২০১৭ সালে পুরো বছরজুড়ে যত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল উত্তর কোরিয়া, তার চেয়েও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র গত ২৪ ঘণ্টায় ছুড়েছে দেশটি। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যাপক বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিলেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন।

কিন্তু কেন এবার রেকর্ড-ভাঙা অস্ত্রের পরীক্ষা চালাচ্ছেন উত্তর কোরিয়ার এই নেতা? বিশ্লেষকরা অবশ্য কোরীয় দ্বীপে দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক মহড়াকে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে হাজির করেছেন। একই সঙ্গে উত্তর কোরিয়া আরেকটি পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন তারা।

আসলে কোরীয় দ্বীপে কী ঘটছে তা জানার চেষ্টা করছে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি।

কিসের মহড়া?

সিউল এবং ওয়াশিংটন তাদের এযাবৎকালের বৃৃহত্তম যৌথ আকাশ প্রতিরক্ষা মহড়া শুরু করেছে। ‘ভিজিল্যান্ট স্টর্ম’ নামের এই মহড়ায় দুই দেশের শত শত যুদ্ধবিমান প্রতীকী লক্ষ্যে টানা ২৪ ঘণ্টা আক্রমণ চালাচ্ছে।

আরও পড়ুন: কোরীয় দ্বীপে আরেকটি যুদ্ধের ডামাডোল বাজছে?

এই মহড়া আগামী শুক্রবার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন তা বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার বিমান বাহিনী। তারা বলেছে, উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসনের মুখে অভেদ্য যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা বজায় রাখার স্বার্থে মহড়া চলবে।

দক্ষিণের বিমান বাহিনী বলেছে, বার্ষিক এই মহড়া আয়োজনে কয়েক মাসের পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি লেগেছে। এ বছরের মহড়ায় দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ২৪০টি যুদ্ধবিমান এক হাজার ৬০০ বার উড্ডয়ন করবে; যা দুই দেশের মাঝে অনুষ্ঠিত মহড়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চসংখ্যক যুদ্ধবিমানের অংশগ্রহণ।

এই মহড়া যৌথ বিমান অভিযান পরিচালনা এবং কৌশলগত ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তুলবে বলে জানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া।

মহড়া গুরুত্বপূর্ণ কেন?

মহড়ায় দক্ষিণ কোরিয়া এবং আমেরিকার উন্নত প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান এফ-৩৫এএস ও এফ-৩৫বিএস অংশ নিয়েছে। স্টিলথ এসব যুদ্ধবিমানের রাডারে ধরা পড়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক কম এবং সেভাবেই এসব বিমানের নকশা করা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকতে পারে, যা দক্ষিণ কোরিয়ার নেই। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার বিমানবাহিনী দেশটির সামরিক বাহিনীতে সবচেয়ে দুর্বল। সম্ভবত তাদের স্টিলথ যুদ্ধবিমান প্রযুক্তি মোকাবিলার সক্ষমতা নেই।

আরও পড়ুন: কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা: পাল্টাপাল্টি ১৩ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ২ দেশ

সেজং ইনস্টিটিউটের গবেষক চেয়ং সিওং-চ্যাং এএফপিকে বলেছেন, ‘উত্তর কোরিয়ার বেশিরভাগ বিমানই পুরোনো... তাদের কাছে খুব কম অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান আছে।’

‘উত্তরের কাছে বিমানের জন্য প্রয়োজনীয় তেল নেই, তাই প্রশিক্ষণও সঠিকভাবে করতে পারছে না,’ যোগ করেন তিনি।

কিমের ভয় কিসের?

বিশেষজ্ঞরা বলছে, স্টিলথ যুদ্ধবিমান।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কমান্ডোরা তথাকথিত ‘শিরচ্ছেদ স্ট্রাইক’ পরিচালনার মহড়া চালাচ্ছেন। বিদ্যুৎগতির সামরিক এই অভিযানের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতৃত্বকে অপসারণের মহড়া করা হয়।

আসান ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের গবেষক গো মায়ং হিউন বলেন, ওয়াশিংটন ও সিউলের এফ-৩৫ স্টিলথ যুদ্ধবিমানকে নিয়ে শুরু করা ‘ভিজিল্যান্ট স্টর্ম’ মহড়ার কারণে চলতি সপ্তাহে পিয়ংইয়ং আকস্মিক বিমান উড্ডয়ন করেছে। তিনি বলেন, নেতৃত্ব অপসারণের অভিযানে স্টিলথ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হতে পারে বলে বিশ্বাস করে পিয়ংইয়ং।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গত সেপ্টেম্বরে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক আইনের সংশোধনে কিম জং উন যে উদ্বিগ্ন সেবিষয়ে অতিরিক্ত লক্ষণও বোঝা যায়।

আরও পড়ুন: একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে কী অর্জন করতে চান কিম?

নতুন এই আইনে বলা হয়েছে, উত্তর কোরিয়া আত্মরক্ষার্থে প্রথমেই পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার করতে পারবে। সংশোধিত আইনের মাধ্যমে পিয়ংইয়ংয়ের সব পরমাণু অস্ত্র কিমের ‘একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে’ রাখা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কমান্ড এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যদি শত্রু শক্তির আক্রমণের কারণে বিপদে পড়ে যায়, তাহলে স্বয়ংক্রিয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে পারমাণবিক হামলা শুরু করবে পিয়ংইয়ং।

উত্তর কোরিয়া কী বলছে?

গত সোমবার কোরীয় দ্বীপে সিউল এবং ওয়াশিংটনের শুরু করা যৌথ সামরিক মহড়াকে ‘আগ্রাসী এবং উসকানিমূলক’ বলে অভিযোগ করেছে উত্তর কোরিয়া। কুয়েত আক্রমণের পর ১৯৯০-১৯৯১ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন সামরিক অভিযান অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মের নাম অনুযায়ী এই সামরিক মহড়ার নামকরণ করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনী কয়েক বছর ধরে যৌথ প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসা যৌথ মহড়া পিয়ংইয়ংকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। পিয়ংইয়ং এসব তৎপরতাকে ‘যুদ্ধের মহড়া’ হিসেবে দেখে। আমেরিকার শত্রুতাপূর্ণ নীতির জন্য প্রয়োজনীয় ‘পাল্টা ব্যবস্থা’ হিসেবে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করা হচ্ছে বলে বারবার দাবি করেছে উত্তর কোরিয়া।

বেইজিং এবং মস্কোতে পিয়ংইয়ংয়ের সমর্থকরাও এই দাবির সাথে ঐক্যমত পোষণ করে। জাতিসংঘে পিয়ংইয়ংয়ের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রচেষ্টায় বাধা দিয়েছে বেইজিং এবং মস্কো। বিভিন্ন সময়ে তারা বলেছে, ওয়াশিংটন মহড়ার মাধ্যমে উত্তর কোরিয়াকে উসকানি দিয়েছে।

আরও পড়ুন: ১৫০০ কি.মি. দূরে আঘাত হানতে পারবে কিমের নতুন মিসাইল

সিউলের ইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিফ-এরিক ইজলি বলেছেন, ‘কিন্তু কিম সরকার অবৈধ অস্ত্র দিয়ে আঞ্চলিক শান্তিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ওয়াশিংটন কোনও বিশেষ পদক্ষেপ নেয় বা না নেয় বলে নয়, বরং দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে সংশোধনবাদী লক্ষ্যের কারণে উত্তর কোরিয়া এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে।’

মহড়ায় সিউলের অংশগ্রহণ কেন?

পিয়ংইয়ংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলতি বছরের মে মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষমতায় আসেন প্রেসিডেন্ট 
ইউন সুক-ইওল। ক্ষমতায় আসার পর তিনি নাটকীয়ভাবে যৌথ মহড়া বৃদ্ধি করেছেন; যা করোনাভাইরাস মহামারীর সময় পেছানো অথবা দুর্ভাগ্যজনক কূটনীতির জন্য বিরতি দেওয়া হয়েছিল।

২০১৯ সালের আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন তার নিষিদ্ধ অস্ত্রের কর্মসূচি দ্বিগুণ করেছেন। এই সময়ে তিনি বৃহত্তর এবং আরও বিপজ্জনক অস্ত্রের পরীক্ষা বারবার চালিয়েছেন।

গত কয়েক মাস ধরে ওয়াশিংটন এবং সিউল সতর্ক করে আসছে যে, উত্তর কোরিয়ার সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা আরেকটি পারমাণবিক পরীক্ষায় রূপ নিতে পারে। আর এবার যদি পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায় উত্তর কোরিয়া, তাহলে সেটি দেশটির সপ্তম পারমাণবিক পরীক্ষা হবে।

উত্তর কোরিয়ার যেকোনও ধরনের বৈরীতা থেকে সুরক্ষার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রায় ২৭ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণের মিত্ররা বলেছে, যৌথ মহড়া তাদের প্রতিরক্ষা কৌশলের একটি অপরিহার্য অংশ।

সূত্র: এএফপি।

এসএস