রুশ বাহিনীর সর্বশেষ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর থেকে ইউক্রেনের ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় আছেন বলে অভিযোগ করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। শুক্রবার এক ভিডিওবার্তায় এ অভিযোগ জানান তিনি।

জেলেনস্কি বলেন, ‘গত দু’দিন ধরে কিয়েভসহ ইউক্রেনের অধিকাংশ অঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই। বর্তমানে ইউক্রেনে ৬০ লাখেরও বেশি বাড়িঘর বিদুৎবিহীন অবস্থায় আছে।’

এর মধ্যে রাজধানী কিয়েভ এবং ওডেসা, লভিভ, ভিনিৎসিয়া এবং দিনিপ্রোপেত্রোভস্কের অন্তত ৬ লাখ মানুষ এখনও বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন ইক্রেনের প্রেসিডেন্ট।

‘দু’দিন আগে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি ছিল। বিদুৎ সরবরাহ বিভাগের কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমরা কিছু বাড়িঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পেরেছি।’

গত বুধবার ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভসহ বিভিন্ন শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় রুশ বাহিনী। কিয়েভের অভিযোগ, এই দফার হামলায় কেবল ইউক্রেনের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাকে ‘টার্গেট’ করা হয়েছিল এবং এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ বেসামরিক ইউক্রেনীয়দের নভেম্বর মাসের হিমশীতল ঠাণ্ডায় ভোগান্তির মধ্যে ফেলা।

তবে সেই অভিযোগ নাকচ করে বৃহস্পতিবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিনের মুখপাত্র ও প্রেস সেক্রেটারি দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ইউক্রেনে অভিযানরত রুশ সেনাদের কেবল দেশটির সামরিক স্থাপনায় হামলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং তারা সেই নির্দেশ অনুযায়ীই কাজ করছে।

 সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম অঙ্গরাজ্য ইউক্রেন ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ সরাসরি রুশ বংশোদ্ভূত এবং রুশভাষী। সোভিয়েত আমলে রুশ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ইউক্রেনীয় জনগোষ্ঠীর মোটামুটি সদ্ভাব বজায় থাকলেও ইউক্রেন স্বাধীন হওয়ার পর দ্বন্দ্ব শুরু হয় এই দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে।

ইউক্রেনের রুশভাষী লোকজন বরাবরই নিজেদের রাশিয়ার অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। অন্যদিকে ইউক্রেনীয়রা সবসময় নিজেদের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জাতি মনে করতে অভ্যস্ত। এটিই মূলত দুই জনগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের মূল কারণ। স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ইউক্রেনে এই ইস্যুতে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই ছিল। ১৯৯১ সালের পর গত ৩ দশকে ইউক্রেনে জাতিগত সংঘাতে নিহত হয়েছেন ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ।

২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় রাশিয়া। এক্ষেত্রে ক্রিমিয়ার রুশভাষী জনগোষ্ঠী রাশিয়ার সেনাবাহিনী ও সরকারকে সরাসরি সহায়তা করেছিল।

তবে ইউক্রেন এখনও ক্রিমিয়াকে নিজেদের ভূখণ্ডের অংশ বলে বিবেচনা করে।

এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই রাশিয়ার প্রধান বৈরীপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের রাজনৈতিক বলয়ে ঢুকতে দেন-দরবার করছিল ইউক্রেন। রাশিয়ার কাছে ক্রিমিয়া হারানোর পর এই তৎপরতা আরও বৃদ্ধি পায়। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করে ইউক্রেন।

ইউক্রেনের এসব কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয় মস্কো এবং ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন প্রত্যাহার করে নেওয়ার আহ্বান জানায় তারা। কিন্তু কিয়েভ তাতে কান দেয়নি।

প্রায় চার বছর এই ইস্যুতে ‍দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলার পর অবশেষে এ বছরের (২০২২) ২৬ ফেব্রুয়ারি রুশ বাহিনীকে ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন ভ্লাদিমির পুতিন।

গত ৯ মাসের অভিযানে ইউক্রেনের চার প্রদেশ খেরসন, ঝাপোরিজ্জিয়া, দনেৎস্ক ও লুহানস্ক দখল করে নিজের সীমানভুক্ত করেছে রাশিয়া। হাজার হাজার সামরিক-বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন এ অভিযানে। ইউক্রেনের ছোট-বড় প্রায় সব শহর গোলার আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছে।

অভিযানে অবশ্য রাশিয়ারও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৬ হাজারেরও বেশি রুশ সেনা। এছাড়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে রাশিয়ার ওপর। এসব নিষেধাজ্ঞার কারণে বেশ বড় ধাক্কা খেয়েছে রাশিয়ার অর্থনীতি।

এসএমডব্লিউ