্পর্ধা ও আগ্রাসন আমরা আগে কখনও দেখিনি। এটি একেবারে ভিন্ন। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক রাষ্ট্রের মতোই কাজ করছে।

উত্তর কোরিয়ার সপ্তম পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার প্রস্তুতি শেষ এবং দেশটি এই কাজের জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক মুহূর্তের অপেক্ষা করছে বলে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের ধারণা। চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলন এখন শেষ হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার জন্য একটি আকাঙ্ক্ষিত পথ খুলে যেতে পারে।

দক্ষিণ কোরিয়া আরও একটি যুদ্ধের খেলার মাঝে রয়েছে; যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যোগ দেওয়ার জন্য আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। আর এই যুদ্ধ কিম জং উনকে সেই মওকা এনে দিতে পারে যার জন্য তিনি অপেক্ষা করছেন।

• বিবিসির জ্যঁ ম্যাকেঞ্জির নিবন্ধ অবলম্বনে।

এসএস